ভালোবাসা কারে কয়

‘ভালোবাসা কারে কয়’—এটা বলা বড় মুশকিল। সৃষ্টির সূত্র অনুযায়ী, একজন মানব একজন মানবী স্বাভাবিক নিয়মেই ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ হন, তা হোক প্রেমিক-প্রেমিকার সম্পর্ক বা স্বামী-স্ত্রীর। প্রেমের উঠানে প্রতিদিনই ভালোবাসা খেলা করে।

ভ্যালেন্টাইনস ডে বা ভালোবাসা দিবস সেখানে একটা ‘নিমিত্ত’ মাত্র। অনেক সময় দুজন মানুষ আলাদা হয়ে গেলেও বছর শেষে নতুন সেই দিনটিতে কোনো একটা উপহার মনে করিয়ে দেয় তাঁদের ভালোবাসার কথা। স্মৃতি হাতড়ে কষ্টের ভেতরও একজন মানুষ আনন্দ খুঁজে পান। কিংবা সংসারে জাঁতাকলে পিষ্ট কপোত-কপোতী সুযোগ পান ভালোবাসা প্রকাশের—হোক না সেটা ছোটখাটো কোনো উপহার।

প্রেমিক-প্রেমিকার মিলন হলেই তা যেমন গভীর ভালোবাসা নয়, আবার বিরহে বসবাস করলেই যে প্রেমহীন জীবন, তাও বলা যায় না। অনেক সময় দুই হৃদয় ঝড়-তুফানে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে একাকার হয়ে যাওয়ার নামই মনে হয় ভালোবাসা। আবার কখনোবা মনে হয়, নিশ্চিন্তে সুখে আয়েশে বসবাস করার নামই বুঝি ভালোবাসা। কখনোবা সুখের বসবাস জীবনের নিশ্চয়তা দেয় সত্য, কিন্তু ভালোবাসার আর জন্ম হয় না। পাশাপাশি থেকেও মনের দিকে দুজন মানুষ হয়ে যায় দুই মেরুর বাসিন্দা। আগাগোড়া সুখের মোড়কে মোড়া থাকলেও মনের মানুষের যে অবস্থান, তা কোনো কিছু দিয়েই পূরণ হওয়ার নয়। সমাজের কঠোরতার মাঝে প্রেমকে কবর দিতে হয়। অনেক প্রেমিকা যেমন কবর দেন তাঁদের ভালোবাসাকে, তেমনি অনেক রাজপুত্রের মতো প্রেমিকও কবর দেন তাঁদের ভালোবাসা। একসময় মানুষ ডায়েরির পাতায় লিখে যেত গোপনে হৃদয়ের শূন্যতার কথা। এখন সামাজিক যোগাযোগব্যবস্থার খোলা পাতায় আমরা প্রতিদিনই দেখি মানুষের মনের পোস্টমর্টেম বা ব্যবচ্ছেদ। মনের খুব গোপন কোটরে সবাই দাগ ফেলতে পারে না। এ ক্ষেত্রে অনেক যোগ্য পুরুষ যেমন অযোগ্য হয়ে ওঠেন, তেমনি অনেক সুন্দরী নারী আঁচড় ফেলতে পারেন না। যা পারে শ্যামলা সুন্দরী ডাগর চোখের কোনো প্রিয় মুখ। এমন ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্যতা নিয়ে জন্মগ্রহণ করেন পৃথিবীতে খুব কম মানুষ। আর তাঁদের জন্যই বুঝি কবি লিখেছেন,
‘কত বার ভেবেছিনু আপনা ভুলিয়া
তোমার চরণে দিব হৃদয় খুলিয়া।
চরণে ধরিয়া তব কহিব প্রকাশি
গোপনে তোমারে, সখা, কত ভালোবাসি।’

তা কি আর বলা হয়? অনেক সময় শূন্যতার মধ্যেও ভালোবাসার এক বিশাল সমুদ্র সব সময়ই ঢেউ তোলে। মন থেকে কখনোই প্রেম ফুরিয়ে যায় না। বসন্তের সব ফুলে ভালোবাসার ডালি সাজিয়ে নিয়ে বসে থাকলেও কিংবা আগাগোড়া সুখে মুড়িয়ে দিয়েও দেখা যায় এমন ধন্যি প্রেমির মন পাওয়া হয়তো অসম্ভব হয়ে পড়ে। অথচ এমন কোনো প্রিয় মুখের অপেক্ষায় কাটিয়েছে অনেক দিন, অনেক রাত্রি। মনের মাঝে গোপনে চাষ করেছে স্বপ্ন আর ভালোবাসা। ওই রকম প্রিয় কেউ যদি জিজ্ঞাসা করে, ‘কেমন আছো?’ ঠিক তখনই হৃদয়ে বেঝে ওঠে,
‘আপনি আজিকে যবে শুধাইছ আসি,
কেমনে প্রকাশি কব কত ভালোবাসি।’

বিরহী হৃদয় বলে, ‘তোমায় পেলাম না বলেই হৃদয়ে প্রেম অমরত্ব লাভ করল।’ আর যে দুটি মানুষ পাশাপাশি আছে, তারা ডুবে থাক ভালোবাসায়। সবকিছুর পরও সব দিন হয়ে উঠুক সবার ভালোবাসা দিবস। ছোট্ট একটা গল্প দিয়ে শেষ করছি:
একরাজ পুত্র এক গরিব বেদের মেয়েকে অনেক বছর ধরে ভালোবাসত। সে মন থেকেই ভালোবাসত, কিন্তু রাজবাড়িতে আর তাকে নিয়ে যাওয়ার মতো সাহস হয় না। অনেক পরিকল্পনার পর এক ভালোবাসা দিবসে ধর্মীয়ভাবে তাকে বিয়ে করল। তারপরও রাজবাড়িতে তার জায়গা হয় না। কারণ, রাজমাতা জানিয়ে দিয়েছেন, এই মেয়েকে যেদিন ঘরে আনবে, রাজপুত্র তাঁর মরা মুখ দেখবে। রাজকুমার আবার মায়ের খুব অনুগত সন্তান।
দিন গড়িয়ে যায়, বেদের মেয়ে রাজবাড়িতে যাওয়ার স্বপ্ন ভুলে গেল, কারণ সে সন্তানের মা হবে। কিন্তু তার সন্তান দুই মাস মাতৃগর্ভে থাকাকালে মারা গেল। তার প্রচণ্ড মানসিক কষ্টই ছিল এর কারণ। রাজমাতার হুকুম অনুযায়ী রাজপুত্র দ্বিতীয় বিয়ে করল। বেদের মেয়ের খুব মন খারাপ থাকত। সে কথা বলাই বন্ধ করে দিল। তবু ঝড়-তুফানে রাজকুমার বজরার সামনে দাঁড়িয়ে থাকত। আবারও তাদের মাঝে সব স্বাভাবিক হলো। কারণ, রাজপুত্র বলল, সে শুধু তাকেই ভালোবাসে। কিন্তু বেদের মেয়ে আবারও মা হতে চাইলে রাজপুত্র বলত, সে চায় না তার সন্তান এখানে সেখানে বড় হোক। এর মাঝে রাজবাড়ি থেকে এলান হলো, ছোট বউ মা হবেন। সে খবর শোনার পর বেদের মেয়ে রাজপুত্রের সঙ্গে একেবারে যোগাযোগ বন্ধ করে দিল। প্রায় পাঁচ মাস দেখা হলো না। ভালোবাসা দিবস এল এবং রাজকুমার বেদের মেয়েকে তার কাজে যাওয়ার পথে আটকাল। একটা উপহারের প্যাকেট দিয়ে অনেক ক্ষমা চাইল। বেদের মেয়ে শুধু বলল, ‘তুমি আমাকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর উপহার থেকে বঞ্চিত করেছ। এই উপহার দিয়ে কী করব?’
বেদের মেয়ের কথায় এমন কিছু ছিল, পৃথিবী যেন কয়েক সেকেন্ডের জন্য চলতে ভুলে গেল। যেন খোদার আরশ কেঁপে উঠল। রাজপুত্রের চোখ থেকে পানি ঝরতে লাগল। তখন উপহার নিয়ে ফেরত গেলেও সে রাতে রাজকুমার আবার বজরার সামনে বসে থাকল। শীতের রাত। এত কষ্ট পাওয়ার পরও বেদের মেয়ে তাকে কষ্টে দেখতে পারে না। দরজা খুলে দিল। দুজনে অনেক কাঁদল সে রাতে। একসময় সব কষ্ট ভুলে দুজন ডুবে গেল গভীর ভালোবাসায় আর বিধাতা তখন পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর উপহারের বীজ বপন করে দিলেন বেদের মেয়ের মাতৃক্রোড়ে। যেন তুমিও থাকবে না, আমিও না—রয়ে যাবে ভালোবাসার নিশানা।