ভালোবাসায়ও জং ধরে
ছোট বা পাইলট প্ল্যান্ট স্কেলে যেকোনো কিছু তৈরির শুরুটা করা হয় প্রথমে। যখন সবকিছু মনঃপূত হয়, তখনই সব ধরনের নিয়মকানুন মেনে বাজারজাত প্রক্রিয়াটি বড় পরিসরে করা হয়। নতুন যেকোনো প্রডাক্ট তৈরিতে প্রথমে ছোট থেকে শুরু করা, এটা এমন নতুন কিছু নয়। গ্রামে ছোটবেলায় দেখেছি, মা যখন নতুন কিছু রান্না করতেন, তখন খুব সতর্কতা অবলম্বন করতেন। প্রথমবার সব ঠিকমতো হলেও আরও কয়েকবার করতেন এবং সবশেষে একটি রেসিপি তৈরি করতেন। কী দাঁড়াল ব্যাপারটা তাহলে? স্মল স্কেল থেকে স্কেল আপ করা বা ছোট দিয়ে শুরু করে, পরে বড় কিছু করা। এই সহজ জিনিসকে এখন একটু জটিল করে বর্ণনা করি।
(পাইলট প্ল্যান্ট একটি প্রাক-বাণিজ্যিক উৎপাদনব্যবস্থা, যা নতুন উৎপাদন প্রযুক্তি নিয়োগ করে। মূলত নতুন প্রযুক্তি সম্পর্কে জানা এর উদ্দেশ্য। পাইলট প্ল্যান্ট স্কেল একটি আপেক্ষিক শব্দ, যা পূর্ণ স্কেল উৎপাদনের চেয়ে ছোট। এ ছাড়া পাইলট প্ল্যান্ট অন্তর্নির্মিত পরীক্ষাগারে স্টক ল্যাব সরঞ্জাম হিসেবে ব্যবহার করা হয়।)
গানের ছন্দে বলতে হয় ‘বলো না সহজ করে আমায় পেরেছ তুমি বুঝতে, হয়নি একটু দেরি এ গানের কোনো মানে খুঁজতে।’ জীবনে এমন অনেক ঘটনা রয়েছে, যা শিক্ষিত মানুষের হাতে গিয়ে জটিলতর রূপ ধারণ করে। যার ফলে সাধারণ মানুষের পক্ষে সেটা বোঝা সম্ভব হয় না। তাই তারা অশিক্ষিত, মূর্খ হিসেবে সমাজে চিহ্নিত হয়। আমি যে কথা লিখতে বসেছি, সেটা হলো, আমি সুইডেনে বাংলাদেশের শাক–সবজির চাষাবাদ করতে একটু জমির ওপর প্রাথমিক পর্যায়ে কাজ শুরু করেছি। ঠান্ডা দেশে গরম দেশের শাক–সবজি, ফলমূলের উৎপাদন হবে কি না, হলে কোনগুলো হবে স্বল্প সময়ে, এসব নিয়ে চলছে আমার চেষ্টা। যদি দেখি চেষ্টা এবং চাহিদা ভালো, তাহলে সুইডিশদের অনুপ্রেরণা দেব। বাংলাদেশের খাবার থেকে শুরু করে সে দেশের ফল–মূল, শাক–সবজিসহ সবকিছুতে তাদের উৎসাহ দেব, যাতে তাঁরা আমার দেশের ফসলের প্রতি আগ্রহ বাড়ান। গত তিন সপ্তাহে অনেক কিছু ঘটেছে। খেতে নানা ধরনের সবজি হয়েছে। আজ পাশের প্রতিবেশী লালশাক ও ধনিয়াপাতা পেয়েছে আমার কাছ থেকে। তাকে রান্না করার সহজ উপায় বলেছি।
যে ঘটনাটি সবচেয়ে বেশি মজার, সেটা নিয়ে এখন বলি। আমার প্রতিবেশী শৌখিন চাষি। বয়স ৩০ বছর, তার বউয়ের বয়স ২৮। তারা দুজনই নিরামিষভোজী। ছেলেটির নাম ডানিয়েল। ডানিয়েলের বাবা নিউজিল্যান্ডের এবং মা সুইডিশ। ডানিয়েল ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার, অবসর সময়ে বাগান করে আমার মতো। ডানিয়েল এবং তাঁর স্ত্রী আনিকার প্রথম সন্তান হয়েছে, বয়স সবে ছয় মাস। আনিকা মাতৃত্বকালীন ছুটিতে সন্তানের সঙ্গে বাড়িতে। ছেলেকে স্ট্রোলারে নিয়ে বাগানে এসেছে। ছেলে স্ট্রোলারে ঘুমাচ্ছে, এদিকে মা–বাবা চুপচাপ কাজ করে যাচ্ছে। আমি আমার বাগানে কাজ করছি। কিছুক্ষণ পর ডানিয়েল আমার খেতে এসে বলল, হাই রহমান। পরে ডানিয়েল আমার খেতের লালশাক এবং ধনেপাতা সম্পর্কে জানতে চাইল। ঘটনা প্রসঙ্গে বলল, তাঁর এবং আনিকার সময়টা একটু জটিলতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। আমি কারণ জিজ্ঞেস করলাম। খুব বেশি দিনের পরিচয় না হলেও কেন যেন পারিবারিক সমস্যা শেয়ার করল। যতটুকু বুঝলাম, তাদের প্রথম সন্তান হয়েছে, তার পেছনে সময় দিতে গিয়ে স্বামী-স্ত্রীর যে একটা অন্তরঙ্গ সম্পর্ক, তা কিছুটা হারিয়ে গেছে। আমি তার কথা শুনে সমস্যাটাকে জটিলভাবে না দেখে তার হাতে কিছু লালশাক এবং ধনেপাতা দিয়ে দিলাম। আজ রাতের খাবারে যাতে ভাত, ডাল এবং লালশাক ভাজি খায়, সেটাও বলে দিলাম।
ডানিয়েল বলল, ‘আমি রান্না করতে পারি, তবে শাক কখনো ভাজি করিনি।’ আমি বললাম, ‘সমস্যা নেই। আমি যেভাবে বলি, ঠিক সেভাবে বাসায় রান্না করবে। পরে দুজন একসঙ্গে রাতের খাবার খাবে।’ ডানিয়েল বলল, ‘তুমি তাহলে আনিকাকে একটু বলো বিষয়টা।’ বললাম, ঠিক আছে। ডানিয়েলরা থাকে খেতের বেশ কাছে। সে বেশ কিছু শাক এবং ধনেপাতা নিয়ে বাড়িতে চলে গেল। এর মধ্যে আনিকা আমার কাছে এসে জিজ্ঞেস করল, কী ব্যাপার, ডানিয়েল কী নিয়ে গেল? আমি বললাম,‘ ও তোমাকে আজ বাংলা ভেজিটেরিয়ান খাবার রান্না করে খাওয়াবে। তাই শাক আর ধনেপাতা নিয়ে গেল।’ আনিকা আরও জিজ্ঞেস করল, ‘ডানিয়েল আমাকে তাদের সমস্যার কথা কিছু বলেছে কি না?’ আমি বললাম, ‘না, তেমন কিছু বলেনি। তবে বলেছে, তোমাদের সময়টা একটু টাফ যাচ্ছে। আমি ওকে বলেছি, ও যেন আজ তোমাকে লালশাক ভাজি এবং ডাল–ভাত রান্না করে খাওয়ায়। ডাল–ভাতের সঙ্গে লালশাক খেলে রাগ দূর হয়ে যাবে,’ বলে একটু হেসে দিতেই আনিকা বুঝেছে আমি একটু মজা করেছি। আনিকা আমার কথা ঠাট্টা ভেবে নিয়েছে বলে মনে হলো, তবে ডানিয়েল সিরিয়াসলি নিয়েছে। ফলে শাক রান্না করতে যা যা দরকার, সেসব কেনার জন্য তাড়াহুড়ো করে বাড়িতে গিয়েছে।
জানি না বাংলা খাবার কেমন হবে এবং খাবারের পর কী প্রতিক্রিয়া হবে তাদের মধ্যে। তবে মনে হলো, কিছু একটা হবে আজ। যেমন একসঙ্গে নতুন একটা খাবার খাবে, খাবার নিয়ে কথা হবে। খাবারের পর অভিমান তেমন থাকবে না। ভালোবাসায় যে জং ধরেছে, তা কিছুটা কমবে বলে আমার ধারণা। যা–ই হোক, আনিকা বিদায় নিল। যাওয়ার সময় বলে গেল, ‘কাল জানাব খাবারের খবর।’ আমি বললাম, ‘তোমাদের সম্পর্কেও জানিও।’ একটু হেসে দিতেই সে বুঝেছে, আমি কী বলতে চেয়েছি। আমি কাজ সেরে সাঁতারে গেলাম। আজ খেতে ঢুকতেই দুজন এসে একসঙ্গে ধন্যবাদের বন্যা বইয়ে দিল। ডাল-ভাত এবং লালশাক তাদের কাছে মনে হয়েছে অমৃত। রাতে আর কী ঘটেছে তা বলেনি, তবে বলেছে তাদের প্রস্রাব লাল হয়েছে। প্রথমে একটু ভয় পেয়েছিল, পরে আন্দাজ করেছে লালশাক খাওয়ার কারণে এমনটি হয়েছে। মনে মনে ভাবছি, ভালোই হলো। বাংলার গ্রামের খাবার তাদের পছন্দ হয়েছে, এই ঘটনা তাদের জীবনে গেঁথে থাকবে। যাওয়ার সময় ডানিয়েল বলে ফেলল, ‘রহমান, তোমাকে অনেক ধন্যবাদ আমাদের জীবনের জটিল সময়টিকে সহজ করে দেওয়ার জন্য।’ আনিকাও হাসিমুখে সহমত পোষণ করল।
লেখক: রহমান মৃধা, সুইডেন