ব্রুনেই যেভাবে করোনা মোকাবিলা করছে
জীবন অথবা জীবিকা, কোনটা আপনি বেছে নেবেন। শুনতে খারাপ লাগলেও বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে এটাই বাস্তবতা। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। এটা অনস্বীকার্য যে বাংলাদেশে জীবন-জীবিকার যেকোনো একটি বেছে নেওয়া খুবই কষ্টকর। কারণ অধিকাংশ মানুষই খেটে খাওয়া, দিন আনে দিন খায়। বর্তমান বাস্তবতায় দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার ছোট্ট দেশ কীভাবে কোভিড-১৯ মোকাবিলা করছে, সেটা সবাইকে জানানোর প্রয়োজন মনে করছি। যাতে এখান থেকে ভালো কিছু কেউ গ্রহণ করে কাজে লাগাতে পারেন। জীবিকার তাগিদে প্রবাসে থাকলেও মন পড়ে থাকে দেশে। আমার পর্যবেক্ষণ কোনো কাজে লাগলে নিজেকে ধন্য মনে করব।
ব্রুনেই দক্ষিণ এশিয়াতে মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ফিলিপাইন ও ইন্দোনেশিয়ার মাঝে দক্ষিণ চীন সাগরের ভেতর একটি ছোট দ্বীপরাষ্ট্র। আয়তনে ৫ হাজার ৭৬৫ কিলোমিটার, বাংলাদেশের একটি পুরাতন বড় জেলার সমান। জনসংখ্যা ৪ লাখ ৩৭ হাজার। বাংলাদেশের একটা থানার জনসংখ্যার সমান। ব্রুনেইপ্রবাসী বাংলাদেশি অবেদনবিদ হিসেবে এখানে কাজ করার সুবাদে করোনা পরিস্থিতি শুধু পর্যবেক্ষণই করছি না, করোনাযুদ্ধে সরাসরি অংশ নেওয়া একজন চিকিৎসকও বটে।
ব্রুনেইতে প্রথম করোনা রোগী শনাক্তের কথা জানানো হয় ৯ মার্চ। দিনপঞ্জিগুলো খেয়াল করবেন কবে, কখন, কী পদক্ষেপ নেওয়া হলো।
৯ মার্চে চারটি সরকারি হাসপাতালেরর ১৩৮ বেডের একটিতে করোনা পজিটিভ রোগী রাখার ব্যবস্থা করা হলো। তবে সবার আগে এ হাসপাতালসংলগ্ন ২৭ বেডের জাতীয় আইসোলেশন সেন্টার পরিপূর্ণ করা হলো যেখানে ৯ বেডের নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্র আছে। এই হাসপাতালটি রাজধানী থেকে ৪৫ কিলোমিটার দূরে। সেদিনই হাসপাতালগুলোতে রুটিন অপারেশন বন্ধ করে শুধু জরুরি, ক্যানসার, ট্রমা ও প্রসূতি রোগীদের অপারেশন চালু রাখা হলো। হাসপাতালের ইনডোর স্পোর্টস সেন্টারকে স্ক্রিনিং সেন্টার হিসেবে ঘোষণা করা হলো, যেটার সাজসজ্জার কাজ সপ্তাহখানেক আগে থেকেই চলছিল। বলে রাখা ভালো, এসব পরিকল্পনা জানুয়ারি থেকেই নেওয়া হয়েছিল। স্বাস্থ্যকর্মীদের পিপিইর ব্যাপারে জ্ঞানদান, পরিধান-খোলার ব্যাপারে প্রশিক্ষণ এবং ফেস মাস্ক ফিটিং টেস্ট আগেই শেষ হয়েছে। আমি নিজে এ প্রশিক্ষণ নিয়েছি প্রথম রোগী শনাক্তের এক মাস আগে। প্রশিক্ষণের ফলে পিপিই নিয়ে ধূম্রজাল সবার মধ্য থেকে দূর হয়। সবাই জানে কার কতটুকু পিপিই ব্যবহার করতে হবে। পিপিইর কোনো অপব্যবহার এখানে হচ্ছে না। সারা পৃথিবীতে এখন পিপিইর অভাব। এটা যে ব্যক্তিগত সংগ্রহের বিষয় নয় বরং প্রাতিষ্ঠানিক সংগ্রহের ব্যাপার, এটা এখানে সবাই জানে। সুতরাং দেশ-মহাদেশ ভেদে পিপিইর যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা সবারই নৈতিক দায়িত্ব।
১০ মার্চ থেকে দেশের অন্যান্য বহির্বিভাগভিত্তিক কেন্দ্রগুলোর কয়েকটা স্ক্রিনিং সেন্টার করা হলো। কিছু কেন্দ্র রাখা হলো সাধারণ রোগীদের দেখার জন্য। দৈনন্দিন কাজগুলো সীমিত করে দেওয়াতে কিছু জনবল স্ক্রিনিং সেন্টারে এবং পজিটিভ রোগী রাখার হাসপাতালটিতে দেওয়া সম্ভব হয়েছে। রোগী যখন বাড়া শুরু হলো তখন আরও দুটি হাসপাতালে কিছু ওয়ার্ড ফাঁকা করে রাখা হয়েছে। ইতিমধ্যে জাতীয় আইসোলেশন কেন্দ্রের পাশে ১০ বেডের নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রসহ ১৭০ বেডের আরেকটি আইসোলেশন কেন্দ্র নির্মাণের কাজ হাতে নেওয়া হয়েছে, যার সমাপ্তি ধরা হয়েছে তিন সপ্তাহ। এ কেন্দ্রের বিছানা ও ভেন্টিলেটর চীন থেকে আসার পথে।
এ তো গেল চিকিৎসাবিষয়ক তথ্য। এবার আসি বিধিনিষেধের দিনপঞ্জিতে। রোগী শনাক্তের প্রথম দিনেই সরকারি চাকরিজীবীদের চাকরি অত্যাবশ্যক ঘোষণা করে অনির্দিষ্টকালের জন্য সব ছুটি বাতিল করা হয়েছে। একই দিনে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছুটির ঘোষণা আসে। ১৩ মার্চ ঘোষণা আসে বিয়ে, খেলাধুলাসহ সব ধরনের সামাজিক অনুষ্ঠানাদি বন্ধের। ১৫ মার্চ এখানকার নাগরিকসহ বসবাসরত সবার দেশ ত্যাগের ওপর নিষেধাজ্ঞা। স্থলপথ বন্ধ করে দেওয়া হয়, আকাশপথ সীমিত করা হয়। জরুরি কোনো কাজ যেমন বিদেশে আদালতের সমন, জরুরি কোনো বৈদেশিক চিকিৎসা ইত্যাদির জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একটা ই–মেইল ঠিকানা দিয়ে বলা হয়, স্বল্পতম সময়ে উত্তর পাওয়া যাবে। আমি এ ধরনের একটা ই–মেইলের জবাব ৭ ঘণ্টার ভেতর পাওয়ার প্রমাণ পেয়েছি। ১৬ মার্চ সব মসজিদ এবং উপাসনালয় এক সপ্তাহের জন্য বন্ধের ঘোষণা আসে, যেটা এখনো বলবৎ রয়েছে। ১৮ মার্চ সব রেস্তোরাঁতে বসে খাওয়া বন্ধ করা হয়, তবে খাবার বাসায় নিয়ে যাওয়া যাবে। রেস্তোরাঁগুলো হোম ডেলিভারি দিয়ে যাচ্ছে। ২১ মার্চ সব ধরনের নিয়োগ এবং ভিজিট ভিসা স্থগিত করা হয়।
এখানে কখনোই লকডাউন করা হয়নি, তবে সামাজিক দূরত্বের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে এবং মানুষ সেটা মানছে। মল, সিনেমা, জিম, গ্রুপে চলাফেরা, সামাজিক অনুষ্ঠানাদি, জনাকীর্ণ এলাকা, বাসায় অতিথি—এগুলো থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে। সাবধানতা অবলম্বন করতে বলা হয়েছে রেস্তোরাঁ বা মুদিদোকানে কেনাকাটার সময়, ব্যাংক-পোস্ট অফিস, ইউটিলিটি সার্ভিসের অফিসগুলোতে পরিদর্শনের সময়। নিশ্চিন্তে করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে হাঁটাহাঁটি, দৌড়ানো, বাগানে কাজ করা, বাগানে খেলাধুলা করা, বই পড়া, গান শোনা, বাসায় বসে সিনেমা দেখা ইত্যাদি।
কুয়ালালামপুরের এক তাবলিগ থেকে ব্রুনেইয়ে করোনার বিস্তার হয়। এই তাবলিগ দল এখানে ফেরার পর তারা এখানে প্রায় ১০০ লোকের আরেক তাবলিগ করে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এদের সবাইকে শনাক্ত করে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে পাঠায়। সবার টেস্ট করে। প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনের জন্য এখানকার সব হোটেলকে বেছে নেওয়া হয়। ভাড়া রোগীরাই বহন করবে। সে ক্ষেত্রে সরকার একটা গ্রহণযোগ্য ভাড়া নির্ধারণ করেছে। পাঁচ তারকা যে হোটেলের ভাড়া ৪–৫ শ ডলার, সেটা নির্ধারণ করে ১ শ, যেটার ভাড়া ২–৩ শ, সেটা ৫০ ডলারে নির্ধারণ করে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তদারকি করেছে ঠিকমতো কোয়ারেন্টিন হচ্ছে কি না। উল্লেখ্য, ব্রুনেইর স্বাস্থ্যমন্ত্রী একজন ডাক্তার এবং মন্ত্রণালয়ের প্রথম তিনজন কর্তাব্যক্তির মধ্যে একজন চিকিৎসক। স্বাস্থ্যমন্ত্রী প্রতিদিন সন্ধ্যায় সরাসরি সম্প্রচারিত সংবাদ সম্মেলনে আসেন, সঙ্গে কোনো না কোনো মন্ত্রী থাকেন, তাঁর মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত জানানোর জন্য। তাতে কোনো ব্যাপারেই নাগরিকদের কোনো সংশয় থাকে না।
খুলনার ব্যবস্থাপনা আমার ভালো লেগেছে। সেখানে বিএমএ এবং প্রশাসনের উদ্যোগে স্ক্রিনিং সেন্টার করা হয়েছে দুটি হাসপাতালে। সন্দেহজনক কোনো রোগী পাওয়া গেলে তারা যাবে দুটি হোটেলে। পজিটিভ রোগী পাওয়া গেলে তারা যাবে আইসোলেশন সেন্টারে, যেটা একটি হাসপাতাল। থানা পর্যায় থেকে চিকিৎসক, নার্স আনা হয়েছে এসব কেন্দ্রে ডিউটি করার জন্য। তাঁরা থাকবেন আরেকটি হোটেলে। ঢাকাসহ বাকি জেলাগুলোতে খুলনা মডেল চালুর ব্যাপারে ভাবা যায়।
আমরা প্রবাসীরা দেশ নিয়ে উদ্বিগ্ন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, এপ্রিল মাস আমাদের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। তিনি ঠিকই বলেছেন। সমালোচনা করার জন্য এ লেখা নয়। আপনারাই নিজেদের সমালোচনা করুন। কোনটা কখন করা উচিত ছিল, সেটা নিয়ে বিতর্ক না করে এখনো সময় আছে কোনটা এখনো করা যায়, সেটা ভাবার। মনে রাখতে হবে, আমাদের হাতে সময় কিন্তু বেশি নেই।
লেখক: ব্রনেইতে কর্মরত প্রবাসী চিকিৎসক