বৃক্ষের সাক্ষ্য

মাসুক হেলাল
মাসুক হেলাল

আজিজ ভাই বয়সে আমার দ্বিগুণ। বাবার বয়সী না হলেও তাঁর ছোট ভাইয়ের বয়সী হবেনই। তবু তাঁকে ভাই ডাকার কারণ হলো, প্রবাসজীবনে আমি এলাকার যে বড় ভাইকে ‘ভাই’ ডাকি, তিনি তাঁর চেয়ে বড় আরেকজনকে ভাই ডাকেন। যিনি আবার আজিজ ভাইকে ভাই ডাকেন। লতায়–পাতায় ভাই আর কী। তা ছাড়া আমি এমন একটা বয়সে আছি, যখন কাউকে হঠাৎ আংকেল ডাকলে তিনি অন্য অর্থে নিয়ে অনুভূতিতে আঘাত পেতে পারেন।

যেমন, আমি এককালে আজিজ ভাইয়ের কাছাকাছি বয়সের একজনকে ভাই ডাকতাম। এক পার্টিতে তাঁর বড় মেয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় হলো। যে আমার তিন বছরের জুনিয়র। বাবাকে ভাই ডাকার কারণে সম্পর্কে আমি তার আংকেল হয়ে যাই তাহলে। অমন একটি মেয়ের কণ্ঠে আংকেল ডাক শোনার চেয়ে বধির হয়ে যাওয়া অনেক ভালো।

আমি সঙ্গে সঙ্গে তার বাবাকে আংকেল ডাকতে শুরু করলাম। সেই দিন থেকে ওই ভদ্রলোক আমার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিলেন। ডালাসের বাঙালি সমাজে ছড়িয়ে বেড়ালেন আমি নাকি তাঁর মেয়ের দিকে কুনজর দিই।

মানলাম তাঁর মেয়ে সাধারণের চেয়ে একটু বেশি সুন্দরী। গান, নাচসহ নানা গুণে গুণী। স্মার্ট। কথাও বলে সুন্দর করে। অমন মেয়েকে যেকোনো যুবক প্রেমিকা হিসেবে চায়। আমিও তখন ব্যাচেলর। কিন্তু তাই বলে আমার নামে এই অপপ্রচার? যেই শোনেন সেই গম্ভীর স্বরে বলেন, ‘যাহা রটে তাহা কিছু তো বটে!’

এদিকে এ ঘটনার পর আমার নিজের গার্লফ্রেন্ডের সঙ্গে গিট্টু বেঁধে যায়। সেও জেরার স্বরে বলে, সবাইকে বাদ দিয়ে তোমাকে নিয়েই কেন এমন গুজব রটে? নিশ্চয় তুমি কিছু করেছ!

যা হোক, মূল ঘটনায় আসি। আজিজ ভাই একজন বিপত্নীক মানুষ। তিন সন্তানের জনক। তাঁরা দেশের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন। বর্তমানে তিনি তাঁর তিন বেডরুমের বাড়িতে একা বাস করেন। বাগান করে সময় কাটান। তাঁর বাড়ির ব্যাক ইয়ার্ডকে তিনি বোটানিক্যাল গার্ডেন বানিয়ে ফেলেছেন।

তাঁর আরেক পরিচয়, তিনি একজন অবসরপ্রাপ্ত হোমিসাইড ডিটেকটিভ। ৪০ বছরের বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারে তিনি কাজ করেছেন শিকাগো পুলিশ ডিপার্টমেন্ট, ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (এফবিআই), ডালাস পুলিশ ডিপার্টমেন্টসহ সরকারের আরও কয়েকটি বিভাগে। রিটায়ার করার পর তিনি প্রাইভেট ডিটেকটিভের কাজও করেছেন কয়েক বছর। এখন পরিপূর্ণ অবসরজীবন যাপন করছেন।

আমি মাঝেমধ্যে তাঁর কাছে যাই তাঁর নানা কেস হিস্ট্রি শুনতে। বিচিত্র নাটকীয়তায় সাজানো সত্য সেসব ঘটনা শুনে শিহরিত হতে।

অনেক দিন ধরেই ভাবতাম, তাঁকে নিয়ে কোনো গল্প বা উপন্যাস লিখব। তিনি তা শুনে হেসে বলেন, ‘তুমি কি আমাকে শার্লক হোমস বানানোর ফন্দি করছ?

: আপনাকে শার্লক হোমস বানাব কী? আপনি তো শার্লক হোমসই।

তিনি এ কথা শুনে আরও হেসে বলেন, আরে গল্প–উপন্যাসের গোয়েন্দারা অনেক ব্রিলিয়ান্ট হন। তাঁরা একা একাই নানা কেস সলভ করে ফেলেন। আমাদের অনেকের কাছেই হাত পাততে হয়।

কথা সত্য। আজিজ ভাইয়ের কাছ থেকেই জানলাম, সামান্য হাতের লেখা শনাক্ত করার জন্যও তাঁদের ফরেনসিক ডিপার্টমেন্টে হ্যান্ডরাইটিং স্পেশালিস্ট আছেন। আছেন নানা ছোটখাটো কাজের জন্য আলাদা আলাদা স্পেশালিস্ট। আমাদের শার্লক হোমস একাধারে সাইকেলের টায়ার স্পেশালিস্ট, সিগারেটের ছাই স্পেশালিস্ট, ফুট প্রিন্ট স্পেশালিস্ট ইত্যাদি ইত্যাদি। ফরেনসিক ডিপার্টমেন্টে এসব স্পেশালিস্ট প্রত্যেকে আলাদা আলাদা ব্যক্তি। আলাদা আলাদা ডিপার্টমেন্ট। আজিজ ভাইয়ের ভাষায়, ‘অপরাধীর একক মস্তিষ্কের বিরুদ্ধে আমরা সম্মিলিত মস্তিষ্ক নিয়ে লড়ি। অপরাধী যত বুদ্ধিমানই হোক না কেন, ধরা তাকে পড়তেই হয়।’

তাঁর কাছ থেকেই শুনেছি কত বিচিত্র সব অপরাধের কাহিনি। কত রহস্যময় খুনের জট যা খুলতে খুলতে কেটে গেছে যুগের পর যুগ। তবু খুনিকে দাঁড় করানো হয়েছে কাঠগড়ায়। নিশ্চিত করা হয়েছে বিচার।

কথা না বাড়িয়ে তেমনই এক ঘটনার বর্ণনা করা যাক। বৃষ্টির দিনে কফির মগ হাতে যা শুনেছিলাম আজিজ ভাইয়ের কণ্ঠে। আমি তাঁর ভাষাতেই গল্পটি বলছি।

ঘটনা ঘটে ১৯৮১ সালে। আল কাপনের জন্য কুখ্যাত নগরী শিকাগোতে। শিলা নামের এক বাঙালি নারীর নিখোঁজ হওয়ার মধ্য দিয়ে।

শিলার বয়স তিরিশ বছর। দশ বছর হলো আমেরিকায় এসেছেন। স্বামীর নাম মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন। পেশায় ব্যবসায়ী। এ দেশে বেড়াতে এসে পরিবারটি স্থায়ীভাবে থেকে গেছে। আইনের মারপ্যাঁচে গ্রিন কার্ডও আদায় করে ফেলেছে।

আর দশটা সাধারণ বাঙালি সংসারের মতোই সাধারণ সংসার ছিল তাঁদের। স্বামী–স্ত্রীতে ঝগড়া হতো, আবার মিলও হয়ে যেত। তিন সন্তানের মায়ের তাই হঠাৎ গায়েব হয়ে যাওয়াটা আমাদের মনে একটু খটকা দিয়েছিল।

তখনো আমি সাধারণ ডিটেকটিভ। হোমিসাইড ডিপার্টমেন্টে মুভ করিনি। পুলিশ ডিপার্টমেন্টে আমাদের একটি প্রবাদ প্রচলিত আছে, সেটা হচ্ছে, ‘আউট লদের মধ্যে অপরাধী খোঁজার আগে, ইন লদের মধ্যে খোঁজ।’ বউয়ের অন্তর্ধানে আমরা প্রথমেই তাই স্বামীদের সন্দেহ করি। আর এখানে তো সন্দেহ করার সংগত কারণও ছিল। প্রথমত, এই মহিলার নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা পুলিশকে ১৫ দিন পর জানানো হয়েছিল। তাও জানিয়েছেন মহিলার একজন সহকর্মী। স্বামী এত দিন চুপ মেরে ছিলেন।

আর দ্বিতীয় কারণ ছিল, বাতাসে গুজব ভেসে বেড়াচ্ছিল, ভদ্রলোকের সঙ্গে নাকি তাঁর অফিসের এক নারীর পরকীয়া চলছে। এই পরকীয়ার কারণে যে আমরা কত মার্ডার কেস পেয়েছি।

তাই আমরা ধরেই নিলাম, মহিলার নিখোঁজ হওয়ার পেছনে তাঁর স্বামীই দায়ী।

এই পর্যন্ত বলে আজিজ ভাই জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কফির সঙ্গে কিছু খাবে? যদিও সঙ্গে যায় না, তবে টোস্ট বিস্কুট খেয়ে দেখতে পারো। প্যান্ট্রিতে আছে। নিয়ে নাও।

আমি গল্পে বিরতি একদমই পছন্দ করি না। তাই বললাম, আমি ঠিক আছি। আপনি বলুন।

তিনি আবারও গল্প শুরু করলেন।

সাধারণ প্রশ্নোত্তর করার জন্য আমরা বেলায়েত হোসেনকে সমন করলাম। তিনি নিখোঁজ স্ত্রীর ওপর যথেষ্ট রেগে ছিলেন। তাঁর বিশ্বাস স্ত্রীর কারোর সঙ্গে প্রেম ছিল। সে তার সঙ্গেই চলে গেছে।

‘আমার ধারণা, মাগি পলাইছে।’

আমার আমেরিকান সহকর্মী জিজ্ঞেস করলেন, হোয়াট ইজ মাগি?

বেলায়েত পুরো বাক্যটি ইংলিশে বললেও মাগি শব্দটি বাংলায় বলেছিলেন।

তিনি উত্তরে বললেন, মাগি মিনস স্লাট। প্রস্টিটিউট।

আমেরিকান সহকর্মী বললেন, কী কারণে তাঁকে স্লাট ডাকছ?

তিনি চোখের দৃষ্টি সরু করে বললেন, তোমার বউ আরেক ব্যাটার সঙ্গে ফষ্টিনষ্টি করলে তুমিও তোমার বউরে স্লাট ডাকবা!

এবার আমার আমেরিকান সহকর্মী জানতে চাইলেন, হোয়াট ইজ ফষ্টিনষ্টি?

বেলায়েত এবারও পুরো বাক্য ইংলিশে বললেও এই শব্দটি বাংলায় বলেছেন।

তাঁর কাছে শিলার চরিত্র সম্পর্কে নানা তথ্য পেলাম সেদিন।

‘ব্যাটা মানুষের সঙ্গে দেখা হইলেই বান্দি ঢলে ঢলে পড়ত। হাসির দমকে বুকের আঁচল ফেলে দিত। আমার আপন ভাইয়ের সঙ্গেই সে কতবার আকাম–কুকাম করার চেষ্টা করেছে। ছি, এসব কথা মুখে আনতেও ঘেন্নায় শরীর রি রি করে।’

যা হোক, অন্যের হাত ধরে স্ত্রীর পালিয়ে যাওয়ার ঘটনাটি এ দেশে তেমন বিরল না। সেটা ঘটলে আমাদের টেনশনেরও কিছু নেই। কিন্তু আমাদের নেগেটিভ চিন্তা মাথায় রেখেই এগোতে হয়। সে ক্ষেত্রে আমরা ধরেই নিলাম মেয়েটির সঙ্গে খারাপ কিছু ঘটেছে। কিন্তু বাড়ির দরজায় বা অন্য কোথাও যেহেতু ফোর্সড এন্ট্রি বা ধস্তাধস্তির লক্ষণ খুঁজে পেলাম না, কাজেই ধরে নিলাম মেয়েটি স্বেচ্ছায় বাড়ি ত্যাগ করেছে।

জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেল ঘটনার দিন (শনিবার) ভদ্রলোক বাড়িতেই ছিলেন। বিকেলের দিকে স্ত্রীর সঙ্গে পরপুরুষের মেলামেশা নিয়ে ঝগড়া হয়েছিল। তিনি রাগ করে তিন সন্তানসহ বাড়ি থেকে বের হয়ে গিয়েছিলেন। স্থানীয় মার্কেটে ঘোরাঘুরি করে সন্ধ্যায় বাড়িতে ফিরে দেখেন স্ত্রী বাড়িতে নেই। তখনই তিনি বুঝেছেন নষ্ট মেয়ে নষ্টামি করতে বাড়ি ছেড়েছে। তাই তিনি আর পুলিশকে জানানোর প্রয়োজন বোধ করেননি। তা ছাড়া বাঙালি সমাজে বদনামেরও ভয় ছিল।

ঘটনার সময়ে বেলায়েত হোসেন যে মার্কেটে ছিল, আমরা খোঁজ নিয়ে সেটা জানতে পেরেছি। তবে এটা সত্যি যে তাঁর যে পরকীয়ার গুজব বাতাসে ভাসছে, সেটাও আংশিক সত্যি। অফিসের ওই মেয়েটির সঙ্গে তিনি আসলেই প্রেম করার চেষ্টা করছেন। কাজেই তিনি ১০০ শতাংশ সন্দেহমুক্তও হতে পারেননি।

আমরা এবার বেলায়েত হোসেনের তথ্যমতে শিলার পরকীয়ার ব্যাপারে খোঁজখবর নিলাম। সে একটি গ্রোসারি স্টোরে কাজ করত। জানা গেল, জাস্টিন নামের এক সহকর্মীর সঙ্গে তার গভীর সম্পর্ক। লাঞ্চ আওয়ারে তারা একসঙ্গেই লাঞ্চ করে। এ ছাড়া তাদের মধ্যে নানা ছুতোয় হাসিঠাট্টা হয়ে থাকে। এ ছাড়া অন্য কোনো পুরুষের সঙ্গে তাকে তেমন মিশতে দেখা যায়নি।

শিলার নিখোঁজ হওয়ার পেছনে জাস্টিনও জড়িত থাকতে পারে।

দেখা গেল, ঘটনার দিন থেকে জাস্টিনও অফিসে আসেনি। পরপর তিন দিন সে ও শিলা দুজনই অফিস কামাই করেছে। চতুর্থ দিন জানা গেল সে হাসপাতালে। গাড়ি অ্যাকসিডেন্টে হাত–পা ভেঙে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। সন্দেহ স্বাভাবিকভাবেই তার দিকে ছিল। তবে তদন্তে ধরা পড়ল, তার ও শিলার মধ্যে স্রেফ বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিল। জাস্টিন একজন সমকামী। যা সেই যুগে আমেরিকান সমাজে খুবই লজ্জার বিষয় ছিল। কোনো এক বিচিত্র কারণে শিলা সেকেলে বাঙালি নারী হওয়া সত্ত্বেও তার কষ্ট, মনের অবস্থা বুঝত। তাই শিলাই ছিল তার সবচেয়ে কাছের বন্ধু।

ঘটনার দিন নিজের বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে আউট অব টাউন বেড়াতে গিয়ে ফেরার পথে তাদের গাড়ির অ্যাকসিডেন্ট হয়। গ্যাসস্টেশন ও রেস্টুরেন্টের রিসিট এবং তাদের সাক্ষ্য প্রমাণ করে জাস্টিন সত্য কথা বলছিল।

শিলার দেবরের সঙ্গে কথা বলে মনে হচ্ছিল শিলার মতো দুশ্চরিত্রা মেয়ে দ্বিতীয়টি নেই। আবার দুশ্চরিত্রের ঘটনা তদন্তে নেমে আমরা যখন তার পরিচিতদের সঙ্গে কথা বলছিলাম, তাঁরা সবাই বলছিলেন ওর সঙ্গে অন্য যুবকের প্রেমের গুজব তাঁরাও শুনেছেন। কিন্তু কেউই নির্দিষ্ট করে বলতে পারছিলেন না কার সঙ্গে তার পরকীয়া সম্পর্ক থাকতে পারে। যদি কেউ একটি তথ্যও দিতে পারতেন, তাহলে সেখান থেকেই আমরা কেস সলভ করে ফেলতে পারতাম।

কাজেই আমরা একদম আন্ধা গলিতে এসে পড়লাম। কীভাবে এগোব বুঝতে পারছি না। এদিকে অন্যান্য অপরাধকর্মের চাপে এই কেসটির ফাইলে ধুলো জমতে শুরু করল। আমাদের ভাষায়, এগুলোকে ‘কোল্ড কেস’ বলে। তা ছাড়া যদি আসলেই সে বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে পালিয়ে গিয়ে থাকে, তাহলে এর পেছনে এত এত সময় নষ্ট করার কোনো মানেও হয় না।

তিন বছর পরে আমরা একটি ব্রেক পেলাম। তত দিনে আমি হোমিসাইড কেস হ্যান্ডলিং শুরু করেছি।

শিলার দশ বছরের মেয়ে শিরিন, যে ঘটনার সময়ে সাত বছর বয়সী ছিল, সে একদিন আমাকে ফোন করে একটি মহাগুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানায়। সে জানায় তার স্পষ্ট মনে আছে এক বিকেলে তার বাবা যেদিন বাড়িতে ছিলেন না এবং তারা তিন ভাইবোন বেডরুমে খেলছিল, হঠাৎ কিচেনে মায়ের চিৎকার শুনে সে দরজার ফাঁকে এসে উঁকি দেয়। সে দেখে তার চাচা শাখাওয়াত হোসেন, যে শিকাগোরই আরেকটি সাবার্বে থাকে, সে শিলাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খাওয়ার চেষ্টা করছে এবং শিলা নিজেকে ছাড়ানোর জন্য চড়থাপ্পড় মারছে।

শেষে শিলা ছুরি হাতে নিতেই শাখাওয়াত তাকে ছেড়ে দেয় এবং বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়।

ছোট্ট সেই শিশুটির মনে আছে, সেই রাতেই বাবার সঙ্গে মায়ের ভয়াবহ ঝগড়া হয়েছিল। বাবা মায়ের গায়ে হাত পর্যন্ত তুলেছিল। এর দুই সপ্তাহের মধ্যেই শিলা গায়েব হয়ে যায়।

এই সেই শাখাওয়াত। বেলায়েতের ভাই। যার ব্যাপারে বেলায়েত বলেছিল, তার স্ত্রী নাকি শাখাওয়াতের সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা নিয়েছিল।

আমরা আরেকবার তদন্তে নামলাম। এবার সন্দেহ শাখাওয়াতের দিকে। যে শিলাকে কাগজ–কলমে বিয়ে দেখিয়ে আমেরিকায় আসতে পেরেছিল। যার ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে জানা গেল বিবাহিত হওয়া সত্ত্বেও পরনারীদের প্রতি ছোঁক ছোঁক করার অভ্যাস আছে। বাঙালি কমিউনিটির অনেকেই তার ওপর বিরক্ত। আমরা তার একজন বন্ধুকেও খুঁজে পেলাম, যার সঙ্গে তার বছরখানেক ধরে কোনো সম্পর্ক নেই। বন্ধুটির অভিযোগ, শাখাওয়াত তার স্ত্রীর সঙ্গেও অনৈতিক আচরণ করেছে। তবে আমাদের তদন্তে এই বন্ধুটিই সবচেয়ে বড় উপকার করেছিল।

আমি যেদিন ওর সঙ্গে প্রথম কথা বলতে ওর বাড়িতে যাই, আমার পরিচয় শুনেই সে নার্ভাস গলায় বলেছিল, ‘আপনি কি শিলা হোসেনের খুনের তদন্তে এসেছেন?’

আমি নিশ্চিত হয়ে গেলাম এই সেই সূত্র, যার সন্ধান আমরা তিনটা বছর ধরে করছি। এত দিন পর্যন্ত আমরা নিজেরাও সন্দিহান ছিলাম শিলা কী খুন হয়েছেন নাকি পালিয়ে গেছেন। এই লোকটি যে স্বরে ‘খুনের তদন্ত’ শব্দ দুটি উচ্চারণ করেছেন, বুঝতে পারলাম শিলা নিশ্চিত খুন হয়েছেন। তার মানে একটাই দাঁড়ায়, একে ঠিকমতো নাড়াচাড়া করতে পারলেই আমাদের কোল্ড কেস সলভ হয়ে যাবে।

আজিজ ভাই আবারও বিরতি নিলেন গল্পে। ঘড়ি দেখে বললেন, দাঁড়াও, আমি রাতের খাবারের জন্য মাংস চড়িয়ে দিই। তুমি খেয়ে যাবে? তাহলে ভাত বসাব।

আমি বললাম, আপনি ভাত খান না?

তিনি হেসে বললেন, না। খেতে পারি না বলা ভালো। আমার বয়সে খাওয়াদাওয়া খুব মেপে মেপে করতে হয়। রুটি বা ভাতের কার্ব আমার জন্য না।

আমি চোখ বড় বড় করে বললাম, বলেন কী? ভাত–রুটি না খেয়ে বাঁচেন কীভাবে?

তিনি আবারও হেসে বললেন, সালাদ খেয়ে। মাংসটা বসিয়ে দিয়ে বাগান থেকে লেটুস টমেটো বেছে আনতে হবে। অরগানিক সালাদের স্বাদই আলাদা।

আজিজ ভাই স্লো কুকারে মাংস বসিয়ে আমাকে নিয়ে বাগানে গেলেন। বৃষ্টি ততক্ষণে শেষ হয়ে গেছে। ঘাস, গাছ, পাতা সব ঝকঝক করছে। অনেকক্ষণ ধরে লেটুস, টমেটো, ধনিয়া, পুদিনাপাতা ইত্যাদি চাষাবাদ সম্পর্কে লেকচার দিলেন। আমার কোনো কালেই শাকসবজি খাবার ব্যাপারে আগ্রহ নেই। ছোটবেলায় মা যখন শাক খেতে বলতেন, আমি তখন বলতাম, আমি কি গরু যে ঘাস-পাতা খাব?

যা হোক, আজিজ ভাইকে আমি মনে করিয়ে দিলাম তিনি একটি গল্পের মধ্যে ছিলেন।

তিনি জিভ কামড়ে বললেন, ও আচ্ছা, ভুলেই গিয়েছিলাম। তো যা বলছিলাম, যদিও আমি নিশ্চিত ছিলাম না যে শিলা খুন হয়েছেন। তবু আমি কমান্ডিং স্বরে বললাম, জি, আমি সেই তদন্তেই এসেছি। এখন ভালোয় ভালোয় সব স্বীকার করলে আপনারই মঙ্গল হবে।

লোকটি নিজের চুল খামচে ধরে বলল, কেন যে সেদিন ওই হারামজাদার কথাটা মানতে গেলাম।

লোকটি ভেঙে পড়ল। আমি এর পূর্ণ ফায়দা লুটতে বললাম, এখন তো অতীত নিয়ে আর কিছু করার নেই। বরং আমাকে তদন্তে সাহায্য করলে আমি আপনাকে সাহায্য করতে পারব। আদালতে আপনার হয়ে সুপারিশ করতে পারব।

এ পর্যন্ত বলে আজিজ ভাই গলার স্বর পাল্টে বললেন, একটা ব্যাপার জানো কী মঞ্জুর, এ দেশে ক্রিমিনাল খুঁজে বের করা কিন্তু খুবই সহজ। আমাদের আসল ঝামেলা হয় সেই খুনিকে খুনের সঙ্গে লিংক করতে। অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। আদালতে যেন বিচারকদের মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহ না থাকে অপরাধের ব্যাপারে।

তারপর আজিজ ভাই আবার মূল গল্পে ফেরত গেলেন। তা আমার ধমকে কাজ হলো। সে ধীরে ধীরে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, চলুন, ওই বেঞ্চে বসে কথা বলি।

আমরা বাড়ির পাশের রাস্তার ওধারে বাসস্ট্যান্ডের বেঞ্চিতে গিয়ে বসলাম। লোকটি জানতে চাইল, আপনি ঘটনার কতটুকু জানেন?

আমি বললাম, আমরা ১০০ শতাংশ নিশ্চিত না হয়ে কারোর দিকে এগোই না।

লোকটি আবারও হতাশার নিশ্বাস ছেড়ে বলল, একটা সিগারেট ধরাতে পারি?

আমি অনুমতি দিলাম। সে সিগারেটে টান দিয়ে বলল, সে সময়ে আমি নতুন এ দেশে এসেছি। গ্যাসস্টেশনে অড জব করি। নিজের খরচ তুলতে পারি না। কোনো রকমে টিকে থাকার চেষ্টা করি। আমার তখনকার রুমমেট ছিল শাখাওয়াত। এমন কোনো কুকাম ছিল না যা সে করত না। মদ খেত, প্রস্টিটিউট ভাড়া করত, কাজে ক্যাশ রেজিস্ট্রার থেকে টাকা সরাত। ড্রাগসেরও বদভ্যাস ছিল তার। কুসঙ্গ সব সময় মধুর লাগে। তাই শাখাওয়াত আমার বেস্ট ফ্রেন্ড হয়ে গেল। ওর সঙ্গেই আমি প্রথম স্ট্রিপ ক্লাবে গিয়েছিলাম। সেখানে গিয়েই মদ ধরেছিলাম। তারপর কান টানলে মাথা আসার মতো মাঝেমধ্যে ড্রাগসও নিতাম।

এক শনিবারে কাজ থেকে আগে আগে ফিরেছিলাম। এসে দেখি শাখাওয়াত বাড়িতে। চেহারা উদ্‌ভ্রান্ত। কোমরের ওপরে খালি গা। তার বিছানায় এক মহিলা শোয়া। দেখে মনে হচ্ছে হয় ঘুম, নাহয় অজ্ঞান। মহিলার শরীরে কোনো কাপড় নেই।

শাখাওয়াত এর আগেও বাড়িতে বেশ্যা এনেছে। কিন্তু এই মহিলার চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছিল এ বাঙালি। জীবনে এই প্রথম কোনো বাঙালি মেয়ে আমার সামনে ন্যাংটা হয়ে শোয়া। আমি লোভাতুর গলায় জানতে চাইলাম কে সে?

শাখাওয়াত উত্তর দিল না। আমার সামনেই শ্বাস ভরে কোকেন নিল। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল, তুই শুবি?

আমি তখন অবিবাহিত। জীবনেও মেয়েমানুষের সঙ্গে শুই নাই। স্ট্রিপ ক্লাবে সুন্দর সুন্দর মেয়েরা ন্যাংটা হয়ে নাচে, কিন্তু শরীর ধরতে দেয় না। শরীরে হাত দিলে গার্ড ঘাড় ধরে ক্লাব থেকে বের করে দেয়। গার্লফ্রেন্ড পটাব, এই সাহসও নেই। প্রস্টিটিউট ভাড়া করব, সে পয়সাও নেই। সেই আমার সামনে এক নারী নগ্ন হয়ে শুয়ে আছে। আমার মাথা ঘুরে গিয়েছিল। আমি সেই অচেতন নারীকে রেপ করলাম। যেটা ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল।

এরপর শাখাওয়াত আরও কয়েকবার মেয়েটিকে রেপ করল। মেয়েটির তখনো পুরোপুরি জ্ঞান ফেরেনি। উ, আ–জাতীয় শব্দ করছে। বুঝলাম, ওকে ড্রাগস দেওয়া হয়েছে। হয়তো ইনজেক্ট করা হয়েছে। শাখাওয়াত বলল মেয়েটা তার ভাইয়ের বউ। তারপর জিজ্ঞেস করল, মালটা সুন্দর না?

আমি মাথা নেড়ে সায় দিলাম। আসলেই সে সুন্দরী।

তারপর আমার সামনেই শাখাওয়াত গলা টিপে তাকে খুন করল। ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। বাধা দিতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু শাখাওয়াত বলল যেহেতু আমিও রেপ করেছি, কাজেই এ বেঁচে থাকলে আমাকেও জেলে যেতে হবে। এ দেশে একবার জেলে যাওয়া মানে পুরো জীবন বরবাদ। আমি ঘাবড়ে গিয়ে ওর পক্ষ নিলাম।

এরপর শাখাওয়াত মহিলাকে একটা টিভির কার্টনে ভরে আমার সাহায্যে অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বের করে ট্রাকে (পিকআপ) রাখল। আমরা দুজন সামনের সিটে গিয়ে বসলাম। শাখাওয়াত গাড়িতে টান দিল।

আমি জিজ্ঞেস করলাম আপন ভাবিকে এভাবে মেরে ফেললেন, ভাই জানতে পারলে?

শাখাওয়াত বলল, ভাই জানবেই না। ভাবিকে যখন তুলে এনেছে, তখন ভাই বাড়িতে ছিল না। এখন যেহেতু সে জীবিত নেই, তাই কারোর জানারও উপায় নেই।

শিকাগো নদীর পাশে এক নির্জন জায়গায় আমরা গাড়ি থামালাম। ট্রাকের পেছন থেকে বাক্স টেনে মাটিতে রাখলাম। ট্যাংকে ডিজেল রাখা ছিল। ডিজেল ঢেলে সেই বাক্স পুড়িয়ে দিলাম। অনেকক্ষণ ধরে লাশটি পুড়ল। কিছুক্ষণ পরপর ডিজেল ঢেলে শাখাওয়াত নিশ্চিত করল আগুন যেন সব চিহ্ন নষ্ট করে দেয়। দেখতে দেখতে রাত শেষ হয়ে এল।

আমরা অবশিষ্টাংশ পানিতে ফেলে বাড়িতে ফিরে এলাম। ঘটনার কোনো সাক্ষী রইল না।

অনেক লম্বা বর্ণনা দিয়ে লোকটা মুখ ঢেকে ঝিম মেরে রইল। তারপর বলল, শুয়োরের বাচ্চাটা একদিন আমার বউকেও রেপ করতে চেয়েছিল। আমি পুলিশ ডাকার হুমকি দিলে সে বলে তাহলে নাকি আমাকেও জেলে ভরে দেবে। বিশ্বাস করেন, রেপ করলেও আমি কিন্তু মেয়েটিকে খুন করতে চাইনি।

লোকটি কেঁদে দিল। আমি চিন্তিত হয়ে গেলাম। লাশ ছাড়া খুনের ঘটনা আদালতে প্রমাণ করা অনেক কষ্টসাধ্য একটি ব্যাপার। তিন বছর আগে নদীতে ফেলে দেওয়া অঙ্গার থেকে লাশ খুঁজে বের করার আশা করা বৃথা।

আমি লোকটিকে সঙ্গে নিয়ে ঘটনাস্থলে গেলাম। অপরাধের কোনো চিহ্ন নেই। নদীর ওই পাশটা বৃষ্টির সময়ে পানির তলে তলিয়ে যায়। তিন বছরে বহুবার পানি সব এভিডেন্স ধুয়ে মুছে দিয়েছে। হতাশার দীর্ঘশ্বাস বেরোল। লোকটিকে রাজসাক্ষী বানালেও প্রমাণের অভাবে বদমাশটা না আবার ছাড়া পেয়ে যায়। মাটির স্যাম্পলসহ এলাকার প্রচুর ছবি তুলে অফিসে ফিরলাম।

ঘটনার সত্যতা প্রমাণ হবে কেবল একটি উপায়ে। ঘটনাস্থলে কোনো প্রমাণ পাওয়া গেলে। লাশ না পাওয়া গেলেও যদি সেই মাটিতে পেট্রোলিয়াম পাওয়া যায়, তাহলেও কেস দাঁড় করানো যাবে। কিন্তু আমরা নানা পরীক্ষা করেও এর চিহ্নমাত্র পেলাম না। পানিতে সব ধুয়ে গেছে।

এর মধ্যে জানতে পারলাম, লোকটি আর শাখাওয়াত হোসেন যৌথ উদ্যোগে একটি গ্যাসস্টেশনের ব্যবসা শুরু করেছিল। শাখাওয়াত সেই পার্টনারশিপের টাকা মেরে দিয়েছে। লোকটি যে সেই বদলা নিতে শাখাওয়াতকে ফাঁসানোর জন্য মিথ্যে গল্প ফাঁদেনি এটাই–বা প্রমাণ হবে কীভাবে? আমরা আবারও আন্ধা গলিতে পড়লাম।

কয়েক দিন পর হঠাৎ করেই ছবিতে লক্ষ করলাম লোকটির মতে যেখানে শিলার শবদেহ পোড়ানো হয়েছিল, ঠিক সেই স্থানেই মোটামুটি এক দুই ফুট দূরত্বে একটি ম্যাচিউরড ম্যাপলগাছ আছে। বিদ্যুৎ খেলে গেল আমার মস্তিষ্কে। ঘটনার সত্যতা প্রমাণ আমাকে গাছই দেবে। বৃক্ষের সাক্ষ্য গ্রহণ করে শিলা অন্তর্ধান রহস্যের সমাধান হবে।

আমি চোখ কপালে তুলে জিজ্ঞেস করলাম বৃক্ষের সাক্ষ্য মানে? গাছের কথা বোঝার মেশিনও কি আপনাদের কাছে আছে নাকি?

আজিজ ভাই হেসে বললেন, গ্রীষ্ম এবং বসন্তে ম্যাপলগাছের জড় তার শাখা–প্রশাখায় পানি ও পুষ্টি সরবরাহ করে, যা বড় সেলগুলোর গ্রোথে সাহায্য করে। আর সামার শেষে শীতের সময়ে যখন গাছ সুপ্তাবস্থায় যায়, তখন তারা অতি ঘন ও ছোট সেল তৈরি করে। এই সাইকেলটিই সেই রিং তৈরি করে যা আমরা কোনো ডাল কাটলে দেখতে পাই। প্রতিটা রিং সাক্ষী দেয় একটি করে বছর কেটে গেছে। যদি এই গাছের নিচে শিলাকে ডিজেলের সাহায্যে পোড়ানো হয়ে থাকে, তাহলে অবশ্যই এই গাছের ডালে সেই ঘটনার বর্ণনা লেখা থাকবে।

আমি এবার নড়েচড়ে বসলাম। ঘটনা এতক্ষণে ইন্টারেস্টিং লাগল আমার কাছে। আজিজ ভাইয়েরও চোখ বড় বড় হয়ে গেছে। এতক্ষণে তিনি তাঁর প্রিয় বিষয়ে কথা বলতে শুরু করেছেন। বৃক্ষ!

আমি করলাম কী গাছের পাঁচটা ডাল কাটলাম। তারপর রিং পরীক্ষা করলাম। যেহেতু ডিজেল গাছের জন্য বিষাক্ত উপাদান, তাই যদি আসলেই এই গাছের নিচে শিলাকে পোড়ানো হয়ে থাকে, তবে অবশ্যই এই গাছটি মাটি থেকে সেই ডিজেল শুষে নিয়ে থাকবে। এবং guess what? আমি দেখলাম তিন বছর আগের রিংটি অন্যান্য রিংয়ের তুলনায় একেবারেই দুর্বল ছিল। তার মানে কোনো না কোনো টক্সিক উপাদান গাছটি মাটি থেকে গ্রহণ করেছিল।

আমার রক্ত চনমন করে উঠল। যদিও এই পাতলা রিংই যথেষ্ট প্রমাণ নয়। কাঠের মধ্যে পেট্রোলিয়াম উপাদান থাকতেই হবে। না হলে ডিফেন্স অ্যাটর্নি সহজেই বলে দেবেন, অন্য কোনো বিষাক্ত উপাদানে এই রিংটি পাতলা হয়েছে। তাই আমি আমার বন্ধু, ড. জন শার্পের কাছে হাত পাতলাম। তিনি একজন অরগানিক কেমিস্ট, কলরাডো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর। তার কাছে গাছের টুকরোগুলো পাঠিয়ে বললাম এতে হাইড্রোকার্বনের উপস্থিতি আছে কি না টেস্ট করে জানাতে। হাইড্রোকার্বন হচ্ছে পেট্রোলিয়াম পদার্থের একটি কম্পাউন্ড। Bingo!

জন পাঁচটির মধ্যে দুইটি ডালে হাইড্রোকার্বনের উপস্থিতি পেল। সেই দুইটি ডালও গাছের সেই প্রান্তের যে প্রান্তে শিলাকে আগুনে পোড়ানো হয়েছিল।

কথাগুলো আজিজ ভাই খুবই উত্তেজনার সঙ্গে বললেন। যেন তিনি ফিরে গেলেন সেই ১৯৮৪ সালে, শিকাগোতে। যেদিন মাত্রই তাঁর একটি জটিল কেসের রহস্যের সমাধান হয়েছে।

ব্যস, আমরা শাখাওয়াতকে গ্রেপ্তার করলাম। প্রথম দিকে অস্বীকার করলেও আমাদের ইন্টারোগেশনে সে অপহরণ, রেপ ও খুনের কথা শিকার করল। আদালত তাকে ১৩৭ বছরের কারাদণ্ড দিল।

বেলায়েত হোসেন সেদিন কোর্টে খুব কেঁদেছিলেন। আপন ভাইয়ের বিশ্বাসঘাতকতার চেয়েও তাঁকে সেদিন নিজের স্ত্রীকে বিশ্বাস না করার অপরাধ দংশন করছিল।

তিনি সেদিন আমার হাত চেপে ধরে বলেছিলেন, শিলা যেদিন আমাকে বাবুর (শাখাওয়াতের ডাকনাম) দুশ্চরিত্রের কথা বলেছিল, আমি তাকে অবিশ্বাস করেছিলাম। সেদিন যদি আমি তার কথা বিশ্বাস করতাম, আজকে হয়তো সে বেঁচে থাকত!

আজিজ ভাই দীর্ঘ গল্প শেষে থামলেন।

আমার অবাক ভাব তখনো কাটেনি। হাতের কফির দ্বিতীয় মগ অনেকক্ষণ ধরেই খালি ছিল। সেটা কিচেনে রাখতে গেলে তিনি বললেন, আমার ডিশ ওয়াশার অনেক দিন ধরেই নষ্ট। যদি কিছু মনে না করো, কাপটা ধুয়ে কেবিনেটে তুলে রাখবে প্লিজ?

আমি বললাম, ভাইয়া, ঘটনাটা কী আমি আমার কোনো গল্পে ব্যবহার করতে পারি?

তিনি শুনে হেসে বললেন, করতে পারো। কিন্তু তোমার পাঠক পছন্দ করবে?

জবাব দিলাম না। পাঠকের মন বোঝা আসলেই কঠিন।

আজিজ ভাই নিশ্বাস ফেলে বললেন, জানো মঞ্জুর, তুমি তো জানোই যে আমি অতটা ধার্মিক নই। তবে শুনেছি কেয়ামতের দিনে নাকি আমাদের শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আমাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে। যে স্থানে পাপ করা হয়েছে, সেই স্থান আমাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে। হোমিসাইড ডিটেকটিভের দীর্ঘদিনের চাকরিতে এই একটা ইন্টারেস্টিং ব্যাপার আমার মনে গেঁথে গেছে। আসলেই আমাদের সব অপরাধকর্ম আমাদের অপরাধের স্থানে, আমাদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গে রেকর্ড হয়ে থাকে। আমাদের শরীরের ডিএনএ আমাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেয়। যেমন এই গল্পে একটি গাছের সাক্ষ্যের কারণে শাখাওয়াতের মতো নরপশুকে আমরা জেলের ভাত খাওয়াতে পেরেছিলাম।