ব্রিসবেনে বাঙালি ও বাংলার মেলা
এটা আমার সৌভাগ্যই বলা যায়। গত ২৫ বছরের প্রবাসজীবনে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের অনেকগুলো শহরে বাঙালি কমিউনিটির উদ্যোগে বাংলা নববর্ষ পালন করা ও বৈশাখী মেলা দেখার সুযোগ হয়েছিল। সম্প্রতি আমরা বৈশাখী মেলা দেখতে ব্রিসবেন গিয়েছিলাম। কোভিড রেস্ট্রিকশনের কারণে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন ব্রিসবেন (বিএবি) এপ্রিল মাসের স্থলে একটু দেরি করে ২২ মে করেছে। গোল্ড কোস্ট থেকে ব্রিসবেন অনেকটা কাছের শহর হলেও এবারই প্রথম ব্রিসবেনের বৈশাখী মেলা দেখতে যাই। প্রবাসজীবনে সময় বের করা একটা বড় বিষয়। বেশির ভাগ সময় ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও অনেক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে পারছি না। স্বামী-স্ত্রী দুজন চাকরি করলে তো কোনো কথাই নেই। এমনকি আমি একসময় ব্রিসবেনে থেকেও মেলায় অংশগ্রহণ করতে পারিনি।
এবার ব্রিসবেনের বৈশাখী মেলায় যাওয়ার আরও আগ্রহ বাড়িয়ে দিয়েছিলেন কবি ও কথাসাহিত্যিক দীলতাজ রহমান। তিনি আমাদের কুইন্সল্যান্ড তথা ব্রিসবেন ও গোল্ড কোস্টে আমরা যে কয়জন লেখালেখি করি তাঁদের মিলনমেলা বসাতে চেয়েছিলেন মেলা চত্বরে। সেটারও একটা বড় আকর্ষণ ছিল আমার। যদিও অনেকের ব্যস্ততার কারণে ও আগ্রহের অভাবে লেখকদের মিলনমেলা তেমন জমেনি। তারপরও আমি, কথাসাহিত্যিক মোস্তাফিজুর রহমান টিটু, কথাসাহিত্যিক ড. এম আল মামুন ও তরুণ লেখক সাইফুল সোহেল দিঘল মাঠে সবুজ ঘাসের ওপর চেয়ার পেতে দীলতাজ আপাকে কেন্দ্র করে পড়ন্ত বিকেলের অনেকটা সময়ই কাটিয়েছি।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন ব্রিসবেন আয়োজিত বৈশাখী মেলাটা অবশ্য বেশ জমেছিল। মেলায় কুইন্সল্যান্ডের বিভিন্ন শহর থেকে আসা শুধু অসংখ্য বাঙালিদের উপস্থিতিই নন, অস্ট্রেলিয়ার ফেডারেল এমপি-সিনেটর, কুইন্সল্যান্ড স্টেটের স্টেট এমপি, লগান শহরের ডেপুটি মেয়র, ব্রিসবেন ও ইপ্সওইশ শহরের মেয়রের প্রতিনিধি, কয়েকজন কাউন্সিলর, বিভিন্ন রিজিওনাল ডিরেক্টর, পুলিশ কমিশনার ও বিভিন্ন কমিউনিটির সভাপতিদের স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতি বৈশাখী মেলাকে আরও তাৎপর্য করে তুলেছিল। সবচেয়ে সৌন্দর্যময় ছিল মেলার প্রান্তর ও বিভিন্ন পসরা নিয়ে বসা সারি সারি দোকান।
লাল পাড়ের সাদা শাড়ি পরা আমাদের বধূদের মনে হচ্ছিল অসংখ্য ফুটে থাকা সাদা গোলাপ বা অনেকটা দূর থেকে দেখা সবুজ ঘাসের ওপর বিছিয়ে থাকা সাদা ঘাসফুল।
কী হয়নি মেলায়! বাচ্চাদের নাচ, যেমন খুশি তেমন সাজো, নাটক এবং একক ও যৌথ গান। অনুষ্ঠানের শুরুর দিকে আদিবাসী যুবকের বাজানো বাঁশির মূর্ছনা! আহা! বড়দের অনুষ্ঠান শুরু হয়েছিল স্থানীয় শিল্পীদের একক ও যৌথ গান দিয়ে। কী অসাধারণ গলা তাঁদের, সুরের কী দারুণ কারুকাজ! ওদের গ্রামবাংলার পল্লিগীতি, বৈষ্ণবী ও ভাটিয়ালি গান আমাদের মাত করে রেখেছিল।
সত্যি বলতে মেলা প্রান্তরে দাঁড়িয়ে আমার কেন জানি ছোটবেলায় ফিরে যেতে ইচ্ছা করছিল। ছোটবেলায় আমাদের সেই বৈশাখী মেলা। ২৫ পয়সার ভেঁপু বাঁশি, ৩০ পয়সার বাঁশের বাঁশি, ৫০ পয়সার মাটির ঘোড়া বা এক টাকার একটা ছোট্ট ঢোলক। ১০ পয়সায় একটা ঝুনঝুনি কিনতাম। ৪০ পয়সার বেলের শরবত। মেলায় ২৫ পয়সার সকাল-বিকেল আইসক্রিমটা ছিল আমাদের খুব পছন্দের। আসলে সেটা আইসক্রিম ছিল না, ছিল লাল-সাদায় দুই রঙের আইস ব্লক। মনে পড়ে, একবার আমার মা মেলা থেকে আইসক্রিম কিনে খাওয়ার জন্য আমাদের দুই ভাইকে এক টাকার একটা নোট আলাদা করে দিয়েছিলেন। সেই হরিণের মাথা মার্কা নোট। শুধু মেলায় আইসক্রিম কিনে খাওয়ার জন্য মা কখনো আলাদা করে এক টাকা দিতেন না। আমরা পয়সা বাঁচিয়ে আইসক্রিম খেতাম। কিন্তু সেবার মা আলাদা করে আইসক্রিম খাওয়ার জন্য এক টাকা দেওয়ায় আমার পিঠাপিঠি ভাই এটন ও আমি সে কী খুশিতে আটখানা।
পুনোয়ারার বৈশাখী মেলায় গিয়ে আমরা সিদ্ধান্ত নিই, আলাদা করে পঞ্চাশ পয়সা দামের প্যাকেটের আইসক্রিম না খেয়ে দুই ভাই মিলে এক টাকা দিয়ে একটা প্যাকেটের মালাই আইসক্রিম খাব...। কিন্তু খেতে গিয়ে একটা বিপত্তি ঘটে, কে আগে খাবে এবং কে পরে খাবে? পরে সমঝোতায় আসি, আমরা দুজন আইসক্রিমটা পালাক্রমে খাব। প্রতিবার খাওয়ার পর হাত বদল হবে। আইসক্রিমটা শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমরা তাই করি। তখন আমাদের বয়স কত ছিল? আট কি নয়। সেই আশির দশকের প্রথম দিকের ঘটনা।
আমাদের বাল্যকালের এই ছোট্ট স্মৃতিটুকু এ জন্যই লিখলাম যে বছর দুই আগে বাংলাদেশে গিয়ে পয়লা বৈশাখের কিছু ঘটনা দেখে আমার মনে খুব আক্ষেপ জন্মেছিল। গ্রামে বা শহরে মানুষজনের বাংলা নববর্ষ পালনের যে কী ছিরি দেখেছিলাম! ঢাকাকেন্দ্রিক মঙ্গল শোভাযাত্রা, রমনার মেলা, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির মোড়ে পান্তা ভাত, কাঁচা মরিচ বা ইলিশ মাছ ভাজা, এসব না হয় ঠিক আছে। ঢাকা শহরটাকেও রংবেরঙে সাজানো হয়। সেটা তো নাগরিক জীবনের বাংলা নববর্ষ। কিন্তু গ্রামেগঞ্জে বা ছোট্ট শহরগুলোতে সেই বাংলা নববর্ষ কোথায়? আমাদের সেই গ্রাম, যেখানে বৈশাখ মাসের প্রথম এক-দুই সপ্তাহ মুখর হয়ে থাকত আমাদের ভেঁপু বাঁশি, বাঁশের বাঁশি বা ঝুনঝুনির শব্দে। সারাক্ষণ ছোট্ট ঢোলকের শব্দ হতো- টাক-ডুমা-ডুম-টাক-টাক, টাক-ডুমা-ডুম-টাক। সেই যোগেশ বা নরেশ পোদ্দারের মুদিদোকানের হালখাতা, পিরিজভর্তি জিলাপি-রসগোল্লা...। বদির স্যারের সেই আদর্শ বাণী, বছরের প্রথম দিন মিথ্যা কথা বললে কিন্তু সারা বছর শুধু মিথ্যা বলা হবে...। আমরা সারাটা দিন চেষ্টা করতাম আদর্শ ছেলে হয়ে থাকতে। এমনও হয়েছে, সারা দিন আমাদের অশীতিপর বৃদ্ধ অদন দাদার পাশে বসে ভালো থাকার জন্য তসবি জপতাম।
দীর্ঘদিন পর সেবার আমাদের গ্রামে গিয়ে বাংলা নববর্ষের সময়টায় একবারের জন্য তো একটা বাঁশির শব্দ বা ছোট্ট ঢোলকের শব্দ শুনিনি। আমাদের সেই পুনোয়ারার মেলা আজ আর বসে কি না, জানি না। গোমতীর আইল ধরে বহুদূর হেঁটে গিয়েও কারও মুখে শুনিনি, শুভ নববর্ষ। কিংবা বদির স্যারের মতো কোনো শিক্ষক এসে ৮-১০ বছরের কোনো বালককে বলতে শুনিনি, ‘...শোন, আজ কিন্তু বাংলা নববর্ষ। কোনো মিথ্যা কথা বলবি না। সৎকাজ করবি। কারও গাছের ফল চুরি করবি না...!’ তাহলে আমাদের গ্রামগুলো থেকে কি সেই শিল্প-সংস্কৃতি উঠে গেছে? সেই বৈশাখী মেলার ঐতিহ্য?- জানি না, হয়তো। হয়তো বলছি এ জন্য যে, আমার এবং আমার ছোট ভাইয়ের মালাই আইসক্রিম খাওয়ার গল্পটা মাত্রই তো চার দশক আগের ঘটনা। আমি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারি, আজকাল বাংলাদেশের কোনো গ্রামের ৮-১০ বছরের কোনো বালকের মুখ থেকে এমন করে মালাই আইসক্রিম খাওয়ার গল্প বের হবে না। আমরা যে কোনো গরিব ঘরের সন্তান ছিলাম, তা নয়। বরং আমরা গ্রামে কাজী বাড়ির সম্ভ্রান্ত মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তানই ছিলাম। আশির দশকের শুরুতে যখন পুরো মুরাদনগর উপজেলায় দুটি কি তিনটি টেলিভিশন ছিল, তখন আমাদের ঘরে ২৯ ইঞ্চি ফিলিপ্স সাদা–কালো টেলিভিশন ছিল। এটা কোনো গল্প নয়। কিন্তু আমাদের কালে বাবা-মা আমাদের জন্য মেলায় আইসক্রিম খাওয়ার জন্য এক টাকাই বরাদ্দ রাখতেন।
আমি আগেই বলেছি, আমি আড়াই দশক ধরে নিউজিল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়াতে বসবাস করছি। কিন্তু এখানে তো ওদের সেই শিল্প, সংস্কৃতি বা ঐতিহ্যের এমন দ্রুত পরিবর্তন দেখিনি? বলা যায়, ওদের শিল্প, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য একরকম অপরিবর্তিতই থেকে গেছে। কিন্তু আমাদের দেশে এসবের এত দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে কেন? এটা কিসের লক্ষণ? বাংলাদেশে গিয়ে যখন দেখি, গ্রামের ৮-১০ বছরের ছেলেরা ব্রাশ জিনস পরে, হাতে দামি চ্যাপ্টা স্মার্টফোন ব্যবহার করে, তখন ব্যাপারটা অপরিচিত মনে হয়। হয়তো বলবেন, যুগ পাল্টাচ্ছে। টেকনোলজির যুগ। কিন্তু অস্ট্রেলিয়া বা নিউজিল্যান্ডে কি টেকনোলজির যুগ আসেনি? এখানে কেন সেই পরিবর্তন চোখে পড়ে না? আচ্ছা, না হয় মানলাম যে টেকনোলজির যুগ। কিন্তু এটা কি কষ্টের ব্যাপার নয় যে গ্রামের সেই ৮-১০ বছরের ছেলেরা বাংলা নববর্ষের দিন কোথায় মেলায় যাবে, তা নয়। ওরা ব্রাশ জিনস পরে গোমতীর আইল ধরে চ্যাপ্টা মোবাইলে উচ্চ ভলিয়মে হালনাগাদ হিন্দি গান বাজাতে বাজাতে যায়, ‘বাম চিকি চিকি বাম বাম, চিকি বাম বাম...!’ অথবা ‘খিচ মেরা ফটো তো, খিচ মেরা ফটো তো, খিচ মেরা ফটো, পিয়ায়...’! বাংলা নববর্ষে আমাদের সেই গ্রামের একজন ৮-১০ বছরের ছেলের কাছ থেকে এসব গান শুনতে দেখে সত্যি শঙ্কিত না হয়ে পারি না।
লেখাটা শুরু করেছিলাম বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশনের ব্রিসবেনের উদ্যোগে আমাদের বৈশাখী মেলা নিয়ে। এক অঙ্কের নাটক, বাঙালি ঢঙে লুঙ্গি-গামছা পরে ফ্যাশন শো ও নাচ-গান। বড়দের কাব্যনাটক। বিভিন্ন শিল্পীদের যৌথ ও একক গান। বাংলা সিনেমার গানের তালে তালে কপোত-কপোতিদের নাচ। ডিজে গানের তালে তালে কখন যে পাঁচ-ছয় ঘণ্টা চলে গিয়েছিল, টেরই পাইনি। রাত ১০টার দিকে যখন অসংখ্য আতশবাজি ফুটিয়ে অনুষ্ঠান শেষ করা হয়, তখন মনে হয়েছিল আহা, অনুষ্ঠান এত তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেল!
*লেখক: মহিবুল আলম, গোল্ড কোস্ট, কুইন্সল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া