বেকার তারুণ্যের দুর্ভোগ কমবে কবে
দেশের লাখো ছেলেমেয়ে শিক্ষাজীবন শেষে চাকরির চেষ্টা করে। চাকরি খোঁজার বিষয়টা এমনিতেই মানসিক চাপের, এটা কোনো উপভোগের বিষয় নয়। পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক প্রভৃতি নানান চাপের মধ্য দিয়ে দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির অসংখ্য তরুণ-তরুণীকে একটা চাকরির জন্য বহু প্রতিষ্ঠানে পরীক্ষা দিতে হয়।
একজন তরুণ যখন এমন মানসিক চাপের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করে, তখন সমাজের দায়িত্ব হলো কী করে তাঁর পাশে দাঁড়ানো যায়। কী করে তাঁকে সাপোর্ট দেওয়া যায়! কী করে তারুণ্যের এই কঠিন সময়টাকে কিছুটা সহজ করে দেওয়া যায়। তাহলে এই তরুণেরা যখন কর্মজীবনে প্রবেশ করবেন, তখন সমাজের প্রতি তাঁদের দায়বোধ বেড়ে যাবে। প্রতিজ্ঞাবোধটুকু আরও দৃঢ় হবে। ক্লেশ-ক্লান্তি আর অনাগ্রহ নিয়ে কর্মজীবন শুরু করবেন না।
কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, এই বেকার তারুণ্যের পাশে সমাজ কিন্তু নির্ভরতার হাত বাড়িয়ে দাঁড়ায় না। রাষ্ট্রীয় নিয়ম-নীতিগুলো তরুণদের এই মানসিক চাপকে হ্রাস না করে বরং বাড়িয়ে দেয়। যেমন উচ্চ আবেদন ফি (অ্যাপ্লিকেশন ফি) চাকরিপ্রত্যাশী তারুণ্যের জন্য একটা বড়ে চাপ। বছর বছর প্রতিষ্ঠানগুলো লাগামহীনভাবে আবেদন ফি বাড়িয়ে যাচ্ছে। নিয়মনীতি ও নিয়ন্ত্রণহীন এই বর্ধিত ফি বেকারদের জন্য বাড়তি চাপ হয়ে দাঁড়ায়। এগুলো কি আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না? দুনিয়ার বহু দেশে চাকরি আবেদনের কোনো ফি নেই। ইউরোপ-আমেরিকায় যত চাকরির জন্য আবেদন করেছি বা ইন্টারভিউ দিয়েছি, কোথাও আমাকে অ্যাপ্লিকেশন ফি দিতে হয়নি। উপরন্তু, কোনো প্রতিষ্ঠান যখন আমার প্রোফাইল পছন্দ করেছে এবং ইন্টারভিউর জন্য ডেকেছে, তখন যাতায়াত খরচসহ আবাসন ও খাবারের যাবতীয় খরচ সে প্রতিষ্ঠান বহন করেছে। আমাদের তরুণেরা তো এত কিছু আশা করেননি। এত বেশি কিছু চাননি। তাঁরা চান আবেদনের টাকাটা সাধ্যের মধ্যে থাকুক। একজন বেকারের অর্থের অভাব আছে বলেই তো চাকরি খোঁজেন। তাহলে তাঁর কাছ থেকে কেন উচ্চ ফি নেওয়া হবে?
উচ্চ আবেদন ফির পর আসে যাতায়াতের দুর্ভোগ। দেশের বহু প্রতিষ্ঠান এখনো শুধু ঢাকা-চট্টগ্রাম বা বিভাগীয় শহরকেন্দ্রিক পরীক্ষা আয়োজন করে। দিনাজপুর থেকে যদি কেউ ঢাকায় একটা পরীক্ষার জন্য আসেন, তাহলে তাঁকে অন্তত এক দিন আগে আসতে হয়। দিনাজপুর থেকে ঢাকায় যাতায়াতের খরচ বাবদ অনেক টাকা খরচ হয়। আত্মীয়স্বজন বা পরিচিত কেউ না থাকলে রাত যাপনের জন্য আলাদা খরচ। এসব ভোগান্তি, দুর্ভোগ, মানসিক চাপ থেকে কি তাঁদের কোনো মুক্তি নেই? দেশে আজেও কি আমরা প্রতিটি জেলা শহরে পরীক্ষাকেন্দ্র (Examination Center) গড়ে তুলতে পারি না? পরীক্ষাকেন্দ্রগুলো বছরজুড়ে নানান পরীক্ষার জন্য ব্যবহৃত হবে। প্রতিটি জেলায় সম্ভব না হলেও অন্তত একটা জোনভিত্তিক শুরু করা যায়। শুধু ঢাকাকেন্দ্রিক পরীক্ষার বিষয়টার মুক্তি দরকার। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরীক্ষাগুলোর ধরন বদলানো উচিত। কম্পিউটারভিত্তিক পরীক্ষা চালু করা প্রয়োজন।
ইংল্যান্ড, সারা দুনিয়াতে আইএলটিএস পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ করছে। আমেরিকা সারা দুনিয়াতে জিআরই, এসইটি প্রভৃতি পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ করছে। তাদের এই পরীক্ষাগুলো দেওয়ার জন্য তো কাউকে বাংলাদেশ থেকে লন্ডন কিংবা আমেরিকা যেতে হয় না। তাদের পরীক্ষার প্রশ্নপত্র তো ফাঁস হয় না। আমরা কেন অনুরূপ পরীক্ষাপদ্ধতি চালুর চিন্তা করছি না? চাকরির পদসংখ্যা অনুসারে ভাইভার জন্য প্রার্থী নির্ধারণ করা হোক। ১০টা পদ থাকলে ২০ বা ৩০ জন প্রার্থীকে চূড়ান্ত ভাইভার জন্য রাখা হোক। একটা পদের বিপরীতে চূড়ান্তভাবে দুই-তিনজন যোগ্য প্রার্থীর বেশি রাখার কোনো প্রয়োজন হয় না। এতে করে অন্য প্রার্থীদের সময়, অর্থ ও দুর্ভোগ হ্রাস পায়। ভাইভা পরীক্ষাগুলোও শুধু ঢাকাকেন্দ্রিক না করে অন্যান্য স্থানে ছড়িয়ে দেওয়া প্রয়োজন। অনলাইনে ভাইভা নেওয়ার ব্যবস্থাও ধীরে ধীরে চালু করা উচিত।
যে তারুণ্য রাষ্ট্রের রাজপথে ঝংকার তোলে, দুর্বার দুর্ভেদ্য প্রতিরোধে অশুভকে রোখে, সে তারুণ্য চাকরি খুঁজতে গিয়ে কেন বোঝার ভারে ন্যুব্জ হয়ে থাকবে। এই তারুণ্য যদি আনন্দ নিয়ে হাসতে হাসতে শিক্ষাজীবন শেষ করে, হাসতে হাসতে কঠোর প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে কর্মজীবনে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে না পারে, তাহলে দেশ কতটুকু ফিরে পাওয়ার আশা রাখে?
শিক্ষাজীবন শেষ হলেই একজন তরুণের সঙ্গে বেকার শব্দটা জুড়ে যায়। কিন্তু কেউ তো চিরদিন বেকার থাকেন না। আজ নয়তো কাল, চাকরি খুঁজে পান। শুরু করেন কর্মজীবন। কর্মজীবনের মধ্য দিয়ে কিন্তু দেশেরই সেবা করে যায়। দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখে। দেশের জন্য অবদান রাখে। তাহলে, বেতনভুক একজন কর্মাচারীকে কী করে রাষ্ট্রের সেবক হিসেবে আরও ঘনিষ্ঠ করে আলিঙ্গন করা যায়, সেটার মধ্য দিয়ে কিন্তু রাষ্ট্রের দায়বোধের বিষয়টুকু ফুটে ওঠে। বেকারদের পাশে দাঁড়ানোর কাজটা ঠিক তেমনই! কারণ বেকার তারুণ্য দেশেরই সম্পদ! তাঁদের মেধা, শ্রম, আগ্রহ (মোটিভেশন), নেশা এই বিষয়গুলোকে রাষ্ট্রের সম্পদে রূপ দেওয়ার জন্য সে রকম নীতিনির্ধারণই প্রয়োজন!