ভালো থাকুন অন্য ভুবনে
আমার জীবনের গাঁটছড়া বাধা হয়েছিল যে ছেলেটি ‘মাধুকরী’ পড়েছিল তার সঙ্গে। সেই ছেলেটির সঙ্গে আমার দেখা হয়ে ওঠেনি তখনো। ফোন করেছিল দূরদেশ থেকে।
আমি তখন দেশে, সারাক্ষণ বুদ্ধদেব আমার সঙ্গে। আর এই আমাকেই যখন জিজ্ঞাসা করা হলো, আমি কি বুদ্ধদেব গুহর বই পড়েছি। ব্যস হয়ে গেল মধুর মিলন। আর কিছুই জানতে চাইনি।
আজ শুভ্র জানাল তোমার লেখক আর নেই। আমি চলে গেলাম সেই চিমনি দিয়ে ধোঁয়া ওঠা কোনো এক সাঁওতালি আবাসে। যেখানে মাদল বাজছে, পায়ে আংটা বাঁধা মোটা পায়ের গোছা নিয়ে মেয়েরা নাচছে। একটু পরেই আকাশে হেসে উঠবে পূর্ণিমা।
আমি ব্যক্তিগত ভাবে তাঁকে চিনি না। কিন্তু, তাঁর সব অনুভূতি আমার চেনা। তাঁর সব বেদনা আমার জানা। সব প্রেম আমার দেখা। কিশোরী বয়সে তাঁর সঙ্গে বুঁদ হয়ে ছিলাম। বনের ভেতরে বুনোফুলের যে ঘ্রাণ তা বনে না গিয়েও আমি পেয়েছি, অঙ্গে যে জ্যোৎস্নার মায়াবী আলোর আলোয়ান জড়ানো যায়, সেই আলোতে ভেসে থাকা যায়—তা আমি অনুভব করেছি বুদ্ধদেব গুহর বই পড়ে।
পাহাড়ি গ্রামীণ জনপদ ম্যাকলাস্কি গঞ্জ। শহর থেকে যাত্রী নিয়ে শেষ বাসটা বাজারে এসে নামিয়ে দিয়ে যায় ক্লান্ত, অবসন্ন যাত্রীদের। লাল ধুলো উড়িয়ে বাস চলে যায় আরেক গন্তব্যে। কিন্তু পেছনে ফেলে যায় শূন্যতা। কীভাবে সেই পাহাড়ের গায়ে গায়ে গভীর কালো অন্ধকার নামে, সেই যে অন্ধকারের ভেতরেও যে অপরূপ রূপ তা জেনেছি এই লেখকের বই পড়েই।
পাহাড়ি মেয়ে শাড়িতে ঢেউ তোলে জ্যোৎস্না সাঁতরে যায় দয়িতের সঙ্গে দেখা করতে। সেখানে তো মনে হয় আমিই ছিলাম। কোয়েলের কাছে সশরীরে যাওয়া হয়নি। দেখা হয়নি তার কাজল কালো জল। কিন্তু পেয়েছি কোয়েলকে আপন করেই। শুধু বইয়ের বর্ণনার বইঠা ধরেই।
একটু উষ্ণতার জন্যর ‘ছুটি’ যখন লেখকের গায়ের মাপ নিত উলের সোয়েটার বুনে দেবে বলে...সেই কিশোরী বেলায় আমার মনের গভীর গোপন কোণে এই রকম একটা অভিলাষ ছিল—আমিও খুব ভালোবেসে এই রকম গায়ের মাপ নিয়ে একটা সোয়েটার বুনব কারও জন্য।
‘সন্ধ্যার পরে’...জীবনের ছায়া যখন ঘন হয়ে আসে, সেই সময়েও তো ভালোবাসার ফুল ফুটতে পারে। আদতে ফুল ফোটার কি নির্দিষ্ট কোনো সীমারেখা আছে? আমরা তো তা দমিয়ে রাখি। ধনু ভাঙা পণ করেই রাখি ভালোবাসার রেণু যেন না লাগে গায়ে। ভালো লাগার প্রজাপতি যেন ওড়াউড়ি না করে আশপাশে। কিন্তু ‘সন্ধ্যার পরে’তে লেখক কী উদাত্ত আহ্বান করে মিলিয়ে দিয়েছিলেন ছেলের বিধবা মা আর ছেলে বউয়ের মামাকে যিনি ভাগনির বাসায় বেড়াতে এসেছিলেন। সব বয়সেই প্রেমের বয়স, যেন তাই লেখক প্রমাণ করলেন।
আমার সেজো ভাবি নাহরীন খুব কাঁচুমাচু হয়ে আমাদের আম্মা আর তাঁর শাশুড়ি মাকে জিজ্ঞেস করলেন, একটা বই দেব উনি পড়বেন কিনা। আর সেই বই হলো ‘সন্ধ্যার পরে’। আমার আম্মা হেন বই নাই যে পড়েন না। তিনি সানন্দে ছেলে বউয়ের কাছ থেকে নিয়ে বই পড়ে ফেললেন এবং হয়ে গেলেন প্রকৃতির এই লেখকের আর এক গুণমুগ্ধ পাঠক।
একবার চট্টগ্রাম থেকে বাসে ঢাকায় ফিরছি। তখন তিনটি ফেরি পার হতে হতো। হাতে ছিল ‘কোজাগরী’। মনে হয়েছিল ঢাকা কেন এত কাছে। আমার বন্ধু আলো কম কথার মানুষ। তার খুব রাগ ছিল আমার এই প্রিয় লেখকের ওপর। তিনি নাকি যেকোনো বিষয় লিখতে গিয়ে ফেনায় বেশি। আলো জানত, এই যে এত বিস্তারিত বর্ণনা (আলোর ভাষায় ফেনানো) সেটাই ছিল আমার ভালো লাগা।
হলুদ বসন্ত, চাঁন ঘরের গান, ভোরের আগে—সবই আমার ফেলে আসা সেই দিনগুলোকে একদম সামনে এনে বসিয়ে দেয় আজও। তিতলি, রুষা, কুর্চি, বাবলী আমাকেই ঘিরে থাকে সব সময়। দুঃখী পৃথু ঘোষের কথা মনে হয়। যে বলত, সুখী হওয়ার সহজ উপায় বিবেকহীন হওয়া। বিবেককে বিবশ করো। বিবেক বেঁচে থাক সুখ মরে যাক।
তাই কী হয়...বিবেক আর সুখ দুটোই তো দুটির পরিপূরক। বিবেকের সঙ্গে মিলেই হোক সুখের বীণ। লেখক চলে গেছেন অন্যলোকে। ভালো থাকুন উনি অন্য ভুবনে।
আমরা শুধু বলে যাব, তাঁরই বলে যাওয়া কথা—
‘সুখ নেইকো মনে
নাকছাবিটি হারিয়ে গেছে
হলুদ বনে বনে।’