বৈশাখ ও আমাদের ছোটবেলা
১.
চৈত্রসংক্রান্তির বিদায়ের পর আসে বৈশাখ। বৈশাখী ঝড় হাওয়ায় পুরাতন ধুয়ে মুছে নতুন সূর্যের আলোয় নতুনত্বের আহ্বান। দোকানে দোকানে লেগেই থাকতো হালখাতার পালা। পুরাতন ধুয়ে মুছে ফিরে পাওয়া নতুনের সজীবতা।
বৈশাখ মানে আম্রমঞ্জরিতে গুটিগুটি আমের সমাহার। শিমুল-পলাশ, কৃষ্ণচূড়া, টগর, চেরিফুলের সমারোহ। গাঁয়ের রাস্তার দু'পাশে অবহেলায় বেড়ে উঠা ভাঁটফুলের পথিক পাগল করা ঘ্রাণ। তখন মুগ্ধ হয়ে চেয়ে থেকে ঘ্রাণ উপভোগ করতাম। ভাঁটফুলের সেই উন্মুক্ত ঘ্রাণ নাসিকায় লেগে থাকলেও আজ হয়ে গেছে দূর অতীত।
আজ খুব ইচ্ছা হয় গাঁয়ের মেঠোপথের পাশে ফুটে ওঠা ভাঁটফুলের পাগল করা উদাম বুকের উদারতা দেখতে। ব্যস্ত জীবনে এক চিলতে অবসরে এখনো মাঝেমাঝে কানপেতে শুনতে চাই লাজুক ডাক। অথচ ভুলে যাই আমি এখন অনেক বড় হয়ে গেছি। পা রেখেছি দূর পরবাসে।
সেই সরল বেড়ে উঠা বনলতার পাশে আমি এখন আর নেই। পরবাসে পরাধীনতার চরম শিকলে বন্দী জীবন।
২.
অন্যান্য বছর পয়লা বৈশাখের আগেরদিন দুপুরবেলা থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আসতো নতুন বছর বরণ করে নেওয়ার সুখের বারতা। ছোট ছোট চিরকুটে সাজানো মনোমুগ্ধকর সব কথামালা। মৌসুমী ফুলের রঙিন চোখ ধাঁধানো বাহারি ছবি। নানানরকম বাদ্যযন্ত্রের ছবির এককোণে মিষ্টি-মিঠাইয়ের ছবিও ভোজনপটুদের চোখে লাগার মতো।
বৈশাখের প্রথম সকাল থেকে সারাদিন মোবাইলে পরিচিত অপরিচিতদের শুভেচ্ছা। টেলিভিশনের পর্দায় সংবাদ পাঠক-পাঠিকাদের পোশাক-পরিধানে আকর্ষণীয় রঙ্গে ঝিলমিল। ছোটবড় সবার মনে বৈশাখী আনন্দ।
এবার করোনার আঘাতে লণ্ডভণ্ড হয়েছে তামাম দুনিয়া। বৈশাখের আমেজ বলতে ছিটেফোঁটাও নেই। বাহারি সাঝ নেই। নতুন পোশাকে প্রেমিক যুগলের প্রেম নিবেদন নেই। চঞ্চল মানুষের এখন ঘর বন্দি জীবন। পান্তাভাতে ভর্তা-ইলিশ কেউ মনেও করেনি।
গরীব-দুঃখীদের আয়ের উৎস বন্ধ। কষ্টের চরম সীমায় পৌঁছে তারা গুনছে মুক্তির প্রহর। দিনমজুর পিতা ক্ষুধার্ত সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে হা-হুতাস করছে। আবার কোথাও কোথাও সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা তাদের পিচাশী মনে গরীব-দুঃখির ত্রাণ বিছানার নিচেই রেখে আরাম-আয়েশে ঘুমাচ্ছে।
৩.
ছোটবেলা পয়লা বৈশাখ খুব ভালো লাগতে। বাবার হাত ধরে মেলায় গিয়ে বাঁশের বাশিঁ কিনে আনতাম। সেই বাশিঁতে ফুঁক দিয়ে সারাবাড়ি ঘুরে বেড়াতাম। নির্জন দুপুরে কতবার কতজনের যে ক্লান্তিকর গভির ঘুম ভাঙ্গিয়েছি সেই বাঁশিতে ফুঁ দিয়ে, সেসব কথা মনে পড়লে আজও নিজেকে বাউণ্ডুলের দলপতি মনে হয়।
বাশের বাশিঁ, হাওয়াই-মিঠাই, মাটির হাড়ি, খেলনাপাতি সবই কিনে দিত বাবা। খেজুর গুড়ে মুড়ির মোয়া আয়েশ করে খেতাম। মা বানাতেন নারকেলের নাড়ু। দুই ভাইবোন উনুনের পাশে বসে মায়ের নারকেলের নাড়ু বানানো দেখতাম। গুড় আর নারকেল একসাথে কড়াইতে জ্বাল দিতেন। পরিমাণ মতো জ্বাল দেওয়া হয়ে গেলে উনুনের উপর থেকে নামিয়ে গরম গরম হাতের তালুর ভিতর নিয়ে গোল বানাতেন। খুবই সুস্বাদু ছিল সেই নারকেলের নাড়ু। যেকোন মুখরোচক খাবারের থেকে নারকেলের নাড়ুর স্বাদ আমার কাছে সম্পূর্ণ আলাদা।
বাবার চোখ রাঙানোর ভয়ে নাগরদোলায় উঠতে ভয় পেতাম। বাবা বলতো কখনো উঠবি না ভেঙে পড়বে! আমার বয়সী কত ছেলেমেয়ে নাগরদোলায় উঠতো। আমি দু'চোখ দিয়ে চেয়ে চেয়ে দেখতাম। বাবা আজ বেঁচে নেই। নাগরদোলায় চড়ার ইচ্ছাও আর নেই। আচ্ছা বাবা তুমি কি জানো পৃথিবীর কতকিছু এখন ভেঙে পড়ছে? নামিদামি আসবাবপত্র, উঁচু উঁচু উমারত ভেঙে পড়ার কথা বাদই দিলাম! কিন্তু সবথেকে মহামূল্যবান মানুষের ছোট্ট একটি মন, সেই মন অকারণে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে তার মেরামত কিভাবে হবে? কোনো চিকিৎসক সে ভাঙা মনোবেদনার সেবা দিবে? সামান্য ভুলে তছনছ হয়ে যাচ্ছে সাজানো মানব সংসার। ক্ষমার অযোগ্য ভেবে দূর থেকে বহুদূর হয়ে যাচ্ছে দূরত্ব! কেন আমরা একে অপরের কিঞ্চিৎ ত্রুটি ক্ষমা করতে পারি না? ক্ষমা যে করতে জানে সেই যে মহৎ।
৪.
বাবার হাত ধরে মেলা শেষে মাটির ব্যাংক কিনে বাসায় ফিরতাম। বাসায় এসে মনে মনে রোজ মাটির ব্যাংকে পয়সা জমা রাখার ফন্দী আটতাম। মা বাবাকে বলতো ওসব মাটির ছাইপাঁশ কেন এনেছ বাড়িতে? শুধু শুধু পয়সা নষ্ট! আজ এনেছ কাল ভেঙে ফেলবে। ও মাটির ব্যাংকের মর্ম বোঝে?
তখন নাইবা বুঝেছি ঠিকই। তুমি বিশ্বাস কর মা, এখন ঠিকই বুঝি। এখন অনেক ব্যাংকের মর্ম বুঝি। ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয় বুঝি। বড় বড় ব্যাংক জালিয়াতির চোখের ভাষা বুঝি। কালো টাকা সাদা হওয়া বুঝি। সাদা টাকার অবহেলা বুঝি।
৫.
বিদ্যমান সমাজের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংঙালীর বৈশাখ এখন টানাহেঁচড়ার দোটানায়। তবুও মিথ্যার কুলসিত হতে অবুঝরা বুঝে আসুক। করোনার ভয়াল আঘাত একদিন থাকবে না। বৃক্ষের শাখায় শাখায় ভরে উঠবে মৌসুমী ফুলের সমাহার। প্রকৃতি ও মানুষের বন্ধুত্ব হবে অটুট।
অহংকারীর খোলস বদলে জেগে উঠবে মানবতা। অসহায়ের পাশে দাঁড়িয়ে সহানুভূতির হাত বাড়ানোর প্রত্যয়ে আবারও ফিরে আসুক আমাদের চির চেনা বৈশাখ।