ব্যাংক লাইফ

২০০৩ সাল। গ্র্যাজুয়েশনের পর চাকরির জন্য বিভিন্ন ব্যাংকে আবেদন করা শুরু করল নিশাত। অনলাইনে আবেদন করার সিস্টেম তখনো পুরোপুরি চালু হয়নি। নিশাত তাদের বাসার আশপাশে কয়েকটা ব্যাংকে ফোন করে দেখল যে তারা লোক নেবে কিনা। একটা ব্যাংক জানাল, তারা লোক নেবে। সেখানে গিয়ে একটা ফরম ফিলাপ করতে হবে। ফরম ফিলাপ করে জমা দেওয়ার কয়েক দিন পরে তারা নিশাতকে ফোন করে জানায়, একটা অ্যান্ট্রি পরীক্ষা দিতে হবে। নিশাত পরীক্ষা দিয়ে আসল। পরীক্ষা দিয়ে আসার দুদিন পরে তারা ব্যাংক থেকে নিশাতকে জানানো হলো যে, সে পাস করেছে। এবার নিশাতের ইন্টারভিউ নিয়ে চায়।
নির্দিষ্ট দিনে ইন্টারভিউ দিতে গেল নিশাত। বোর্ডে ছিল ব্যাংক ম্যানেজার ডায়ানা ও অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার ন্যান্সি। এর কিছুদিন পরেই নিশাতের চাকরিটা হয়ে যায়। নিশাত তো খুশিতে আত্মহারা। চাকরি শুরু করার আগে কিছু নতুন জামা কাপড় আর কসমেটিকস কিনে নিল। শুরু করার আগে তাকে ব্যাংক থেকে দুই সপ্তাহের একটা ট্রেনিং দেওয়া হয়। সেই ট্রেনিংয়ে পুরোপুরি শেখানো হয় ব্যাংকের সব ধরনের নিয়ম কানুন। দুই সপ্তাহের ট্রেনিং শেষে নিশাতকে বাসা থেকে এক ঘণ্টা ড্রাইভ করে ব্যাংকের হেড কোয়ার্টারে যেতে হয়েছে। সেখানে ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিতে হয়েছে। যেহেতু ব্যাংকে চাকরি করলে অনেক টাকা-পয়সা নিয়ে লেনদেন করতে হবে। তারা ফিঙ্গারপ্রিন্ট নিয়ে একটা ব্যাকগ্রাউন্ড চেক করে, ছবি তোলে। নিশাতকে ব্যাংকের স্টাফ আইডি দেওয়া হয়।
নির্দিষ্ট দিনে নিশাত ব্যাংকে চাকরি শুরু করে। শুরু হয়ে যায় নিশাতের কর্মজীবনের ব্যস্ততা। সেই সময় নিশাতের বড় মেয়ে নিমার বয়স ছয়। ক্লাস ওয়ানের পরে। আর ছোট মেয়ে ইমার বয়স তিন। ও ডে কেয়ারে যায়। তাদের সেই শহরে একই ব্যাংকের আরও কয়েকটা শাখা ছিল। নিশাত ব্যাংকের যে শাখাতে চাকরি করে, সেটা ছিল ছোট ও নিরিবিলি।
নিশাতের বাসা থেকে ব্যাংকে যেতে আধা ঘণ্টা সময় লাগত। ব্যাংক খুলতে হতো সকাল আটটায়। ১৫ মিনিট আগে অফিসে যেতে হতো। নিশাত তার দুই মেয়েকে নিয়ে সকাল সাতটায় বাসা থেকে বের হয়ে যেত। দুই মেয়েকে স্কুলে ড্রপ করে দিয়ে অফিসে যেত। বিকেল চারটায় ব্যাংক বন্ধ হলে, সে সোয়া চারটার দিকে বের হয়ে যেত। পৌনে পাঁচটার দিকে বাচ্চাদের স্কুলে থেকে পিক করে বাসায় যেত। এভাবে চলতে থাকে জীবন।
পেনসিলভানিয়া নিশাত যেখানে থাকে, সেখানে থেকে দুই ঘণ্টা ড্রাইভ করে নিউজার্সিতে তার মায়ের বাসা। তাদের আরও অনেক আত্মীয়-স্বজন সেখানে থাকে। নিশাতের স্বামী চাকরি নিয়ে অনেক বেশি ব্যস্ত থাকে। এ কারণে তাদের এক সঙ্গে বাইরে যাওয়া হয় না বললেই চলে। নিশাত তার মেয়েদের নিয়ে নিউজার্সি ও আত্মীয়-স্বজনদের বাসায় বেড়াতে যেত।
নিশাতের ব্যাংকের ম্যানেজার বলল, নিশাত তোমার কী কোনো ডাকনাম আছে। আমরা ব্যাংকের সবাইকে ডাকনামে ডাকি। ব্যাংকের সবাই মিলে ঠিক করল নিশাতকে ডাকবে নিশা নামে। ব্যাংক কর্মচারীদের সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর নিয়মিত কাস্টমারসহ সবার সঙ্গে নিশাতের সুন্দর সম্পর্ক তৈরি হয়। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, ব্যাংকের ১০ জন কর্মচারীর সবাই ছিল নারী। ব্যাংকে সবার জন্মদিন সেলিব্রেট করা হতো।
নিশাত ব্যাংকে কাজ শুরু করার কিছুদিন পরে, একজন নারী তাঁর স্বামীকে নিয়ে ব্যাংকে আসেন ক্রেডিট কার্ড থেকে ক্যাশ অ্যাডভান্স তোলার জন্য। নিশাত যেহেতু নতুন, তার সুপারভাইজারের অথোরাইজেশন ও সিগনেচার লেগেছে এই কাজটা সম্পন্ন করতে। ওই একই নারী পরে আরেক শাখা থেকেও ক্রেডিট কার্ড থেকে ক্যাশ অ্যাডভান্স নেয়। ৩০ মিনিট পর সেই শাখার ম্যানেজার নিশাতের ম্যানেজারকে ফোন করে বলেছেন, এটা ফ্রড কেস ছিল। ওই ঘটনার কিছুদিন পর নিশাতের ব্যাংকে পুলিশ আসে ইনভেস্টিগেশনের জন্য। তারা নিশাতকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। নিশাত পুলিশকে জানায় যে, কাস্টমার প্রেগন্যান্ট ছিলেন। পুলিশ নিশাতকে জানায়, ওই নারী প্রেগন্যান্ট ছিলেন না। এটা তাঁর অভিনয়। তাঁকে এ রকম দেখালে ব্যাংকের কর্মচারীরা ভালো করে চেক না করে দ্রুত টাকাটা দিয়ে দেয়।
তবে এ কাজের জন্য নিশাত বা তার সুপারভাইজারের কোনো সমস্যা হয়নি। আরেকবার নিশাতের শাখায় একজন নতুন কর্মী জয়েন করেন। বেশ কিছুদিন কাজ করার পর একদিন হঠাৎ নিশাত কাজে গিয়ে দেখে নতুন সহকর্মী কাজে আসছেন না। জিজ্ঞাসা করে জানতে পারে, তিনি নাকি ব্যাংক থেকে ২০০০ ডলার চুরি করেছেন। ধরা খাওয়ার পর ২০০০ ডলার ফিরিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু তাঁর চাকরিটা চলে গেছে।
বেশ কয়েক বছর সততার সঙ্গে কাজ করে নিশাত ধীরে ধীরে প্রমোশন পেতে থাকে। প্রথমে সিনিয়র লেভেলে তারপর সুপারভাইজার হয়ে যায়। এদিকে একজন মেয়ে কাস্টমার আসে ব্যাংকে একটা চেক-ক্যাশ করার জন্য। একজন সিনিয়র টেলার এই কাজটা করছিলেন। সুপারভাইজার নিশাতকে এতে অথোরাইজেশন দিতে হয়েছে। ওই মেয়ে টাকা তুলে ব্যাংক থেকে চলে যাওয়ার পরে জানা যায় এটা ছিল একটা ফ্রড কেস চেক। এ কারণে নিশাতকে ওয়ার্নিং করা হয়েছে। সমাজের দুষ্কৃতকারীরা জঘন্য অপরাধ করেও নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর নিশাতের মতো আরও অনেকে নির্দোষ এবং কঠোর পরিশ্রম করে বিনা অপরাধে ওয়ার্নিং পাচ্ছে।
২০০৭ সালের দিকে যখন আমেরিকাতে রিসেশন শুরু হয়েছে তখন ব্যাংকের ওই ব্রাঞ্চ বন্ধ হয়ে যায়। নিশাতকে বাসার কাছে আরেকটা ব্রাঞ্চে ট্রান্সফার করা হয়েছে। যদিও নতুন শাখা থেকে নিশাতের বাসা মাত্র ১৫ মিনিট দূরত্বে ছিল। তারপরও প্রথম ব্যাংকের সেই অভিজ্ঞতার দিনগুলোর কথা আজও ভুলতে পারে না।