বেপরোয়া ট্রাম্প ও পৃথিবীর ভবিষ্যৎ

হাসপাতাল থেকে হোয়াইট হাউজে ফিরে মাক্স খুলে ফেললেন ট্রাম্প

তিনি গ্লোবাল ওয়ার্মিং বিশ্বাস করেন না, পরিবেশ দূষণ বিশ্বাস করেন না, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বিশ্বাস করতেন না, চিকিৎসা বিজ্ঞানকে সন্দেহের চোখে দেখেন, বিশ্ব সেরা জ্ঞানী–বিজ্ঞানীদের সন্দেহের চোখে দেখেন। অবস্থা দৃষ্টে মনে হয়, সব মানুষ সমান, তাও বিশ্বাস করেন না, কিন্তু তার অনেক সমর্থক। ধৈর্য নাই, অন্যকে কথা বলতে দিতে জানেন না, প্রায় প্রতিটি কথাই মিথ্যা, তারপরেও বহু মানুষ তাকেই বাহবা দিচ্ছে।

কাজের কাজ একটাই করেছেন, স্টক মার্কেট চাঙ্গে (মানে ওপরে) উঠিয়ে রেখেছেন, যেভাবে করোনাভাইরাসকে তার অসাধারণ মুখের বুলি-গালি দিয়ে তার বানানো দুনিয়া থেকে বিদায় করে দিয়েছেন।

১৯৯১ থেকে ২০০৯ সালের মধ্যে তিনি তাঁর বিভিন্ন ব্যবসায় ঋণের টাকা শোধ করতে না পেরে একবার/দুইবার নয়, ছয়বার দেউলিয়া ঘোষণা করেছেন। সেই লোক নাকি অনেক বড় ব্যবসায়ী এবং কারও কারও মতে, বিশাল ‘অর্থনীতিবিদ’!

সমঅধিকারে অগ্রগণ্য দেশ আমেরিকায় জাতি-ধর্ম-বর্ণ-জন্মস্থান দিয়ে মানুষকে বিভাজনকারী এই লোকটি এখন দুনিয়ায় সবচেয়ে আলোচিত। তিনি ডোনাল্ড ট্রাম্প। দ্বিতীয় মেয়াদে পুনর্নিবাচনের জন্য রিপাবলিকান পার্টির হয়ে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী জো বাইডেনের বিপক্ষে লড়ছেন।

তাঁর সমর্থকদের বিশ্বাস হলো, ‘সবাই আসলে এক’/অসুবিধা কি? সব তো ঠিকমতোই চলছে’/‘সে কি বিশ্বাস করে না করে, তাতে আমাদের কি অসুবিধা হইছে?’ / ‘সে তো সোশ্যালিস্ট না। আরেকজন যে সোশ্যালিস্ট? দেশ ধ্বংস করে ফেলবে।’ /‘মিথ্যা কথা বলে? সব কথা মিথ্যা না, কিছু কিছু জোক করে বলা কথা নিয়ে মিডিয়া হইচই করছে। তিলকে তাল বানাচ্ছে। আর কে না মিথ্যা বলে?’

প্রথম বিতর্কটি সবাই দেখেছেন। তাঁর অসহিষ্ণু, ডাকা-বুকো ভাবভঙ্গি, নিয়ম না মানার প্রবণতা, মিথ্যা বলার প্রবণতা, অন্যকে কথা বলতে না দেওয়া এবং সর্বোপরি শ্বেতাঙ্গ চরমপন্থী একটি দলকে প্রস্তুত থাকতে বলা (স্ট্যান্ড ব্যাক অ্যান্ড স্ট্যান্ডবাই), সবকিছুতেই মানুষটির চরিত্র পরিষ্কার ফুটে উঠেছে। তার উচ্ছৃঙ্খল শরীরি ভাষা খুব সহজেই পড়তে পারা গেছে। অনেকেই বলছেন, এই বিতর্ক যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অত্যন্ত লজ্জাকর। কিন্তু ফক্স নিউজ বলছে, তিনি খুবই ভালো করেছেন। সমর্থকেরা কেউ তার দোষ দেখতে পাচ্ছেন না।

২০১৭ সালে তিনি বলা নেই, কওয়া নেই, হঠাৎ সাতটি দেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বৈধ ইমিগ্রান্টদের প্রবেশ করা নিষিদ্ধ ঘোষণা করলেন কোনো আগাম পূর্বাভাস বা সতর্কতা ছাড়াই। শত শত ইমিগ্রান্ট তখন তাদের দেশ থেকে বৈধ ইমিগ্রেশন নিয়ে, অর্থ বিত্ত খরচ করে, ফ্লাইটের টিকিট কিনে আমেরিকার পথে, আকাশ পথে অবস্থান করছে।

তাঁর কলমের এক খোঁচায় আকাশেই এই সাত দেশের অভিবাসীদের ইমিগ্রেশন বাতিল হয়ে গেল। বিমানবন্দরে তাদের নিতে কোনো বন্ধু-বান্ধব বা আত্মীয় এল না, এল বর্ডার পেট্রলের পুলিশ। হাতে গ্রিনকার্ড কিন্তু পরিবারটি এখন সেই ট্রাম্পের কলমের খোঁচায় বেআইনি অনুপ্রবেশকারীতে পরিণত হলো। সোজা নিয়ে যাওয়া হলো আটক কেন্দ্রে। হাজার হাজার মানুষ বিমানবন্দরে নিজ গরজে গিয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করল। মানবতাবাদী আইনজীবী গেল, হিউম্যান রাইটস গ্রুপ গেল তাদের ছাড়িয়ে আনতে। এই ঘটনাটাকে বলা হয় ‘মুসলিম ব্যান্ড’।

তাহলে এই মানুষটিকে আপনি কী বলবেন? তার হেয়ালির কোনো লাগাম নেই! মানুষের প্রতি দয়ামায়া, দায়িত্ববোধ কিছুই নেই।

তারপর আসা যাক কোভিড-১৯–এ। যেখানে বিশ্বের সব দেশের সরকার সামাজিক দূরত্ব, বাইরে মাস্ক পরা—এসব কড়াকড়িভাবে আরোপ করছে, সেখানে তিনি এসবের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। সিডিসিকে হুমকি–ধামকি দিলেন, মাস্ক পরার পরামর্শ যেন না দেয়। অ্যান্থনি ফাউসিকে কতবার চাকরিচ্যুত করার হুমকি দিয়ে টুইট করেছেন, তা সবারই জানা।

যে বিশেষজ্ঞ মানুষকে বাঁচাতে চান, যার এ বিষয়ে জ্ঞান সবচেয়ে বেশি, তাঁকে তিনি চাকরিচ্যুত করতে চান! তার কথা হচ্ছে, তার মতো করে বলতে হবে। মাস্কের দরকার নেই। ফলাফল স্বরূপ তিনি নিজেই, তার পরিবার, হোয়াইট হাউস, সব মিলে কত মানুষকে তিনি কঠিন রোগের মুখে ঠেলে দিয়েছেন, তা সবাই দেখতে পাচ্ছে। শুধু তিনি ও তার সমর্থকেরা ছাড়া।

এই মানুষটি প্রথম বিশ্বের শুধু আরেকজন রাজনীতিবিদ নন। তিনি অনেকের কাছে ভয়াবহ ত্রাসও বটে। রিপাবলিকান স্ট্র্যাটেজিস্ট উইলসন এভাস্ট সেলার একটি বই লিখেছেন, ‘এভরিথিং ট্রাম্প টাচেস ডাইস’। রিপাবলিকান পার্টি বলে আর কিছু থাকবে না। সব তার ছেলে-মেয়ে, মেয়ে-জামাই এবং পছন্দের মানুষেরা দখল করে নেবে। একজন সাবেক প্রেসিডেন্ট, এমনকি নামকরা রিপাবলিকান সিনেটরকেও তিনি নির্বাচন বিষয়ে কথা বলার জন্য ডাকেন না। এখন গণতন্ত্র বিরাট হুমকির মুখে। তাকে কাছ থেকে দেখেছেন এমন মানুষেরা বলেছেন, তিনি নির্বাচনে হারলেও যাবেন না। দুই টার্মের বেশি থাকার জন্যও জল্পনা–কল্পনা করছেন। তিনি নির্বাচনে হারলে চলে যাবেন, সে কথা একবারও বলছেন না। চাপাচাপি করেও তার মুখ দিয়ে এই একটি কথা বের করা যায়নি। প্রকারান্তরে সমর্থকদের প্রস্তুত থাকতে বলছেন, অরাজকতা সৃষ্টির জন্য বললে অত্যুক্তি হবে না।

মনে রাখতে হবে, এই লোক ফসিল ফুয়েল পোড়াচ্ছে। গাড়ি, কল-কারখানার যে ধোঁয়া, তাকে পরিবেশের জন্য অধিক পরিস্রুত করার জন্য বিশ্বব্যাপী যে জনমত এবং পরিকল্পনা, সেখান থেকে তিনি সরে এসেছেন। মুনাফা কমিয়ে গাড়ি–ঘোড়া, কলকারখানার ধোঁয়াকে পরিষ্কার করে বাতাসে ছেড়ে দেওয়া তার মতে বোকামি, এতে গাড়ির দাম বেড়ে যাচ্ছে। আর পরিবেশ দূষণ ও গ্লোবাল ওয়ার্মিং তো তিনি বিশ্বাসই করেন না। তিনি বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের সমাধানের জন্য বহুজাতিক ‘প্যারিস অ্যাগ্রিমেন্ট’ থেকে বের হয়ে এসেছেন।

অথচ গ্লোবাল ওয়ার্মিং নিশ্চিতভাবে শুরু হয়ে গেছে। এ বছর উত্তর গোলার্ধের তাপমাত্রা আজ পর্যন্ত মানুষের জানা সব তাপমাত্রাকে ছাড়িয়ে গেছে। মেরুর জমাট বরফ আশঙ্কাজনক হারে গেলে যাচ্ছে। ঘূর্ণিঝড়, আগুন—এসব আগের চেয়ে অনেক ভয়াবহ হয়ে দেখা দিচ্ছে। এসব নিয়ন্ত্রণ না করতে পারলে সভ্যতার ধ্বংস অনিবার্য, সময়ের ব্যাপার মাত্র।

যুক্তরাষ্ট্রে কোভিড-১৯–এর অস্বাভাবিক সংক্রমণ ও মৃত্যুর পেছনে যেমন এই মানুষটিকে প্রধান কারণ হিসেবে ধরা যায়, বৈশ্বিক উষ্ণতা ত্বরান্বিত করার জন্যও এই মানুষটিই প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছেন। তাঁর হাসপাতাল থেকে ফিরেই ক্যামেরার সামনে প্রতীকীভাবে মাস্ক খুলে ফেলা আমাদের আশঙ্কাকে আরও ঘনীভূত করে কেবল।

কাজেই ‘কে প্রেসিডেন্ট হলো, আমার তাতে কিইবা তেমন এসে গেল’, অথবা ‘সবাই এক, বাইডেন অর্থনীতি ধসিয়ে দেবে’—এভাবে চিন্তা করাটা আসন্ন নির্বাচনের ক্ষেত্রে বিরাট দায়িত্বহীনতার পর্যায়ে পড়ে। মনে রাখবেন, আরও চার বছরে তিনি অফিসে থাকলে সব সর্বনাশের ষোলোকলা পূর্ণ হবে।