বেচারা স্বামী
নিশ্চিত আমি কোনো বড় পাপ করেছি, না হলে কি তোমার মতো বলদ আমার কপালে জোটে?
—দেখো, তুমি তো তাও ভাগ্যবতী। তোমার কপালে বলদ জুটছে। বলদ হলেও সে সৎ। একবার আমার কথা ভাবো। আমার কপাল কত খারাপ। আমার জীবনে তোমার মতো পাপী জুটেছে।
—কি বললা, আমি পাপী?
—আমি বললাম কই? তুমি–ই তো বললা তুমি বড় পাপ করছ, তাই আমার ঘরে আসছ।
—আমি বললে বলেছি, তাই বলে তুমি আমারে পাপী বলবা। ছোটলোক, ইতর।
বলেই স্ত্রী কান্না জুড়ে দিল।
—দেখো, কাঁদবা না। সব সময় কান্নাকাটি করে ঝগড়া জিতবা, এটা কিন্তু ঠিক না। কেঁদে কেঁদে ঝগড়া জেতার মধ্যে কোনো ক্রেডিট নাই।
—থামো। আমারে তুমি ক্রেডিট-ডেবিট বুঝাইও না।
—আচ্ছা তোমার সমস্যা কী? আমি যে কথাই বলি, তাই তুমি ধরো। এটা তো ঠিক না।
—ধরব না কেন? তুমি ভদ্রতা বোঝো? তোমার মতো ছোটলোক, ইতর আমি জীবনেও দেখিনি। একজন ভদ্রমহিলার সঙ্গে কীভাবে কথা বলতে হয়, তা তুমি জানো না।
—আরে, আমি কী করলাম। গালাগাল তো তুমি করতেছ। তুমিই তো একজন ভদ্রলোকের সাথে খারাপ ব্যবহার করছ।
—আসলে কি জানো? তোমারে বিয়ে করাটাই আমার ভুল হয়েছে। তোমার কারণে আমার জীবনটাই ধ্বংস হয়ে গেছে।
—শোনো, শুধু তোমার জীবন না, বাংলাদেশের প্রতিটা বিবাহিত মহিলার জীবন ধ্বংস হয়ে গেছে তার বর্তমান স্বামীর জন্য। তুমি জীবন ধ্বংসের যে ডায়ালগটা দিলা, তা বাংলার প্রতিটা স্ত্রীই তার স্বামীকে একবার হলেও শুনাইছে। এমনকি তোমার বাবা, যাকে তুমি বলো ভালো মানুষের রোল মডেল, খোঁজ নিয়ে দেখো, তাকেও তোমার মা এই ডায়ালগ জীবনে একবার হলেও দিছে।
—খবরদার। আমার বাবা–মা নিয়ে কোনো কথা বলবা না।
—আমি তো একটা উদাহরণ দিলাম।
—তুমি উদাহরণও দিবা না।
—হুঁ।
—বললাম না কোনো কথা বলবা না।
—আমি তো কথা বলিনি। শুধু ‘হুঁ’ বলেছি।
—তুমি হুঁও বলবা না। চুপ করে থাকবা।
বলেই আমার স্ত্রী হনহন করে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল। সামনের থেকে চলে গেলেও তার মুখ বন্ধ নেই। রান্নাঘর থেকেই তার গজগজানি কথা ভেসে আসছে—আমার কপালটাই খারাপ। আমার মতো পোড়া কপাল দুনিয়ার আর কারও নাই। দুনিয়ার সবাই সুখী। সবাই আনন্দে আছে, শুধু আমি ছাড়া। ব্যাটা বলদ, সাধারণ একটা কাঁচাবাজার, সেটাও ঠিকমতো করতে পারে না। এই ব্যাটা বলে আবার ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট ছিল! বুয়েট থেকে পাস করেছে! নিশ্চয় দুই নম্বরী করে বুয়েটে ভর্তি হয়েছে। আমি তো এই বলদরে প্রাইমারি স্কুলেও ভর্তি করব না।...
ভালো কাঁচাবাজার করতে পারার মধ্যে ভালো ছাত্র বা ভালো স্বামী হওয়ার রহস্য লুকিয়ে আছে সেটা আমার জানা ছিল না। তাহলে বিয়ের আগে কোনো একটা কোচিং সেন্টার থেকে কাঁচাবাজারের একটা কোর্স করতাম। আচ্ছা এ ধরনের কোনো কোচিং সেন্টার কি আছে? না থাকলে খোলা উচিত। যেখানে কাঁচাবাজার থেকে শুরু করে আদর্শ স্বামী হওয়ার সকল কৌশল শেখানো হবে।
আসলে সবাই সবকিছু পারে না। আমি যেমন কাঁচাবাজারটা করতে পারি না। বাড়ির ছোট ছেলে হওয়ার কারণে কখনো বাজার করতে হয়নি। সাধারণত বাজারটা বাবা অথবা বড় দুই ভাই করত। তবে এখন আমি ধীরে ধীরে বাজার করা শিখছি। কথায় আছে শিক্ষার শেষ নাই এবং শিক্ষার কোনো বয়স নাই। বর্তমানে বউ আমার কাঁচা বাজার শিক্ষক। সে আমাকে কাঁচাবাজার করার কৌশল শেখাচ্ছে। তবে তার বক্তব্য ছাত্র হিসেবে আমি নাকি খুবই নিম্নমানের। আমারও তাই মনে হয়। কয়েকটি উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা খোলাসা হবে।
ঘটনা নম্বর এক। একদিন বউ বলল বাজার থেকে একটা রুই মাছ আনতে। শিখিয়ে দিল মাছ কেনার সময় বড় দেখে কিনতে এবং আঙুল দিয়ে টিপে টিপে দেখতে। যে মাছে আঙুল দেবে যাবে না, সেই মাছটা কিনতে হবে। বউয়ের শেখানো টেকনিকে সেদিন ঠিকই ভালো মাছ কিনেছিলাম। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে একই টেকনিক ব্যবহার করে লাউও কিনেছিলাম।
বাজারের ব্যাগ থেকে লাউ বের করে সামনে এনে শান্ত ও আদুরে গলায় বউ জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা জান, বলো তো এত সুন্দর লাউ তুমি চিনলা কীভাবে?
আমি তো অবাক।
—আরে, তোমার শেখানো মাছ কেনার টেকনিক ইউজ করে লাউ কিনেছি।
আনন্দে গদগদ হয়ে উত্তর দিলাম।
—তাই নাকি? সেটা কীভাবে?
—বেছে বেছে বাজারের সবচেয়ে বড় লাউটাই আনছি। আর টিপে দেখো, আঙুল দেবে যাবে না। নখ ঢুকবে না।
আমার কথা শেষ না হতেই চিৎকার করে উঠল, বেশ করেছ। নখ কেন, এই লাউয়ে হাতুড়ি দিয়ে মেরে পেরেকও ঢোকানো যাবে না। শালা বুইড়া, বুড়া লাউ নিয়া আসছোস।
—তুই–তুকারি করছ কেন? আর বুড়া বলছ কেন? আমি তো আর বুড়া না।
—তুই বুড়া, তুই বুড়া, তুই বুড়া।
—আচ্ছা ঠিক আছে আমি বুড়া। তিনবার বলার কোনো দরকার নাই।
—দাঁড়া এই লাউ তোরে আজ আমি শুধু লবণ দিয়ে সিদ্ধ করে খাওয়াব।
—আচ্ছা ঠিক আছে, এই লাউ আমিই খাব, কিন্তু রান্না করে দিয়ো। শুধু লবণ দিয়ে সিদ্ধ করবা কেন?
—অসম্ভব। এই বুড়া লাউয়ের জন্য আমি মসলা নষ্ট করব না।
সে তার কথা রেখেছে। লবণ দিয়ে সিদ্ধ করা সেই লাউ, পুরোটাই সে আমার সামনে বসে থেকে খেতে বাধ্য করেছে।
ঘটনা নম্বর দুই। শ্বশুর অসুস্থ। বউ আগেই দেখতে চলে গেছে। আমাকে ফোন করে বলল অফিস থেকে সরাসরি শ্বশুরালয় যেতে। যাওয়ার সময় ফলমূল নিয়ে যেতে। বারবার সাবধান করে দিল যেন ফল নষ্ট না হয়। আমি খুবই সাবধানে আমার সকল মেধা দিয়ে বেছে বেছে আপেল, আঙুর আর কমলা নিলাম।
শ্বশুরের বাসায় ঢুকতেই বউ ফলের ব্যাগ হাতে নিয়ে বলল, তুমি আব্বার রুমে গিয়ে কথা বলো। আমি ফলগুলো ধুয়ে সাইজ করে আনছি।
আমি শ্বশুরের সাথে কথা বলছি। এ সময় বাসার কাজের মেয়েটি এসে বলল, আফা আপনাকে ডাকে।
কাজের মেয়েকে অনুসরণ করে পাশের রুমে গেলাম। বউ ফলের প্যাকেটগুলো সামনে নিয়ে বসে আছে।
—জান, তুমি এগুলো কী আনছ?
আদুরে গলায় জিজ্ঞেস করল। আদুরে গলা শুনেই বুঝলাম, ভবিষ্যৎ খারাপ।
—ফল এনেছি। কেন তুমি ফল চেন না?
—না, এই–জাতীয় ফল আমি চিনি না। আমার বাবার জন্মেও আমি এমন পচা ফল খাইনি। দেখো এগুলো কী আনছ।
—বলো কী? আমি নিজ হাতে বেছে বেছে টাটকা ফলগুলো প্যাকেটে ঢুকাইছি।
—তুমি ঢুকাইছ ঠিকই। কিন্তু দেওয়ার সময় দোকানদার ভালো প্যাকেট রেখে তোমারে পচা ফলের প্যাকেট ধরায়ে দিছে। অবশ্য পচা জিনিস তোমারে দেবে না তো কারে দেবে? তুমি দোকানে ঢুকতেই দোকানদার তোমার চেহারা দেখেই বুঝছে, আজ মাল একটা পাইছি।
—মানুষ এত খারাপ হয় কীভাবে? কাউকে তো দেখি আর বিশ্বাস করা যাবে না।
—শোনো তুমি কারে বিশ্বাস করবা, আর কারে করবা না সেটা তোমার ব্যাপার। তবে পয়সা খরচ করে যেহেতু ফলগুলো আনছ, ফেলে তো আর দেওয়া যাবে না।
—বুঝেছি, তার মানে এগুলো সব এখন আমার খেতে হবে?
—জি, বিসমিল্লাহ বলে শুরু করো। যতটুকু পারো খাও, বাকিটা না হয় বাসায় যেয়ে খেয়ো।
আমার বউ সেদিনের সেই সব পচা ফল জোর করে আমারে খাইয়েছে। এরপর থেকে এখন ফল দেখলেই কেমন জানি গাটা গুলিয়ে ওঠে।
ঘটনা নম্বর তিন। আরেক দিন হলো কী? না থাক আজ আর না। আরেক দিন বলব।
বি. দ্রষ্টব্য: এখন আর আমাকে বাজার করতে দেয় না। বউ নিজেই করে। তবে আমি অপেক্ষায় আছি কখন সে পচা বাজার করবে, আর আমি তারে সেই খাবার খাওয়াব। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ধরতে পারছি না। ধরব কী করে, সে তো পচা বাজার করে না। আর যদি করেও, সে সেটা কৌশলে বুঝতে দেয় না। বাসায় আমরা বেশি ঝাল খাই না। তবুও মাঝেমধ্যে তরকারিতে প্রচুর ঝাল হয়। আমার ধারণা, যেদিন সে ভুলে পচা মাছ নিয়ে আসে, সেদিনই তরকারিতে প্রচুর ঝাল আর মসলা দেয়। যাতে আমি ধরতে না পারি। আর সেই তরকারিটা মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে সে আমাকেই খাওয়ায়। নিজে খায় না। কী যে করি? বড়ই বিপদে আছি।
ইমদাদ বাবু: নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র।