ভালোবাসার খোলা চিঠি

কোনো সম্বোধন ছাড়াই তোমাকে লিখতে বসলাম। আর সম্বোধন করিই বা কী করে। আমরা যখন তোমাদের বাসায় ভাড়া থাকতাম, তখন আমার ছোট ভাইটা ‘নানুক্কা’ বলে ডাকত তোমাকে। এটা ছিল তার নিজস্ব ব্যাকরণের এক কথায় প্রকাশ। আমার পিঠাপিঠি বড়বোন আর আমি তোমাকে কিছুই সম্বোধন করতাম না। যেহেতু তুমি ছোট ভাইয়ের ‘নানুক্কা’ ছিলে। তবুও ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় হয়তো একটা সম্বোধন করতে পারতাম; কিন্তু করিনি। একটা সম্বোধন আর কতটুকুই-বা তোমাকে ছুঁয়ে দেবে, যাতে তুমি পরিপূর্ণ হবে? এবং তা হতো নিতান্ত ভাঁড়ামির শামিল। অনেক বছর পর তোমাকে লিখে কিছু কথা বলার ধৃষ্টতা দেখাচ্ছি।

তাই মনে হচ্ছে অব্যক্ত কথাগুলো জট পাকিয়ে একসঙ্গে বের হতে চাচ্ছে। এত এত কথা একসঙ্গে বের হতে গিয়ে কলমই যেন চলছে না। তার মানে কিন্তু এই নয় যে, আমি এখনো তোমার প্রেমে পড়ে আছি। তুমি এখন শুধু একটা অস্পষ্ট ছায়া, যেন দূরে হেঁটে যাচ্ছ। অন্তর দৃষ্টিতে খুব মনে করি যখন, দেখি পাওয়ার লেন্সের চশমাপরা ঢিলেঢালা পায়জামা-পাঞ্জাবিতে একটা লোক হেঁটে যাচ্ছে। একসময় প্রচুর ফুরসত পেয়ে আমি কিন্তু অনেকগুলো চিঠি লিখতে পেরেছিলাম। সেসব চিঠি তোমার স্মৃতির সঙ্গে জড়িয়ে রেখেছি। একটি চিঠিও তোমার হাতে পৌঁছায়নি। তখন তো মুঠোফোন আর এসএমএসের যুগ ছিল না, যে সেন্ড করলেই প্রাপকের কাছে চলে যাবে।

আমার কোনো স্মৃতিই তোমার কাছে নেই। কোন একদিন আমার একটা চিঠি কাকতালীয়ভাবে তোমার বন্ধুর হাতে পড়েছিল। চিঠিটা আমি তাকেই লিখেছি ভেবে সে খুশিতে কেঁদে ফেলেছিল। তুমি তামাশা করে বলেছিলে, ‘কার কাননের ফুল, আর কে সেই মালি!’ তোমার সেই কথাটা আজও আমাকে আপ্লুত করে।

তোমার কি মনে আছে? বাবার চাকরির সুবাদে আমরা যখন তোমাদের বাসা ছেড়ে সরকারি বাসায় উঠলাম, তখন তোমার চোখমুখ লাল হয়ে দু গাল বেয়ে অশ্রু গড়িয়েছিল। আমার ছোট ভাইটা তোমাকে জড়িয়ে ধরে ‘নানুক্কা’ বলে কী কান্নাই না কেঁদেছিল। সেদিন তুমি চকলেট দিয়ে সন্ধি করেছিলে তার সঙ্গে। অনেক কষ্টে আমি কান্না লুকিয়ে রাখতে পেরেছিলাম। সেই চোখের জল কি মিথ্যে ছিল বল?

জানো, আজ আমি অন্যের ঘরনি হয়েও তোমাকে অনেক প্রশ্ন করার ইচ্ছে জাগছে। কিন্তু তা হৃদয়ের গহিনে পুঁতে রেখেছি। কী হবে প্রশ্ন করে, যার অনেক উত্তরই আমার জানা। তবুও আজ কিছু প্রশ্ন রেখে গেলাম। তার উত্তর তোমাকে কোনো দিন দিতে হবে না।

আমাদের নতুন বাসার ঠিকানা তোমাকে কেউ বলে আসেনি। কিন্তু কী আশ্চর্য তুমি ঠিকই চলে আসতে আমাদের বাসায়। বছর পাঁচেক আগের কথা। কলেজ শেষ করে মফস্বল শহর ছেড়ে তুমি চলে গেলে ঢাকায়। তারপর শুনলাম চাকরি নিয়েছ এক সাপ্তাহিকে সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে। তোমার চাকরির সুবাদে ওই পত্রিকাটা চলে এল আমাদের মফস্বল শহরের হকারদের হাতে হাতে। আমরাও মাসিক গ্রাহক হলাম। পত্রিকার পাতা ওল্টাতেই ভেসে আসত তোমার ছবি। দিনের পর দিন খুঁজতে থাকি তোমার কবিতা। ছাত্রাবস্থায় তুমি চমৎকার কবিতা লিখতে। তোমার কবিতার ভক্ত ছিল আমার মতো অনেক ষোড়শী।

একদিন পত্রিকার সাহিত্যের পাতায় চোখ পড়তেই শিহরিত হলাম। এই তো তোমার কবিতা; নাম দিয়েছ—‘দীর্ঘশ্বাসের বাঁশি’। লিখেছ—

‘তুমি আমার সারা জীবন দীর্ঘশ্বাসের বাঁশি হয়ে

বাজবে কেবল, বেজেই যাবে!

বুকের মধ্যে প্রিয়তম তীরের মতো ধরেই আছি।’

তোমার কবিতাটি বারবার পড়েও যেন মনে তৃপ্তি আসে না। কবিতাটি আমাকে পিড়া দেয়। মানুষ তো এতটুকু ভালোবাসা পেলেই কত খুশি হয়। আমি শুধু তোমার কালো চশমার আড়ালে বোবা ভালোবাসা চেয়েছিলাম। জানো আমি না মারা গিয়েছি। ভয় পেয়ো না আমি মরে গেছি আমার অনুভবে। মৃত্যুটা তোমাকে না পাওয়ার জন্য। তবে এর জন্য আমি তোমাকে দায়ী করব না। কারণ, ভালোবাসার মানুষদের কখনো দায়ী করা যায় না।

খুব ইচ্ছা ছিল তোমাকে একদিন জড়িয়ে ধরে বলব—‘দোহাই তোমার, আমাকে ছেড়ে কোথাও যেও না।’ আজ অনেক কিছু বলে ফেললাম বোধ হয়। মনটা অনেক খারাপ হয়ে যাচ্ছে। চোখের কোণে কিছু নোনা পানির অস্তিত্ব টের পাচ্ছি। না, আর লিখব না তোমাকে নিয়ে। আমি ভালো করেই জানি, তোমাকে আর ফিরে পাব না কোনো দিন। আর পেলেও গ্রহণ করতে পারব না। কারণ, এখন আমি স্বামী-সংসার নিয়ে ‘পরম সুখে’ আছি। তোমার প্রতি আমার অনুরোধ কখনো আমার কথা স্মরণ করে মন খারাপ করো না। আমাকে কখনো দোষারোপ করো না। তুমি ঢাকা চলে যাওয়ার পর বড় বোনের বিয়ে হয়ে যায়।

কিছুদিন পরই কানাডা প্রবাসী সুপাত্র পেয়ে বাবা পীড়াপিড়ি শুরু করে দিলেন আমাকেও বিয়ে দেবেন। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কন্যাদান করতে চান। পাত্র কিছুতেই হাতছাড়া করা যাবে না। ঠিকই একদিন ওই প্রবাসী লোকের সঙ্গে আমার বিয়ে হয়ে গেল। অল্প দিনের ব্যবধানে আমিও প্রবাসী হলাম। তখন শুধু গান গাইতে ইচ্ছা করত—‘বড় স্বাদ জাগে একবার তোমায় দেখি।’

আমার জন্য কখনো মন খারাপ করো না। হয়তো কখনো তোমার মন খারাপের কারণ হওয়ার যোগ্যতা আমার ছিল না। জানো, এখনো আমার পরিষ্কার মনে আছে—তুমি যখন আমার সামনে এসে টিনএজারের মতো আচরণ করতে, আমার খুব হাসি পেত। সেটা আমি জানতাম তোমার একতরফা পাগলামি ছিল। যাক সেসব কথা। আমাকে পাওয়ার জন্য তোমার কী ব্যাকুলতা ছিল, তা আমি জানতাম। তবুও আমার মনের ভাব প্রকাশ করতে না পেরে যে দুঃসহ বেদনা আমাকে ঘিরে ধরেছিল, সে কি তুমি জানতে?

ধুর আমি কী বোকা! সেটা তুমি কী করে জানবে? আমার কষ্ট কী জানো? একটিবারের জন্যও তোমাকে বলতে পারিনি—আমি তোমাকে ভালোবাসি। তুমি হয়তো বুঝতে পেরেছিলে আমাকে। তাই একদিন তিন পৃষ্ঠার চিঠি দিয়ে জানালে তোমার অব্যক্ত কথা। তোমার হাতের লেখা অস্পষ্ট হলেও চিঠিতে গুটিকয়েক কবিতা আমাকে মুগ্ধ করেছিল। আর আমারই অসাবধানতায় চিঠিটা পড়ে গেল আমার বোনের হাতে। সে চিঠি পড়ে এমন ভাবে রিয়্যাক্ট করল, যেন আমাকে প্রেম

নিবেদনের কোনো যোগ্যতাই নেই তোমার। বাসায় আমিও ভীষণভাবে অপমানিত হলাম; সেই সঙ্গে তুমিও।

তাই হয়তো অনেক অপমানে-অভিমানে তুমি দূরে চলে গিয়েছিলে। তোমাকে যতগুলো চিঠি লিখেছি, তার সবগুলোই আমি জমিয়ে রাখতাম। কেন, তা আমি নিজেও জানতাম না। একদিন ধরা খেলাম রাজিবের হাতে। জানো, আমার স্বামী রাজিব খন্দকার খুব অমায়িক ভদ্রলোক। এর আগে তাকে আমার জানার সুযোগ হয়নি। সে কত সহজে ব্যাপারটা সামলে নিল, তা আমি চিন্তাও করতে পারিনি। পরিবারকে সুন্দর করে গড়ে তোলার জন্য প্রেমঘটিত ব্যাপার-স্যাপার সে সব সময় এড়িয়ে চলেছে। সে কোনো দিন আমাকে প্রশ্নও করেনি যে, চিঠিগুলো কার?

এখন তোমাকে নিয়ে আমি আর ভাবি না। আমার সব ভাবনা ভোঁতা হয়ে গেছে। তবে হৃদয়ের যে রক্তক্ষরণ, তা রয়ে গেছে এখনো। ঘুণপোকা হয়ে কুরে কুরে খাচ্ছে অনবরত। এখন বুঝতে পারছি ভালোবাসতে হয় মন ও আত্মার সবকিছু দিয়ে। তিন দশক পর কেন জানি এত কথার ফুলঝুরিতে তোমাকে বিব্রত করছি। আজ এ পর্যন্তই। ভালো থেকো অনেক কাছের মানুষ হয়ে। দূরে থাকলেও দূরত্বে থেকো না। অনেক অনেক ভালো থেকো। তোমার সুখ ভেবে চোখের জলের জলাঞ্জলি দেব আমি সারা জীবন।

ইতি

তোমার কেউ না