ব্রিটিশ কলাম্বিয়াতে গরম কমলেও বাড়ছে বনের আগুন
ব্রিটিশ কলাম্বিয়া প্রভিন্সের বাড়িগুলো মূলত শীতের কথা মাথায় রেখে তৈরি করা করা হয়। অধিকাংশ বাড়িতে এয়ার কন্ডিশন নেই, এমনকি অনেক বাড়িতে ফ্যানের ব্যবস্থাও নেই। এ ধরনের গরমে তারা অভ্যস্ত না থাকায় প্রায় ৪০০ মানুষ মারা গেছে। ফলে, মানুষ একরকম নিরুপায় হয়ে প্রচণ্ড গরমে দিন পার করছে।
শীতের দেশ কানাডায় এ বছর হানা দিয়েছে গরম এবং আগুন। সম্প্রতি ব্রিটিশ কলাম্বিয়া লিটন নামের একটি শহরে এ বছর দেশটির ইতিহাসে সর্বকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪৯ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়। এ ধরনের তাপমাত্রা কানাডার ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার মানুষ কোনো দিন দেখেনি। প্রাকৃতিকভাবে ১ জুলাইয়ের পর এ তাপমাত্রার কিছুটা কমলেও ওই সব এলাকার বিভিন্ন বনাঞ্চলে বাড়ছে দাবানল।
হঠাৎ বজ্রপাতের কারণে ‘লিটন’ এলাকায় আগুনের সূত্রপাত হলে আগুন এখন ছড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন জায়গায়। প্রতিদিন বেড়ে চলছে এ দাবানল। এর ভয়াবহতা এত যে স্থানীয় অগ্নিনির্বাপক বিভাগ তা নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না। কিছু কিছু জায়গায় আগুন নেভাতে ব্যর্থ হয়ে প্রকৃতির ওপর ভরসা করে আছে মানুষ ও সরকার। অর্থাৎ বৃষ্টি হলে বা একসময় আগুন জ্বলতে জ্বলতে নিভে যাবে।
৩ জুলাই রাত পর্যন্ত (রিপোর্ট লেখার সময়ে) মোট ১৭৪টি জায়গার বনে আগুন জ্বলছে। এর মধ্যে গত দুদিনেই নতুন করে আগুন লেগেছে ৭৮টি জায়গায়। এর মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় আছে ডুরান্ড লেক, ক্যানিম লেক, ডেকা লেক, লোগান লেক, লোন লেক, কম লুপ ও কারিবু এলাকা।
প্রাথমিকভাবে দুজনের মৃত্যুর খবর জানানো হলেও এরপর আর কোনো মৃত্যুর খবর জানা যায়নি। দাবানল শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দাবানল এলাকার ৫০ থেকে ৬০ কিলোমিটার রেঞ্জে বসবাস করা মানুষকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। সবাইকে সেল ফোনের অ্যালার্ট নোটিশ দেওয়া হয়েছে। এ প্রভিন্সে যাদের নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নেওয়া হয়েছে, তাদের বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্র ও হোটেলে সরকারি খরচে রাখা এবং খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার প্রতিরক্ষামন্ত্রী হরজিৎ সাজন জানান, ফেডারেল সরকার এডমন্টনে একটি একটি সামরিক ঘাঁটি থেকে আগুন নির্বাপণের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। একটি হারকিউলিস বিমান এবং দুটি চিনুক হেলিকপ্টারের পাশাপাশি ৩৫০ জন সেনাসদস্য কাজ করছেন। এই বাহিনীতে আজকালের মধ্যে আরও সেনাসদস্য যোগ দেবেন বলে জানা গেছে।
কানাডাজুড়ে প্রায় ২৫ থেকে ৩০ লাখ বর্গকিলোমিটার বনাঞ্চল। এই বনগুলোর অনেক জায়গায় প্রায় প্রতিবছর সামারে আগুন লেগে থাকে। মানুষের অসাবধানতার কারণে কিছু আগুন লাগলেও মূলত প্রাকৃতিক কারণে এ আগুন লেগে থাকে। স্প্রিং সিজনের পর যখন সামার শুরু হয়, তখন তীব্র বাতাসের গতি, কম আর্দ্রতা এবং অধিক তাপমাত্রার কারণে পাতার ঘর্ষণে এ আগুনের সৃষ্টি হয়। ব্রিটিশ কলাম্বিয়া ছাড়াও তিনটি প্রেইরি প্রভিন্স আলবার্টা, সাস্কাচুয়ান ও ম্যানিটোবাটে আগুন লেগে থাকে। মূলত, আগুন লাগার সম্ভাব্য তাপমাত্রা ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস, ৩০ কিলোমিটার বাতাসের গতি এবং বাতাসে আর্দ্রতার পরিমাণ ৩০ ভাগের কম থাকলেই আগুন লাগার সম্ভাবনা থেকে যায়।
ব্রিটিশ কলাম্বিয়া প্রভিন্স থেকে কথা হয় সেখানকার দুই বাংলাদেশি মীর রাকিব আহসান ও কামরুল এইচ মিথুনের সঙ্গে। তাঁরা জানান, এখন পর্যন্ত প্রচণ্ড গরম ও দাবানলের কারণে কোনো বাংলাদেশির হতাহত হওয়ার খবর তাঁরা পাননি। তাঁরা আরও জানান, এখানকার বাড়িগুলো মূলত শীতের কথা মাথায় রেখে তৈরি করা করা হয়। অধিকাংশ বাড়িতে এয়ার কন্ডিশন নেই, এমনকি অনেক বাড়িতে ফ্যানের ব্যবস্থাও নেই। এ ধরনের গরমে তারা অভ্যস্ত না থাকায় প্রায় ৪০০ মানুষ মারা গেছে। এখানকার দোকানগুলোয় এসি ও ফ্যানের যে সরবরাহ ছিল, গরম শুরু হওয়ার দুদিনের মধ্যেই শেষ হয়ে গিয়েছে। ফলে, মানুষ একরকম নিরুপায় হয়ে প্রচণ্ড গরমে দিন পার করছে।
কানাডার ম্যানিটোবা কনজারভেশন অ্যান্ড ক্লাইমেটে কর্মরত এয়ার কোয়ালিটি স্পেশালিস্ট মুনতাসীর ইবনে আযকার জানান, ফরেস্ট ফায়ারের অন্যতম ক্ষতিকর দিক হচ্ছে বায়ুদূষণ। কানাডায় বায়ুদূষণের প্রাকৃতিক কারণগুলোর মধ্যে ফরেস্ট ফায়ার অন্যতম। ফরেস্ট ফায়ারের কারণে যে ধোঁয়া বা স্মোকের সৃষ্টি হয়, সেই ধোঁয়ার মধ্যে মানুষের স্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর বিভিন্ন বায়ুদূষক থাকে। এসব দূষকের মধ্যে সালফার ডাই–অক্সাইড, নাইট্রোজেন ডাই–অক্সাইড, কার্বন মনক্সাইড, ভোলাটাইল অরগানিক কমপাউন্ডস, পার্টিকিউলেট ম্যাটার ইত্যাদি অন্যতম। ফরেস্ট ফায়ার স্মোক উৎপত্তি স্থল থেকে শত শত কিলোমিটার দূর পর্যন্ত ট্রাভেল করতে পারে। এর ফলে ফরেস্ট ফায়ার উদ্ভূত এসব ক্ষতিকর বায়ুদূষক অনেক সময়ই কানাডার বিভিন্ন শহরের বায়ুর মানের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। তিনি আরও জানান, ফরেস্ট ফায়ারের একই সঙ্গে উপকারী–অপকারী দুই দিকই আছে। ফরেস্ট ফায়ারের কারণে আশপাশের মানুষের বসতি হুমকির সম্মুখীন হয়, অনেক মানুষ মারাও যায়। মূল্যবান বনসম্পদের ধ্বংস হয়, বন্য প্রাণীর আবাসস্থলও হুমকির সম্মুখীন হয়। অন্যদিকে, ফরেস্ট ফায়ার ফরেস্ট ইকোসিস্টেমের একটা প্রাকৃতিক ঘটনা, যার মাধ্যমে প্রাকৃতিকভাবে কোনো ফরেস্ট অঞ্চলের স্বাস্থ্য ও জীববৈচিত্র্য নিশ্চিত হয়। ফরেস্ট ফায়ারের কারণে বনভূমিতে সংরক্ষিত বিভিন্ন ধরনের নিউট্রিয়েন্ট উন্মুক্ত হয়ে পড়ে, যা পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন অর্থকরী গাছের বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়। নতুন নতুন ফরেস্টের বৃদ্ধিতে ফরেস্ট ফায়ারের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে।