ভালোবাসা আসলে কী
ভালোবাসা নিয়ে আমার মনে মিশ্র প্রতিক্রিয়া চলে। আসলে প্রশ্নের পর প্রশ্ন চলে মাথায়।
ছোটবেলায় পাড়ার সবচেয়ে সুন্দর মেয়েটির প্রেম হলে, সেটা আর চাপা থাকেনি। রাজপুত্রের মতো দেখতে সুদর্শন ছেলেটির প্রেমেই পড়েছে সে। আমরা বাচ্চারা খুবই এক্সাইটেড। একদিন ভাইয়া আমার হাতেই এক ক্যালেন্ডার ধরিয়ে দেয়...মেয়েটিকে দেওয়ার জন্য। আমি তো খুশিতে ডিগবাজি খেয়ে সেটা তার হাতে পৌঁছে দিই।
দুদিন পর এক মহিলা তার মেয়েসহ আমাকেই রাস্তায় জিজ্ঞেস করে, সেই মেয়ের ঠিকানা।
ছেলের পরিবার! আমি তো ভেবেছি, বিয়ের কথা বলতে চলে এসেছে মনে হয়!
খুশি মনে সে বাসায় পৌঁছে দিয়ে বান্ধবীর সঙ্গে কথা বলতে বলতে বুঝি, কী ভীষণ ভুল করেছি!
বিচার দিতে এসেছে মেয়ের বাসায়!
নিজেদের ছেলেকে কন্ট্রোল না করে, ইজি প্রেম!
সেদিন বান্ধবীর বেইজ্জতিতে কেঁদেছিলাম! বান্ধবীর চেয়েও বেশি! আমি জেনেছিলাম, প্রেমে পড়লে মেয়েদের কেমন বেইজ্জতি হয়! পাড়া ছেড়েই চলে গেল ওরা! ছোট থেকে একসঙ্গে বড় হয়েছি আমরা! আমার বড় ছিল। পরিবারের সঙ্গে ওঠাবসা! আমি চাইলেও সে অপমান ভুলতে পারি না!
পরিবারের সবচেয়ে ছোট, চুপচাপ, সবার আদরের সুন্দরী মেয়েটা হুট করে পালিয়ে গেল! গেল তো গেল অসম সম্পর্কের একজনের সঙ্গে! মন খারাপ ছিল অনেক বছর! শহরের নামকরা যেকোনো পরিবারের বউ হতে পারত!
কয়েক বছর পর দেখি ফিরে এসেছে এক বাচ্চা নিয়ে! বিচ্ছেদ হয়ে গেছে! পরে বিয়ে করে দেশান্তরি! জানি না ছেলেটার কী অবস্থা!
ছোটবেলার প্রিয় বান্ধবী, প্রেম করে...না ঠিক নয়, পারিবারিকভাবে সবংশে বিয়ে করল! কী উচ্ছ্বাস দেখেছি তার! চিঠির পর চিঠি পাঠাত আমায়।
তাকে আমি আর খুঁজে পাই না! সেই ছেলে নাকি মুসলমান হয়ে, ওরে বিয়ে করার আগে এক মুসলমান বিয়ে করেছিল! পুরো বিষয়টি গোপন করে বান্ধবীকে বিয়ে করেছে!
বান্ধবী কোথায় কে জানে? তার মা–ও নেই! তার পরিবার মুখে কুলুপ এঁটে রেখেছে কই সে থাকে, তা জানাবে না বলে!
আরেক বান্ধবী হুজুগে প্রেমে পড়ল। পাড়ার ছেলে ধর্মগ্রন্থ হাতে নিয়ে বলছে, মরে যাবে প্রেম না করলে! তারেও কসম খেতে হবে, প্রেম করবে! জীবনেও অন্য কাউকে ভালোবাসবে না। প্রেমকাহিনি জানি না...বান্ধবীর লাইফ যে বরবাদ জানি! সে ছেলে যে অন্যদের বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছে, তা–ও জানি!
আরেকজনের কাহিনি জানি, তার বান্ধবী তারে তার বন্ধুর জন্য ব্ল্যাকমেল করে বলে যে তুমি প্রেম করতে রাজি না হলে ওই ছেলে আত্মহত্যা করবে! মেয়েটি ভয়ের চোটে হ্যাঁ বলেই বুঝতে পারে, কী অসম্ভব বোকামি সে করেছে! প্রেমকাহিনি হয়নি...তবে সে মেয়েটিরও লাইফ বরবাদ হয়ে গেছে!
আরেকজনের তুমুল প্রেমকাহিনি! মুখে মুখে জুটির সুনাম! বিয়ে ও হলো...মাসখানেকের মাঝেই মেয়েটির প্রথম আত্মহত্যার চেষ্টা। বহু বছর পর সেই তুমুল প্রেমিকা বউয়ের পাশে ভিন্ন লোক দেখে বুঝতে বাকি থাকে না...হানিমুন শেষ হতেই প্রেমও শেষ হয়ে গেছে! যে যার রাস্তায় চলছে!
সুইট একজনের প্রেমকাহিনিই জানি শুধু, বিয়ে করে বাচ্চাকাচ্চাসহ ভালো আছে! সুখী আছে!
বেশির ভাগই প্রতারণার গল্প!
পরিবারের কারণে হাজারো সুন্দর সম্পর্ক নষ্ট হয়! পরিবারের পছন্দে বেশির ভাগই ভিন্ন মানুষের সঙ্গে বাধ্যতামূলক জীবন কাটায়! সুখী হয়তো হয়, হয়তো নয়!
প্রেম করে বিয়ে করলেও যে সুখী এভার আফটার লাইফ হয়, তা–ও নয়।
কম্প্রোমাইজ সব সম্পর্কেই করতে হয়! কোথাও বেশি, কোথাও কম! কেউ কেউ টু পজেসিভ, বেঁচে থাকাই হারাম করে দেয়। কেউ কেউ গায়েই মাখে না তার প্রিয়জন বৃষ্টি ভালোবাসে না চাঁদ, না হাতে হাত রেখে হেঁটে বেড়াতে...খোঁপায় গাজরার মালা না গোলাপ! ঝুমবৃষ্টিতে পাশাপাশি বসে থাকা না চাঁদের আলোয় মাখামাখি ভালোবাসা! প্রত্যাশার মৃত্যু, মনের মৃত্যু, ভালোবাসার মৃত্যু নিয়েও পাশাপাশি শুধু হয়তো থেকেই যায়! ভালো আর বাসে না। সমাজের কথা ভেবে হয়তো ছেড়েও যায় না!
আবার কেউ কেউ মনের মাঝে কারও কারও জন্য তুমুল ভালোবাসা লুকিয়ে রেখেই আজীবন অন্যের সঙ্গে সংসার করে—ঝামেলা করে লাভ কী ভেবে! কদিন পরে তো মরেই যাবে ভেবে—সহ্য করে নেয়, জীবনের সবচেয়ে বড় অপ্রাপ্তিকে!
দু–একজন সাহসী মহিলাকে দেখেছি বিয়ে, বাচ্চা ফেলেও প্রিয়জনের হাত ধরে চলে যেতে! সুখ যেখানে, সেখানে যাবে—সমস্যা কোথায়? তবে সেসব বাচ্চাদের আটকে রেখে তাদের জীবন দুর্বিষহ করতেও দেখেছি (স্বামীর পরিবার)! অথচ ভদ্রভাবে ডিভোর্স আর বাচ্চাদের ব্যবস্থা করা যেত!
কেউ কেউ আসলেই সুখী হয়েছে সেই জীবন থেকে মুক্তি পেয়ে...নিজেদের মতো জীবন যাপন করতে পেরে। ভালোবাসা সত্যিই এসেছে বিবাহ–পরবর্তী জীবনে!ভালোবাসারা মরে গেলে সেই মৃত ভালোবাসা শুধু সন্তান, সমাজের জন্য বয়ে বেড়ানোর মানে নেই আমার কাছে! সবার সুখী হওয়ার অধিকার আছে! একজনের সঙ্গেই আজীবন অসুখী জীবন কাটাতেই হবে...কেন যেন আমাদের সমাজ তা ম্যান্ডেট করে দেয়! পুরুষের ক্ষেত্রে সমস্যা কম—চার বউয়ের ফতোয়া দিয়ে তার রাস্তা পরিষ্কার রাখে!
কিছু কামুক পুরুষ শুধু ভোগ করতেই চায়! তারা সম্পর্কের নাম বা স্বীকৃতি দিতে নারাজ! মেয়ারা আজও পিছিয়ে!
প্রেম করে? ওমা ছি ছি!
জামাই আছে? বিবাহিত? তারপরও প্রেম করতে ইচ্ছা?
ডিভোর্সি? কেন প্রেম করবে? তাদের জীবন শেষ?
বিধবা? মাথা খারাপ...কার না কার আবার সর্বনাশ করে!
বিবাহবিচ্ছেদ? বাচ্চা আছে? বাচ্চা ছাড়া হয়তো কোনো সুবিশাল হৃদয় পুরুষ—মেয়ের বাপের পয়সা, প্রতিপত্তি দেখে, রূপ–গুণ দেখে, যৌতুক নিয়ে বিয়ে করতে রাজি হয়...কিন্তু অন্যের সন্তান? না তাকে ছেড়ে আসতে হবে! মায়ের সঙ্গে তার সন্তানের জীবনের মতো বিচ্ছেদ! সেম হয় বিধবার বাচ্চাদের সঙ্গে!
মুখে আমরা যতই ভালোবাসা বলি, নিজেদের চেয়ে কাকে বেশি ভালোবাসি? সমস্যায় পড়লে কাকে ছেড়ে আসবেন?
ওই যে মুখে ফেনা তুলে তুলে ভালোবাসেন বলেন যাকে, তাকেই!
যাকে না দেখলে দিন কাটে না, রাত কাটে না, জীবন ধূসর মনে হয়...খেতে মন লাগে না, ঘুমানোর জন্য চোখ বন্ধ করতে ইচ্ছে হয় না...চোখ থেকে তার ছায়া সরে যাওয়ার ভয়ে; সেই তাকেই, সেই তাকেই পথে ফেলে আসতে কোনো প্রেমিকই দুবার ভাবে না পরিস্থিতির চাপে পড়লে!
বানরের গল্পই বলি, কুয়োয় বাচ্চা পড়েছে বলে, বাচ্চা বাঁচানোর চেষ্টা করে হয়তো প্রথমে! তবে কুয়ো পানিতে ভরে গেলে, সে মা–ও বাচ্চার মাথার ওপরই দাঁড়িয়ে নিজেকে বাঁচাতে চায়! আর এ তো প্রেম! মনের খেলা মাত্র! রক্তের বাঁধনও নয়! সামাজিক বন্ধনও নয়! লিগ্যাল ডকুমেন্টে বিবাহও নয়! লিগ্যাল বিবাহেরই দাম নেই, নোটিশ দিয়ে তিন মাস ইদ্দত পালন করে...বিন্দাস হয়ে...নতুন মানুষ!
ওহ হো, এটা তো শুধু মুসলমান মেয়েদের জন্য! ছেলেদের তো চার বিবাহও বিচ্ছেদ ছাড়াই সম্ভব!
ভালোবাসা? না প্রেম? না অপ্রেমে জীবন!
শুধু নামেই ভালোবাসা?
আমি মানবিক প্রেমে বিশ্বাস করি, সমাজ সংসারের বাইরেও মানবিকতায় বিশ্বাস করি।
প্রেম, ভালোবাসা আমার কাছে ভীষণ কম্প্লিকেটেড!
নচিকেতার গান বরং সহজ, ‘কারও চোখ ভালো লাগে, কারও মুখ ভালো লাগে, কারও বা চরিত্রের গঠন!’
নামে কীই–বা যায় আসে...গোলাপ তার সুরভি ছড়িয়েই যায়!
কি দরকার তাকে ক্যাটাগোরাইজড করার?
আমারই হতে হবে? নয়তো জীবন বৃথা?
-জীবন ছোট, তবে এত ঠুনকোও নয়!
ভালোবাসায় আমার বিশ্বাস নেই!
*লেখক: শারমীন বানু আনাম, চিকিৎসক