বুকের মধ্যে প্রতিনিয়ত রক্তক্ষরণ হয়

লেখিকা
লেখিকা

ছোটবেলায় একটা গান শুনেছিলাম—‘বেইচ্চা লাইছি জায়গা জমিন, বেইচ্চা লাইছি ঘর, যেমনে পারস তোরা আমার ভিসা ম্যানেজ কর।’

এ গানের কলির সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষের বাস্তব জীবনের কোনো ভিন্নতা নেই। কিন্তু প্রশ্ন বিদেশে যাওয়ার জন্য কিংবা বিদেশি হওয়ার জন্য আমাদের এত উন্মাদনা কেন? প্রথম কারণ অর্থনৈতিক মুক্তি আর দ্বিতীয় কারণ নিরাপত্তা। তা জীবন, সম্পদ বা সম্ভ্রম, যাই হোক না কেন। আর আমার কাছে পাপ থেকে মুক্ত থাকাটাই বড় কারণ। ঘুষ আর তদবির বাংলাদেশের নাগরিকদের জীবনের একটি অংশ।
কয়েক বছর আগে আমার বাবা-মা হজে গিয়েছিলেন। প্রত্যেক হজযাত্রীর পুলিশ ভেরিফিকেশন করতে হয়। আমার বাবা-মারও তাই হয়েছিল। পুলিশ রাত এগারোটায় আমাদের বাসায় এসেছিল। আমার বাবা-মা একা থাকতেন। আলাপচারিতায় পুলিশের লোক যখন জানল, তাদের এক মেয়ে লন্ডন আর আরেক মেয়ে আমেরিকায় থাকে তখন পুলিশের লোক আমার বাবাকে জানাল, তাদের ঠিকানায় সমস্যা আছে। অনেক শক্ত কেস। দশ হাজার টাকা লাগবে।
আমার ৭০ বছরের সরল বাবা ভয় পেয়ে জানতে চেয়েছিলেন কি সমস্যা?
পুলিশ জানাল সারা দিন খুঁজে তারা ঠিকানা পায়নি, অনেক কষ্ট করে অবশেষে খুঁজে পেয়েছে।
আমার বাবা বুঝে গিয়েছিলেন টাকা ছাড়া পুলিশ কাজ করবে না। অত রাত ঘরে টাকা না থাকায় আমার বাবা আমার আরেক বোন, যে তার পাশে থাকত তাকে ফোন দিলেন। আমার ভগ্নীপতি যিনি স্থানীয় সাংবাদিক তাকে দেখে পুলিশ বলল, আপনি সাংবাদিক সাহেবের আত্মীয় পাঁচ হাজার দিলে চলবে এবং তাই দেওয়া হলো। পাপমোচনের যে হজ--তার যাত্রা শুরু পাপের মাধ্যমে!
ঘুষ ছাড়া পুলিশ ভেরিফিকেশন, একবার ভাবুনতো। আপনার দীর্ঘশ্বাস চেপে রাখুন। শোনার মানুষ নেই।
দুই বছর আগে দেশে গিয়েছিলাম। অসুস্থ বাবাকে নিয়ে সিলেট যাব। ট্রেনে কেবিন হলে ভালো হয়। ভাই স্টেশন থেকে ফেরত এল। বলল টিকিট নাই। ক্ষমতাধর কেউ না থাকলে কেবিন পাওয়া যাবে না। অবশেষে আমার অতি কাছের বন্ধুর সহযোগিতায় টিকিট মিলল। আমি সত্যিই তার কাছে কৃতজ্ঞ। তবে দুঃখিত এই ভেবে যে, ট্রেনের একটা ভালো টিকিটের জন্য তদবির করতে হলো বলে। আমি সত্যিই দুঃখিত বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের জন্য। যাদের জীবন ক্ষমতাধরদের জিম্মায়। যারা সমাজের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক। ট্রেনের প্রথম শ্রেণির টিকিট বা কেবিন তাদের জন্য নয়। তারা সত্যিই অসহায়।
আমি অতি দরিদ্র পরিবারের সন্তান। নদী আমাদের বাপ-দাদার বসতভিটা কেড়ে নিয়েছে। অবসর গ্রহণের পর আমার বাবা তার সব সঞ্চয় দিয়ে একটি জমি কিনেছিলেন। জমি বললে ভুল হবে। বলতে পারেন গড়-খন্দক। আস্তে আস্তে সে জমি ভরাট হলো। ভাই-বোনরাও প্রতিষ্ঠিত হলো। মা ভাবলেন বাড়ি করবেন। কিন্তু একদিন সেই জমি চলে গেল ভূমিদস্যুদের দখলে। রাজনৈতিক পরিচয়ধারী ওই ব্যক্তিকে স্থানীয় সবাই ভূমিদস্যু হিসেবে চেনেন। চেনে না কেবল পুলিশ। অবশেষে আবারও ছুটতে হলো ক্ষমতাধরদের পেছনে। স্থানীয় নেতারা বললেন, কোটি টাকার জমি, পনেরো-বিশ লাখ টাকা খরচ করলে তারা একটা সমাধান করে দেবেন। আগেই বলেছি, আমরা দরিদ্র, জমির দাম কোটি টাকা হলেও আমার বাবার বিশ লাখ টাকা নেই তা সমাধানের জন্য। রক্ষক যখন ভক্ষক তখন বিচারই বা কার কাছে চাইবে বলুন!
আমার এক বন্ধু তার পৈতৃক জমি বিক্রি করেছেন আড়াই কোটি টাকায়। ক্ষমতাধরেরা এসে বলল, তাদের পঞ্চাশ লাখ দিতে। আর না দিলে জান, মাল, ইজ্জত বা তার চাইতে বেশি কিছু দিতে হতে পারে। টাকার থেকে জীবনে মূল্য অনেক বেশি। তাই হয়তো বা যা দাবি তা মানতে হবে। আমার আরেক প্রবাসী বাঙালি বন্ধুর ঢাকার এক অভিজাত এলাকায় পৈতৃক বসতভিটা রয়েছে। গত তিন বছর ধরে তারা যত বারই বাড়ির খাজনা দিতে গিয়েছেন, তাদের কাছ থেকে খাজনা নেওয়া হয়নি। কারণ জিজ্ঞেস করলে বলে আপনাদের খাজনা দিতে হবে না। কেন জানতে চাইলে বলা হয়, আমরা বলতে পারব না। তারা তত দিনে বুঝে গিয়েছিলেন তাদের বাড়ির ওপর কারও কাল ছায়া পড়েছে। খাজনা না দেবার কারণে বাড়িটি নিলামে ওঠানোই হয়তোবা তাদের পরিকল্পনা। অবশেষে এক উচ্চপদস্থ আত্মীয়ের সহযোগিতায় তারা ওই যাত্রায় খাজনা দিতে পেরেছেন। তবে মনের মধ্যে শঙ্কা জেগেছে বাড়িটি হারাবার। বাংলাদেশের দরিদ্র বা মধ্যবিত্ত যার একখণ্ড জমি আছে কিন্তু ক্ষমতা নেই, এ রকম গল্প তাদের ঘরে ঘরে। আর হিন্দুদের সম্পত্তি তার কথা না-ই-বা বললাম!
আশি বা নব্বইর দশকে প্রবাসীরা তাদের রক্ত ঘামানো সব টাকা দেশে বিনিয়োগ করেছিলেন। এদের অধিকাংশই খেটে খাওয়া মানুষ। যারা বিদেশে বাড়ি ঘর কেনেননি, সমস্ত সঞ্চয় দিয়ে দেশে জমি কিনেছেন বা ব্যাংকে জমা রেখেছেন, তাদের বেশির ভাগের জমি আর টাকা আজ ক্ষমতাধরদের দখলে। যে দেশে ব্যাংক থেকে হাজার কোটি টাকা চুরি হওয়া বা জমি দখল অতি স্বাভাবিক ঘটনা সেখানে তাদের দেশপ্রেমের দাম কে দেবে কিংবা মালের নিরাপত্তাও বা কে দেবে?
আবারও বলছি রক্ষক যখন ভক্ষক তখন বিচার-ই-বা কার কাছে চাইবে বলুন। তাদের দুর্দশা দেখে আজ অনেক প্রবাসী সাহস করেন না দেশে বিনিয়োগ করতে। প্রবাসীরা বুঝে গেছেন, দেশে টাকা নেওয়া সহজ, কিন্তু ফিরিয়ে আনা অনেক কঠিন। দেশের হাউজিং মার্কেটের মূল্যধসের পেছনে প্রবাসীদের এই মনোভাবের একটা বিশাল প্রভাব রয়েছে।
একাত্তরে আমাদের বাসা লুট হয়েছিল। মূল্যবান-মূল্যহীন সব লুটে নিয়েছিল। তবে পাকিস্তানি হানাদারেরা নয়। প্রতিবেশী বাঙালিরা। আমার বাবা খুব শখ করে একবার হরিণ শিকার করেছিলেন। সেই হরিণের চামড়ায় সব সময় নামাজ পড়তেন। আর সে কারণে বাবার দুই পায়ের ছাপ সেই চামড়ায় পড়ে গিয়েছিল। স্বাধীনতার বহু বছর পর সেই চামড়াটি দেখা গেল আমাদের এক প্রতিবেশীর ড্রয়িং রুমের দেয়ালে। আমার মা প্রথমবার যখন সেটি দেখেছিলেন। তার চোখ বাষ্পীভূত হয়েছিল। তার শরীরের কাঁপুনি আমাকেও কাঁপিয়েছিল। আমি ছোটবেলা থেকে এ চামড়াটির অনেক গল্প শুনেছিলাম। আর এই প্রথম তা দেখেছিলাম। আর তা সঙ্গে সঙ্গে স্পর্শ করেছিলাম। ইদানীং বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের লুটপাট হচ্ছে। ওরাও হয়তো ওদের প্রিয় জিনিসগুলো ওদের কোনো প্রতিবেশীর ঘরে বা ড্রয়িংরুমে পাবে।
আমাদের যখন লুট হয়েছিল আমরা ছিলাম পরাধীন। তাই সব হারিয়েও আমরা বেঁচে ছিলাম স্বাধীন হওয়ার স্বপ্নে, মুক্ত হওয়ার স্বপ্নে। এখন প্রায়ই সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর লুট হচ্ছে, আগুন জ্বলছে। আজ তারা স্বাধীন দেশের পরাধীন নাগরিক। যাদের চোখে শুধু হতাশা আর ভয়।
আমার শ্বশুরের ক্যানসার হয়েছিল। কেমোথেরাপির জন্য ভারতে নিয়ে যাওয়া হতো। ভারতে যে ওষুধের দাম ছিল দশ হাজার টাকা বাংলাদেশে তার দাম ছিল ষাট হাজার টাকা। অসুস্থ হয়ে একবার যে হাসপাতালে যায়, সেই জানে চিকিৎসার খরচ কত! সেবা আর মান সেটা আর নাই বা বললাম। অনেক প্রবাসী শেষ বয়সে দেশে ফিরতে চান। কিন্তু চিকিৎসাসেবার কথা চিন্তা করে পিছু হটেন। রয়ে যান প্রবাসে পরবাসে।
আমি কয়েকজনের ওপর জরিপ চালিয়েছিলাম। তাদের সবার কাছে আমার প্রশ্ন ছিল—তারা কেন বিদেশি নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছেন। সবারই প্রথম উত্তর ছিল নিরাপত্তা। একজন বলল, তিনি সারা দিন বাচ্চাকে নিয়ে প্রাইভেট মাস্টারের কাছে দৌড়াতে চান নাই। বললেন, বাচ্চা স্কুলে যায়, বাসায় পড়ে, আমি তদারকি করি, ঝামেলা নাই। আরেকজন বললেন, বছরে কয়েক লাখ টাকা খরচ করে দেশে বাচ্চাকে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়াতাম। আর এখানে বিনা বেতনে আমার বাচ্চা একই মানের স্কুলে পড়ে। অনেক শান্তি। এক ভাই বললেন, যত দিন মর্টগেজ দিই, বাড়ি আমার, দখল, লুটপাট, ভাঙচুর কোনো ঝামেলা নাই। আরেকজন বললেন, ব্যবসা করি, চাঁদাবাজি নাই, মাস্তানি নাই। আরেকজন বললেন, ট্যাক্সি চালাই, বাবুর্চিগিরি করি বা যেকোনো ছোট কাজ করি, সবাই আমাকে সম্মান দেখায়। একটা মানসম্মত জীবনযাপন করছি। আরেকজন বললেন, তার কয়েকটি বাড়ি আছে, ভাড়া পান। সমস্যা হলে আদালত আছে, জজ-পুলিশকে ঘুষ দেওয়ার দরকার হয় না। এক ভাবি বললেন, ইচ্ছে মতো গয়না পরে হাঁটেন। ছিনতাই হওয়ার ভয় নাই। একজন বললেন মুসলমান হয়ে জন্ম নিয়েছি দেশে আর মুসলিম ধর্ম কি তা শিখেছি বিদেশে এসে। বিদেশ আমাকে ধর্ম চর্চা শিখিয়েছে। বাঁচার জন্য ঘুষ খেতে হয় না বা দিতে হয় না, মিথ্যা বলতে হয় না। নিজেকে বড় পবিত্র মনে হয়। আরেকজন বললেন, দেশে থাকতে বর্ণবাদী ছিলাম, কালো মেয়েদের অবজ্ঞা করতাম, ফরসা মেয়েদের সুন্দরী ভাবতাম, কাজের লোককে একই টেবিলে বসে খেতে দিতাম না। বরিশাল-নোয়াখালীর লোকদের দেখতে পারতাম না। এখন বুঝি সবই অন্যায় ছিল, বর্ণবাদী আচরণ ছিল।
আমি মাঝে মাঝে ভাবি, যদি বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতাম তাহলে শিক্ষক হওয়ার আগে শিক্ষক হওয়ার জন্য তদবির করতে হতো। শিক্ষক হওয়ার পর সাদা আর নীল দলের ছায়ায় রাজনৈতিক চাটুকারিতায় নিজেকে জড়াতে হতো। শিক্ষার্থীদের শিক্ষাদান বাদ দিয়ে হয়তোবা consultancy করে বেড়াতাম। বুদ্ধি বিবেচনা বিসর্জন দিয়ে হয়তো টকশোর বুদ্ধিজীবী হতাম। এখন যোগ্যতার বলে শিক্ষক হয়েছি, যোগ্যতার বলে পদোন্নতি পেয়েছি। রাজনীতি নেই, চাটুকারিতা নেই। শিক্ষকতা করি, গবেষণা করি, শিক্ষার মান ও শিক্ষার্থীদের স্বার্থ রক্ষায় আন্দোলনও করি। অনেক শান্তি, নিজেকে পাপে জড়াতে হয় না।
এত শান্তি আর নিরাপত্তা। তারপরও বুকের মাঝে আছে একটা চাপা কষ্ট। স্বজনকে কাছে না পাওয়ার কষ্ট। নাড়ির টান ছেঁড়ার কষ্ট। যে মেঘনার পাড়ে আমার জন্ম তার জল আর বাতাস আজও আমাকে ডাকে। ডাকাতিয়ার ডিঙি নায়ে আজও মন ভেসে চলে। স্বপ্নে আজও হেঁটে বেড়াই আমার সেই প্রিয় আমতলা, বকুলতলা আর জবাতলায়। ছোটবেলায় আমি অনেক পয়সা রোপণ করেছি একটি টাকার বৃক্ষের জন্য। আজ আমি বৃক্ষ পেয়েছি কিন্তু মাটি হারিয়েছি। বুকের মধ্যে প্রতিনিয়ত রক্তক্ষরণ হয়। এ যন্ত্রণা কেবল সেই বোঝে যে প্রবাসী হয়েছে। আজ যাদের জন্য আমরা প্রবাসী জীবন বেছে নিয়েছি, যখন দেখি প্রবাসীদের পাঠানো বৈদেশিক মুদ্রা তারাই হরিলুটে ব্যস্ত, বুকের কষ্টটা আরও বেড়ে যায়। আগ্নেয়গিরির মতো জ্বলে-পোড়া মন তারপরও আশা দেখে, আগুনের দিন শেষ হবে একদিন।

*ড. নুরুন নাহার বেগম: সহযোগী অধ্যাপক, East Stroudsburg University of Pennsylvania, USA.