বৃষ্টিদিনের রূপকথা!

বছরের প্রথম বৃষ্টি আলতাফের জন্য কেমন একটা উৎসবের মতো। কোনো কারণ ছাড়াই মনমেজাজ ভালো হয়ে যায়। যেদিকে তাকায়, যা কিছু দেখে, সবকিছু কেমন যেন ভালো লাগতে থাকে। বৃষ্টিতে ঢাকা শহরের রাস্তায় হাঁটুপানি ভরে যাক, আর অলিগলি কাদামাটিতে ছেয়ে যাক, তার কাছে সবকিছুই অসাধারণ লাগে। এর মানে আবার এই নয় যে দিনের পর দিন বৃষ্টি তাকে মুগ্ধ করে। এত সময় তার নেইও।
আলতাফ অপেক্ষা করে থাকে বছরের প্রথম বৃষ্টির জন্য। এদিন সে বিশেষ বিশেষ কাজ করে। অফিস থেকে যতটা দ্রুত সম্ভব ছুটি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে রাস্তায়। আর যদি কোনো কারণে বৃষ্টি রাতের বেলা হয়, তবু আলতাফ তার রুটিনমাফিক বছরের প্রথম বৃষ্টির দিনটি পালন করে পরদিন। এদিন আলতাফের পূর্ণ স্বাধীনতার দিন।
স্ত্রী সুমাইয়া তাকে এদিন কোনো কাজে বাধা দিতে পারে না। অবশ্য সুমাইয়া জানেও না আলতাফ এ রকম ঝুম বৃষ্টির দিনে প্রকৃতপক্ষে কী করে? সুমাইয়া মনে করে, দুটি মানুষের সংসারে একজন আরেকজনকে ছাড় দিতে হবে। প্রাইভেসি দিতে হবে। তবেই একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধা থাকবে।
কিন্তু আলতাফ অবশ্য এত কিছুর ধার ধারে না। সে জানে, সে এমন কিছু কাজে জড়িত, যা সুমাইয়ার পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। আলতাফ তাই সুমাইয়াকে জানাতেও চায় না। সে এই তর্কে কখনো যায় না, যা সে করছে তা ভালো নাকি খারাপ? সে জানে, তার জীবন স্বাধীন। সে প্রাপ্তবয়স্ক। প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ তার কিছু ব্যক্তিগত সাধ আহ্লাদ উপভোগ করতেই পারে। এটাই আলতাফের বিবেচনা।
এই যে আজ দুপুরবেলা আকাশ কালো হয়ে আগমন হলো বছরের প্রথম বৃষ্টির। আলতাফ দ্বিতীয়বারের জন্য না ভেবে বেরিয়ে পড়ল অফিস থেকে। গন্তব্য বাজার। আলতাফ খুব আনন্দ নিয়ে ঘুরেফিরে দুই কেজি পোলাওর চাল কিনল। দুই কেজি মুগ আর মসুর ডাল, দুই বোতল তেল। মাছের দোকানে গিয়ে দেখেশুনে ডিম ছাড়া দুটো ইলিশ কিনল। আলতাফের ধারণা, ডিম না থাকলে ইলিশের স্বাদ তীব্রভাবে পাওয়া যায়। দুইটা বড় সাইজের দেশি মুরগি আর দুই কেজি গরুর মাংস কিনতেও ভুলে গেল না।
সবকিছু দুটো সমান ভাগ করে দুই ভাগ দুই হাতে ঝুলিয়ে সে পথে নামল। নিজের বাসার উদ্দেশেই রওনা দিল। স্বল্প বেতনের চাকরি দিয়ে ঈদের দিন ছাড়া একসঙ্গে এত বাজার করা হয়ে ওঠে না তাদের। কিন্তু বছরের প্রথম বৃষ্টির দিনে সে ঠিক সেটাই করবে, যেটা তার মন চাইবে। তাকে বাধা দেওয়ার কেউ নেই।

আলতাফ বাসায় গিয়ে এক ভাগ বাজার সুমাইয়ার হাতে দিয়ে অন্য ভাগ নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। সুমাইয়া জানে, আজ রাতে আলতাফ আর ফিরবে না! বাসায় খাবেও না। এসব নিয়ে কোনো প্রশ্ন করা যাবে না। সুমাইয়ার খারাপ লাগে, নিজেকে অবহেলিত মনে হয়, তবু সে প্রশ্ন করে না।
আলতাফ এখন যাবে মর্জিনার কাছে। মর্জিনাকে সে ভীষণ পছন্দ করে। সে অনেক বছর আগের কথা। আলতাফ তখন ছাত্র। শেষ বর্ষের রেজাল্ট আশানুরূপ না হওয়ায় প্রচণ্ড দুঃখে সারাটা রাত সে রমনা পার্কে বসে ছিল। সেদিন গভীর রাতে এই মর্জিনা নামের মেয়েটি আলতাফের পাশে এসে বসেছিল। তাকে বলেছিল, মন ভালো করার ওষুধ সে দিতে পারবে। মর্জিনা আলতাফকে ডেকেছিল কেমন এক অন্য রকম আহ্বানে।
আলতাফ সেই রাতে প্রথমবারের মতো বিষয়টাকে এত কাছ থেকে দেখছিল। পর্যবেক্ষণ করছিল মর্জিনার অদম্য চেষ্টা, আলতাফের দৃষ্টি আকর্ষণ করার। আলতাফ অপলক দৃষ্টিতে দেখছিল মেয়েটিকে। এত ছোট একটা মেয়ে, এত সুন্দর একটা মেয়ের স্থান এখানে হবে, তা সে ভাবেনি। নিজের জীবনে পরাজয় সইতে না পেরে আলতাফ ছিল বিপর্যস্ত। কোনো মন ভালো করার ওষুধের ব্যাপারে সে আগ্রহী ছিল না। কিন্তু কেন যেন আলতাফের খুব ইচ্ছা হলো মর্জিনার হাতে কিছু টাকা দেয়। যেন তার আজ রাতটা এভাবে লোকের দৃষ্টি আকর্ষণে নিয়োজিত থাকতে না হয়। অন্তত একটি রাত মেয়েটা যেন ঘরে গিয়ে দরজায় খিল লাগিয়ে ঘুমিয়ে থাকতে পারে।
মানুষের সব চাওয়া পূর্ণ হয় না। আলতাফের কাছে সেদিন একটি পয়সাও ছিল না। সে একদৃষ্টিতে দেখছিল। তাকে বশ করতে না পেরে মর্জিনা আরেকজনকে বশ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। বলা নেই কওয়া নেই, বছরের প্রথম বৃষ্টি হুট করে এসে ভিজিয়ে দিল আলতাফকে। তখনো চৈত্র মাস। বৃষ্টির জন্য কেউ প্রস্তুত ছিল না। ভিজতে থাকল রমনায় দাঁড়িয়ে থাকা অল্প কিছু মেয়েও। যেন তাদের বৃষ্টি হলেও লুকিয়ে যাওয়া মানা।
মর্জিনার আর বেশি বেগ পেতে হয়নি। ওই বৃষ্টিতেই সে খুঁজে পেয়েছিল সে রাতের খদ্দের। আলতাফের সামনে দিয়ে সে তার খদ্দেরের সঙ্গে রাতের অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। রেখে গেল আলতাফের হৃদয়ের গহিনে কেমন একটা টান। আলতাফ পরবর্তী সময়ে মর্জিনার ঠিকানা জোগাড় করে ফেলল। এগুলো অবশ্য খুব একটা কঠিন কোনো কাজও নয়। বহু বছর পেরিয়ে গেছে। আলতাফ বিয়ে করেছে, সংসার আছে, তবু মর্জিনার খোঁজ নিতে সে ভোলে না। মাঝে মাঝে খুব বৃষ্টির দিনে মর্জিনার আস্তানায় যায় সে। বছরের প্রথম দিনের বৃষ্টি, এক অলিখিত ক্যালেন্ডার যেন! এদিন মর্জিনার সঙ্গে দেখা হওয়া বাঞ্ছনীয়।
মর্জিনা জানালার ধারে ঠায় দাঁড়িয়ে। বৃষ্টির ঝাপটায় পুরোপুরি ভিজে গিয়েছে। তাতে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই তার। আজ বৃষ্টি দেখেই দরজায় খিল দিয়েছে সে। আজ আর কোনো খদ্দের তার ঘরে আসতে পারবে না। এ রকম রাতের জন্য সারাটা বছর অপেক্ষা করে থাকে সে। ওই লোকটার নাম জানে না সে। শুধু চেহারা চেনে। কত বছর আগের কথা।
লোকটির নিয়মে কেন ভুল নেই। ঝুম বৃষ্টির রাতে সে আসবেই। খালি হাতে আসবে না, দুহাত ভরে বাজার করে নিয়ে আসবে। মর্জিনা লোকটিকে বসিয়ে রেখে রান্না করতে থাকে। যত দ্রুত সম্ভব। রান্না শেষ হলে লোকটি মর্জিনার সঙ্গে বসে খায়। যা মর্জিনা বিশ্বাস করতে পারে না। কিন্তু এইটাই ঘটে। খাওয়াদাওয়া শেষ হলে মর্জিনার হাতে মুঠো ভরে কিছু টাকা গুঁজে দিয়ে লোকটা চলে যায়।
প্রথমবার তো নিতেই চায়নি মর্জিনা। লোকটির এক কথা, সে চায় অন্তত একটি রাত মর্জিনা স্বাভাবিক মানুষের মতো সম্মানের সঙ্গে ঘুমিয়ে কাটাক। এর বেশি সাধ্য নেই লোকটির। নইলে নাকি আরও দিত। মর্জিনা জানে না এই লোকটিকে কী বলে সম্বোধন করবে সে? ভাই নাকি ফেরেশতা? এ রকম মানুষ কি বর্ষাদিনে আল্লাহর উপহার? মর্জিনার কাছে বর্ষাদিন যেন রূপকথার গল্প। পৃথিবীতে একজন মানুষ তাকে তার প্রাপ্য সম্মানটুকু দেয়। তার সঙ্গে বসে তারই রান্না করা খাবার পরম আয়েশ করে খায়। বিনিময়ে কিছু চায় না! তার কেবল উদ্দেশ্য অন্তত একটা দিন মর্জিনার জীবনের চরম সত্যকে ভুলিয়ে দেওয়া। একটা দিনের জন্য হলেও মর্জিনার কষ্ট লাঘব করা। পৃথিবীতে এ রকম মানুষ আছে? বিশ্বাস হয় না তার।
ওই যে জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে চেনা একটি মুখ। হাতে বাজারের ব্যাগ নিয়ে হেলতে দুলতে হাঁটছে। বৃষ্টি এখনো গুঁড়ি গুঁড়ি। কিন্তু ছাতা নেই লোকটির সঙ্গে। মর্জিনা ছাতা খুঁজে বের করল। খুব ছাতা হারায় লোকটা। মর্জিনা তাই ছাতা কিনে রাখে। ফেরার সময় ছাতা দিয়ে দেয় সঙ্গে। বৃষ্টি না হলে তো আর এই পথে আসা হবে না লোকটির। মর্জিনা তাই অধীর আগ্রহে বসে থাকে বৃষ্টিদিনের জন্য।
...
কাজী সাবরিনা তাবাসসুম: মিলান, ইতালি।