ভালোবাসার হরমোন, ভালো লাগার রসায়ন
এই যে আমাদের আবেগ, উচ্ছ্বাস, ইচ্ছে, ভালো লাগা, ভালোবাসা কিংবা কাউকে হারানোর ভয়—এ সবকিছুই কার্বন দিয়ে তৈরি কিছু যৌগের এক অদ্ভুত রসায়ন। বাঙালির পয়লা ফাল্গুনে কিংবা যুগলদের ভালোবাসা দিবসে—আমাদের মস্তিষ্কের এক বিশেষ অংশ থেকে নিঃসৃত হতে থাকে একধরনের প্রোটিন ‘Oxytocine hormone’, যা কিনা বিজ্ঞানীদের কাছে ‘Love or Bond Hormone’ নামে পরিচিত। এ ভালোবাসা বা বন্ধন হরমোন আমাদের অজান্তেই পৃথিবীময় ভালোবাসা ছড়ানোর দায়িত্ব নিয়ে বসে আছে।
এ ভালোবাসার হরমোন নিয়ে বিজ্ঞানীদের আগ্রহের শেষ নেই। আমাদের ভালোবাসা, ভালো লাগা, সমবেদনা, বিশ্বাস কিংবা সম্পর্কের সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রতিটি চিন্তায় বা ব্যবহারে এই হরমোন আমাদের মস্তিষ্কে নিঃসরিত হতে থাকে। গর্ভবতী মায়েদের কিংবা মাতৃত্বকালে শিশুকে দুগ্ধপানের সময়ে এই Oxytocine hormone মস্তিষ্ক থেকে রক্তে চলে আসে। মায়েদের প্রসববেদনার সময় Pitcoin নামের যে ড্রাগটি ব্যবহার করা হয়, তা কিন্তু Synthetic oxytocine। এই পৃথিবীতে মানুষসহ অন্যান্য প্রাণীর সবচেয়ে পুরোনো কাজটি হচ্ছে কাউকে ভালোবেসে যাওয়া এবং প্রকৃতিতে নিজেদের প্রজন্মের জোগান দেওয়া। সে জন্যই কিনা, ভালোবাসার হরমোন এ পর্যন্ত প্রায় সব প্রাণীর শরীরেই পাওয়া গেছে। এ হরমোনের সঙ্গে Dopamine এবং Serotonin নামের আরও দুটি হরমোন প্রায়ই ভালোবাসার কাজকর্মে যোগ দেয়। Oxytocine, Dopamine এবং Serotonin এর বিভিন্ন সংমিশ্রণ আমাদের ভালোবাসার প্রকাশে ভিন্ন ভিন্ন মাত্রা পায়।
তাই আমাদের সবার ভালোবাসা বা ভালো লাগা এক রকম হয় নয়; আমরা ভিন্ন ভিন্নভাবে ভালোবাসি। সে জন্যই হয়তো আমাদের কাছে আসার গল্পগুলো এত বৈচিত্র্যে ভরপুর। কেউ ভালোবেসে তাজমহল বানায়, কেউ বিশ্বসংসার তন্ন তন্ন করে খুঁজে নিয়ে আসে ১০৮টি নীল পদ্ম; কেউ হয়তো Oxytocine, Dopamine ও Serotonin-এর অতিরিক্ত নিঃসরণ নিজের মধ্যে চেপে রেখে সন্ন্যাসী হয়—সমুদ্র, পাহাড়, কবিতায় কাউকে খুঁজে; আবার কেউ হয়তো Oxytocine, Dopamine ও Serotonin-এর সংমিশ্রণ ও নিঃসরণে এমন কোনো অনুপাত নিয়ে আসে, ভালোবাসা তখন হিংসাত্মক হয়, বিষবাষ্প ছড়ায় এবং ভালোবাসার গল্প তখন ভীতিকর হয়। বিজ্ঞানীরা এ তিন ধরনের হরমোন Oxytocine, Dopamine ও Serotonin-কে একসঙ্গে নাম দিয়েছেন Happy Hormone বা সুখী মানুষের হরমোন।
২০১৪ সালে কনকর্ডিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক এ ভালোবাসার হরমোন নিয়ে একটি অদ্ভুত গবেষণার ফলাফল ইমোশন (Emotion) নামের একটি বিজ্ঞান সাময়িকীতে প্রকাশ করেন। এ গবেষক দলটি মানুষের নাকে স্প্রের মাধ্যমে oxytocine প্রবেশ করিয়ে দেখার চেষ্টা করে, মানুষের মুখের অভিব্যক্তি পরিবর্তন হয় কি না। তারা দেখতে পায়, নির্দিষ্ট মাত্রার Oxytocine স্প্রে মানুষের মুখের অভিব্যক্তি পরিবর্তন করে এবং একটি সুখী সুখী ভাব নিয়ে আসে। আমি ভাবলাম, এ গবেষণার প্রয়োগ কী হতে পারে? ভালোবাসা স্প্রে নামক বিশেষ কোনো স্প্রের পেটেন্ট হবে হয়তো ভবিষ্যতে (?) নাকে oxytocine স্প্রে করে চেহারায় ভালোবাসা ভালোবাসা ভাব নিয়ে আসতে হবে, এমন ভালোবাসা আমরা চাই না। ভালোবাসা হবে নিখাদ। ভালোবাসা হবে অন্তরে অন্তরে, আত্মার যোগসূত্রে, চিন্তার স্বাধীনতায়।
খেয়াল করলাম, আটলান্টিক-ইউরোপ-এশিয়ার দীর্ঘ দূরত্বে থেকে আমার মধ্যেও কারও জন্য Oxytocine নিঃসরিত হচ্ছে। সঙ্গে Dopamine ও Serotonin ও যোগ দিয়েছে। মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাসে Oxytocine তৈরি হয়ে আবার নিঃশেষ হচ্ছে, আবার তৈরি হচ্ছে এবং চলছেই। কত প্রবল তার রসায়ন। প্রিয়জনকে যে দেশে রেখে আসা হয়েছে। আসছে ফাল্গুনে হয়তো আমাদের আবার দেখা হবে।
সেই সঙ্গে পৃথিবীর প্রায় আট শ কোটি মানুষের Oxytocine, Dopamine ও Serotonin-এর নিঃসরণমাত্রা হোক একটি সুন্দরতম সুখী পৃথিবীর জন্য। এই ফাল্গুনে আর পরিপূর্ণ ভালোবাসায় প্রিয় মানুষেরা আরও প্রিয়জনমুখর হোক। পৃথিবী হোক Oxytocine, Dopamine ও Serotonin-এর সহনীয় ভালোবাসার প্রকাশ।
*লেখক: মাহমুদুল হাসান, পিএইচডি গবেষক, ভার্জিনিয়া টেক, যুক্তরাষ্ট্র ও সহকারী অধ্যাপক, বায়োটেকনোলজি ও জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অনুষদ
সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।