ভালোবাসা
রফিক সাহেব বারান্দায় পায়চারি করছেন। কোনো কিছুই আজকাল ভালো লাগছে না। চারদিকে দুঃসংবাদ আর দুঃসংবাদ। দেশ বিদেশের কেউ আজ ভালো নেই। কেউ করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন কেউবা মারা যাচ্ছেন। আপনজন কেউ মারা গেলেও দেখতে পারছেন না বাসায় গিয়ে কিংবা মৃত ব্যক্তির জানাজায় শরিক হতে পারছেন না। কী এক কঠিন সময় পার করছে জগৎবাসী। অনেক দিন হলো তিনি অফিসে যান না। কাজের কোনো তাড়াহুড়ো নেই, নেই কোথাও দাওয়াত বা বেড়াতে যাওয়ার প্ল্যান। করোনাভাইরাসের কারণে দেশে লকডাউন চলছে। হাতে অফুরন্ত সময়। দেশের সবাই ঘরে বসে সময় কাটাচ্ছেন। কেউ কারও বাসায় যাচ্ছেন না, যদি রোগটি ছড়ায় এই ভয়ে। হতাশা আর ভয় কাজ করছে প্রতিটি মানুষের ভেতরে। তিনি সময়মতো পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন, বই পড়েন, বাসার ছাদে নিজ হাতে রোপণ করা কিছু গাছের পরিচর্যা করেন। তারপরও সময় কাটে না। বাসায় পেপারও আসে না। সারাজীবন ব্যস্ততায় কেটেছে আর করোনাভাইরাস যে ব্যস্ত জীবনটাকে এতটা অবসর দেবে, এতটা মলিন করে দেবে তা কি জানত এ পৃথিবীর মানুষ।
পাশের বাসায় নতুন ভাড়াটে এসেছে কয়েক দিন হলো। সাধারণত নতুন কোনো ভাড়াটে এলে আশপাশের সবারই কৌতূহল থাকে কারা এল ও বাসায়। কিন্তু করোনার কারণে রফিক সাহেব গৃহবন্দী বেশ কয়েক দিন থেকে, মসজিদেও যেতে পারেন না তাই ঘরেই নামাজ আদায় করেন। খোঁজখবর নিতে পারেন না আশপাশের কারও।
এখন ছাদেই বেশি সময় কাটান। বিকেলে ছাদ বাগানে পানি দিচ্ছিলেন হঠাৎ থমকে গেলেন পাশের ছাদে রূপবতী এক মেয়েকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। মেয়েটি লুকিয়ে লুকিয়ে যেন তাঁকে দেখছিল। তিনি তাকাতেই মেয়েটি যেন লজ্জা পেয়ে পালিয়ে গেল। তিনি ভেবে পাচ্ছিলেন না সে কে। তিনি আবারও গাছে পানি ঢালতে লাগলেন। কিছুক্ষণ পর যখন আবার পাশের ছাদের দিকে তাকাতেই দেখেন মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে আর মিষ্টি মিষ্টি করে হাসছে তাঁর দিকে চেয়ে। তিনিও মেয়েটির দিকে তাকিয়ে আছেন এমন সময় মেয়েটি প্রশ্ন করল, আপনার গাছের একটি ফুল আমাকে দেবেন?। তার প্রশ্ন শুনে তিনি খুব অবাক। সঙ্গে সঙ্গেই বললেন, অবশ্যই দেব তবে কয়েক দিন পর। এখনো ফুলগুলো ভালো হয়ে বড় হয়নি। মেয়েটি বলল, ঠিক আছে। এই বলেই সে চলে গেল। রফিক সাহেব আফসোস করছেন ইশ্ মেয়েটি আরও কিছু সময় থাকলে তো কিছু কথা বলা যেত তার সঙ্গে। বাসায় স্ত্রী ছাড়া আর কেউ নেই যে কারও সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গল্প বা আড্ডা দেবেন। আজকাল বড় বেশি গল্প বা আড্ডা মারার মানুষকে তিনি মিস করছেন।
পরের দিন আবার মেয়েটির সঙ্গে ছাদে দেখা হয়, কথা হয় অনেক, জানা হয় অনেক কিছু। খুব সুন্দর করে সে গুছিয়ে কথা বলে। ওর কথা শুনে তিনি তার কথার প্রেমে পড়ে গেলেন। আর হবেন না কেন, যে কেউ ওর কথার প্রেমে পড়তে বাধ্য। দিন যত যায় মেয়েটির সঙ্গে কথা বলতে বলে ভালো লাগা বা ভালোবাসার পরিমাণও বেড়ে যায় রফিক সাহেবের। করোনার বন্দী জীবন তাঁর কাছে অসহ্য লাগত কিন্তু মেয়েটির সঙ্গে পরিচয়ের পর থেকে বন্দী জীবনকে এখন উপভোগ করছেন। ছাদ বাগান আর মেয়েটির মিষ্টি মিষ্টি আলাপের মধ্য দিয়ে বন্দী জীবনকে এখন আর অসহ্য লাগছে না। এভাবেই আস্তে আস্তে দুজনের মাঝে সু-সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
রফিক সাহেব যখনই রুমের জানালায় দাঁড়ান দেখা যায় মেয়েটিকে তার ঘর থেকে। একদিন দেখা না হলে একজন আরেকজনের জন্য ছাদে অপেক্ষা করেন। মেয়েটির সঙ্গে পরিচয়ের পর থেকে তাঁর যেন অন্যরকম আনন্দময় লাগছিল সুন্দর এ পৃথিবীকে। একদিন মেয়েটিকে না দেখলে মনটা ছটফট করে। কোথায় যেন শূন্যতা অনুভব করতে শুরু করেন। শেষ কবে কার প্রেমে পড়েছেন তিনি মনে করার চেষ্টা করেন। ঘরে যখনই ভালো লাগে না তিনি বারান্দায় বা ছাদে যান। মেয়েটিও কীভাবে যে টের পেয়ে যায়, সেও আসে। অনেক সময় তো মেয়েটি অভিমান করে গাল ফুলিয়ে বলে, কই ছিলে সারা দিন ছাদে আসো নাই কেন। তার এ অভিমানী কথা শুনে রফিক সাহেব আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন। মনে মনে ভাবেন, কতটা প্রেম থাকলে এতটা অভিমানী হয় মানুষ। কতটা ভালোবাসা থাকলে কেউ কারও জন্য অপেক্ষা করে। আজকাল কেউ তো তাঁর জন্য অপেক্ষা করে না। মেয়েটির প্রতি তাঁর ভালোবাসা দিনে দিনে বাড়তে থাকে, অবসরের সঙ্গী হয়ে ওঠে সে।
রফিক সাহেবের আজকাল আর নিজেকে বন্দী ভাবেন না। বেশ ভালো মুডে দিন যাচ্ছে। ঘরে বসে বসে যখন সময় যায় না, ঠিক তখন নতুন এই অতিথিকে দেখলে কেন জানি অন্যরকম অনুভূতি হয়, পুলকিত হয় হৃদয়। যখনই মেয়েটির সঙ্গে দেখা হয়, চোখে চোখ রাখা হয় মিষ্টি করে হাসে সে। সেই ভুবন জুড়ানো হাসি। তার হাসি দেখে তিনিও এক ফালি হাসি উপহার দেন তাকে। ছাদ বাগানের পরিচর্যার পাশাপাশি মেয়েটির সঙ্গে গল্প আর আড্ডায় দিন কাটে। এভাবে দুজনের মাঝে ভাব হয়ে যায়।
রফিক সাহেবের শরীরটা আজ ভালো না। হালকা জ্বর অনুভব করছেন। বিছানায় শুয়ে শুয়ে ঘুম আসছে না, বিছানায় এ পাশ-ও পাশ করছেন। এক সময় বিছানা ছেড়ে বারান্দায় গেলেন। দেখেন মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে। রফিক সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, কী খবর তোমার। আজ হাসি নেই কেন মুখে? মেয়েটি কোনো উত্তর না দিয়ে ঘরে চলে যায়। রফিক সাহেব বুঝতে পারেন না মিষ্টি মেয়েটার কী হলো আজ। তিনি অনেক সময় বারান্দায় অপেক্ষা করলেন তার জন্য কিন্তু সে আর এল না।
দুই দিন তার সঙ্গে দেখা হয় না। ওদের বাসার জানালা বন্ধ। মিষ্টি মেয়েটি কই হারিয়ে গেল তিনি ভেবে পান না। মনে মনে অস্থিরতা অনুভব করেন আর অপেক্ষা করতে থাকেন। অবশেষে এক সপ্তাহ পরে মেয়েটিকে ছাদে দেখা গেল। রফিক সাহেব খুব খুশি মেয়েটিকে দেখে। তাঁর মনে হলো হারিয়ে যাওয়া কোনো রত্ন তিনি খুঁজে পেয়েছেন। মেয়েটিকে অনেক প্রশ্ন করলেন, কিন্তু সে উত্তর দেয় না। তার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। এক সময় ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে বলতে থাকে, দাদু ভাই আগামীকাল আমরা বাসা ছেড়ে চলে যাচ্ছি গ্রামের বাড়িতে। আপনার মতো সুন্দর আর ভালো মনের দাদু ভাইকে আমি আর দেখতে পাব না। খুব কষ্ট হচ্ছে, আমি খুব মিস করব আপনাকে...।
কথাটি শুনে রফিক সাহেব মুহূর্তে শূন্যতা অনুভব করেন, মেয়েটিকে বলেন কী বলো দাদু ভাই? তুমি বাসা ছেড়ে চলে গেলে আমার কী হবে? তিনি এক ফালি হাসি দিয়ে বলতে থাকেন, ‘তুমি আমাকে ছেড়ে গেলে আমি পৃথিবী ছেড়েই চলে যাব দাদু ভাই।’
সত্যি জীবনের টুকরো টুকরো ভালোবাসাগুলো মানুষকে অনেক সময় বেঁচে থাকার যেমন অনুপ্রেরণা জোগায় তেমনি মহা শূন্যেও ফেলে দেয়।
রফিক সাহেবের আজ খুব মন খারাপ। কবিতার এই লাইনগুলো তাঁর খুব মনে পড়ছে—
‘শুনছ মেয়ে?
একটা চিঠি ঘুরে বেড়ায় এই শহরে, ঠিকানা নেই
সেই চিঠিটার বুকের ভেতর জমেছে হাজার কষ্টের পাহাড়
বাতাস ভারী দীর্ঘশ্বাসে, কী যায় আসে।
শুনছ মেয়ে? এই শহরে একটা বুকে
তোমার নামে সকাল, দুপুর সন্ধ্যা নামে।’