বুকমার্ক কানাডা প্রোজেক্ট
বুকমার্ক প্রজেক্ট ভাবনাটি আমার বেশ ভালো লাগে। বইকে, বইয়ের লেখককে, লেখার বিষয়কে যে এমন করেও পথচারীদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া যায় সেটা বোধ করি এই প্রকল্পের সঙ্গে পরিচিত না হলে জানা হতো না। ২০০৯ সালে প্রথম বুকমার্কটি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয়েছিল। ৮ ডিসেম্বর ২০১৮তে টরন্টোর লেকশোর বুলভার্ডে করা হলো বাইশতমটি। এবারে যে-কানাডীয় লেখক সম্মানিত হলেন তিনি হলেন কবি ও কথাকার ডিওন ব্রান্ড।
বুকমার্ক কানাডা প্রকল্পে কী করা হয়? লোক চলাচলের জায়গায় একটি ফলক স্থাপন করা হয়। এমনভাবে সেটি করা হয় যাতে পথচারীদের দৃষ্টি সহজেই আকর্ষিত হতে পারে। ফলকে উৎকীর্ণ থাকে কোনো একজন কানাডীয় কবি বা লেখকের কোনো বইয়ের কয়েকটি লাইন। এমন কিছু লাইন নির্বাচন করা হয় যেগুলো যে-স্থানে ফলক স্থাপন করা হয়েছে সেই স্থান বা সেখানকার মানুষদের সঙ্গে সম্পর্কিত। এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য হলো পথচারীদেরকে তাদের চলাচলের জায়গাটি কীভাবে সাহিত্যে স্থান পেয়ে আছে সেটি চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো। এতে সম্ভাবনা থাকে ওই বইটি পড়ার ব্যাপারে পথচারীদের মধ্যে আগ্রহ সৃষ্টি হওয়ার।
বুকমার্ক কানাডা প্রকল্পের প্রথম ফলকটি ছিল দেশের অগ্রগণ্য সাহিত্যিক মাইকেল ওনডাডজির বিখ্যাত উপন্যাস ‘ইন দ্য স্কিন অব অ্যা লায়ন’ থেকে। গত শতাব্দীর বিশ ও ত্রিশের দশকে যখন নতুন অভিবাসীদের রক্ত-ঘামে গড়ে উঠছে টরন্টো শহর, সেই সময়টি উঠে এসেছে ওনডাডজির ওই উপন্যাসে। নতুন শহর বিনির্মাণে বিশাল ভূমিকা রেখেছিল টরন্টোর ডন নদীর দুই পার্শ্বের দুটি এলাকার সংযোগ সেতুটি। ১৯১৮ সালে জনগণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া ওই সেতুটি নির্মাণে অভিবাসীদের অবদানকে চিত্রিত করা হয়েছে ওই উপন্যাসে।
ওই সেতুটির পূর্ব প্রান্তে স্থাপিত ফলকে ১৯৮৭ প্রকাশিত ‘ইন দ্য স্কিন অব অ্যা লায়ন’ উপন্যাসের এমন একটি অংশ উদ্ধার করা হয়েছে। সেখানে আমরা দেখতে পাই নির্মাণকালে সেতু শ্রমিকদের অনিশ্চয়তা, জীবন-মৃত্যুর দোলাচলে সময় কাটানো। প্রথম ফলকটির উদ্বোধনকালে সাহিত্যিক মাইকেল ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন টরন্টোর মেয়র ডেভিড মিলার। বিশ্ব বই দিবসের কথা মাথায় রেখে অভাবিতপূর্ব এই প্রকল্পের প্রথম ফলকটি উদ্বোধনের তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছিল ২৩ এপ্রিল।
টরন্টোতে গত এক দশকে আরও যে ফলকগুলো স্থাপন করা হয়েছে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে শহরটির প্রথম পোয়েট লরিয়েট ডেনিস লি’র শিশুতোষ ছড়া গ্রন্থ ‘দ্য ক্যাট অ্যান্ড দ্য উইজার্ড’, বর্তমান পোয়েট লরিয়েট অ্যান মাইকেলসের উপন্যাস ‘ফিউজিটিভ পিসেস’ এবং কেন ব্যাবস্টকের কবিতা ‘এসেনসিয়ালিস্ট’। অন্টারিও প্রদেশের আর যে যে শহরে বুকমার্ক কানাডা প্রোজেক্টের উদ্যোগে ফলক প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে সেগুলো হলো: টেরি গ্রিগস রচিত ‘রগস’ ওয়েডিং’ (ওয়েন সাউন্ড), ব্রনওয়েন ওয়ালেস রচিত ‘মেক্সিকান সানসেটস’ (কিংস্টন), মেরিলিন সাইমন্ডস রচিত ‘দ্য কনভিক্ট লাভার’ (কিংস্টন), এলিজাবেথ হে রচিত ‘গার্বো লাফস’ (অটোয়া), জেফ ল্যাটোসিক রচিত ‘সঙ ফর দ্য ফিল্ড বাহাইন্ড মিসিসাগা ভ্যালে পাবলিক স্কুল’ (মিসিসাগা), সিলভিয়া মলটাশ ওয়াশ রচিত ‘দ্য কুইন অব আনফরগেটিং’ (মিডল্যাল্ড), জন টার্পস্ট্রা রচিত ‘টু অর থ্রি গিটারস’ (হ্যামিলটন), র্যাচেল প্রেস্টটন রচিত ‘দ্য ফিশারস অব প্যারাডাইজ’ (হ্যামিলটন), সিরি-লি অলসন রচিত ‘সেইলর গার্ল’ (পোর্ট কলবর্ন), লরেন্স হিল রচিত ‘এনি নোন ব্লাড’ (ওকভিল) এবং ম্যাথু হেইটি রচিত ‘দ্য সিটি স্টিল ব্রিদিং’ (সাদবেরি)।
অন্টারিওর বাইরে ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার ভিক্টোরিয়াতে স্থাপন করা হয়েছে চিনা বংশোদ্ভূত বিশিষ্ট লেখক ওয়েসন চয়ের ‘জেড পিওনি’ থেকে। একটি মাত্র উপন্যাস লিখে স্বদেশে এবং বিদেশে খ্যাতি অর্জনকারী লেখক অ্যালিস্টর ম্যাকলয়েডের ‘নো গ্রেট মিসচিফ’ উপন্যাস থেকে উদ্ধার করা হয়েছে নোভা স্কোশিয়াতে। উল্লেখ করা যেতে পারে অ্যালিস্টর রচিত এই উপন্যাসটি ১৯৯৯ সালে ট্রিলিয়াম বুক অ্যাওয়ার্ড এবং ২০০১ সালে ডাবলিন সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেছিল।
সর্বোচ্চ পাঁচবার গভর্নর জেনারেল সাহিত্য পুরস্কার বিজয়ী লেখক হিউ ম্যাকলেনানের ‘ব্যারোমিটার রাইজিং’ (১৯৪১) থেকে উৎকলন করা হয়েছে হ্যালিফ্যাক্স শহরে। সেলিব্রিটি লেখক ক্যারল শিল্ডসের ‘দ্য রিপাবলিক অব লাভ’ (১৯৯২) থেকে উৎকলন হয়েছে উইনিপেগে, ১৯১০ ও ১৯২০ এর দশকে কানাডার সবচেয়ে জনপ্রিয় কথাশিল্পী লুসি মড মন্টগোমারির ‘দ্য গ্যাবেল উইনডো’ কবিতা থেকে উৎকলন হয়েছে পিইআই-এর ক্যাভেনডিশ শহরে। পাঠকের জানা থাকতে পারে, প্রায় আট দশক আগে প্রয়াত এই কথাকারের কাব্য সংকলনটি প্রকাশিত হয়েছে ২০১৮ সালে। নিউ ফাউন্ডল্যান্ডের উডি পয়েন্ট শহরে তুলে ধরা হয়েছে আল পিটম্যান রচিত ‘দ্য সি ব্রিজ লাউঞ্জ’ (২০১২) কবিতা থেকে। কবিতাটি অন্তর্ভুক্ত আছে আলের ‘থার্টি ফর সিক্সটি’ কাব্যগ্রন্থে।
টরন্টো শহরের প্রাক্তন পোয়েট লরিয়েট ৬৫ বছর বয়স্ক ডিওন ব্রান্ড বর্তমানে কানাডার সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। সব্যসাচী লেখক ডিওন রচিত গ্রন্থসংখ্যা ত্রিশের মতো। ২০১৭ সালে তিনি ‘অর্ডার অব কানাডা’ পদবিতে বরিত হয়েছেন। ২০১৮ সালে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর মুক্তকাব্যের বই ‘দ্য ব্লু ক্লার্ক’। বহুল প্রশংসিত সেই উপন্যাস ছাড়াও একই বছরে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর আরেকটি উপন্যাস ‘থিওরি’। ‘নভেল অব আইডিয়াস’ ধারার এই উপন্যাসটি নিয়েও চলছে ব্যাপক আলোচনা। টরন্টো শহরের গল্প নিয়ে ২০১৭ সালে তাঁর সম্পাদিত ‘দ্য আনপাবলিশ্ড সিটি’ প্রকাশিত হয়েছিল। জানিয়ে রাখা যেতে পারে সে-গ্রন্থে টরন্টোর তিন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত লেখকের রচনাও অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। ২০১৮ সালে টেসা ম্যাকওয়াট এবং রবীন্দ্রনাথ মহারাজের সঙ্গে ডিয়োন যৌথভাবে সম্পাদনা করেন ‘লুমিনাস ইনক: রাইটারস অন রাইটিং ইন কানাডা’ নামের বই।
বুকমার্ক কানাডা প্রোজেক্টে ডিয়োনের যে বই থেকে উৎকলন করা হলো সেটি একটি উপন্যাস। শিরোনাম ‘লাভ ইনাফ’। ২০১৪ সালে প্রকাশিত উপন্যাসটির তিয়াত্তর পৃষ্ঠা (প্রকাশক: আলফ্রেড কে নফ, টরন্টো, ২০১৪) থেকে যে বাক্যগুলো উৎকলন করা হয়েছে সেগুলো হলো:
The woman is brooding, so he is quiet. Every six months there’s an inspection on this car, he has to do this to keep the plates, then there’s the gas, then there’s the other driver, who is always crying about money as if Da’uud doesn’t have enough children of his own. Of course this is not what he would have done if there was any other way but there was no sense thinking about that. The heart is sore. Before you know it you’ve been driving a cab for ten years. The cab flies along the lake at the south of the city to Sunnyside.
“Where in Sunnyside?” he says when they are near to Parkside Drive.
“Just here,” the passenger says.
ইতিমধ্যে ঘোষণা হয়েছে বুকমার্ক প্রজেক্টের তেইশতম ফলকটির কথা। এবারের লেখক ফিওনা ম্যাকগ্রেগর। কিশোর-কিশোরীদের প্রিয় এই লেখকের যে বইটি থেকে ফলকে উৎকলন করা হবে সেটি হলো ‘ইফ আই ডাই বিফোর আই আওয়েক’। বিপুলভাবে পঠিত এই কিশোর-উপন্যাসটিতে শত বছর পূর্বের স্প্যানিশ ফ্লু’র চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ‘স্প্যানিস ফ্লু’ নামের সেই মহামারিতে ১৯১৮ সালে সারা পৃথিবীতে মানুষ মারা গিয়েছিল অন্তত পাঁচ কোটি। শুধু কানাডাতেই মারা যান পঞ্চান্ন হাজারের বেশি।
দেশজুড়ে ছড়িয়ে থাকা বুকমার্ক কানাডা প্রোজেক্টের ফলকগুলো কানাডার ভূমিতে কানাডীয় সাহিত্যের এক ধরনের চিহ্নায়ন। একই সঙ্গে কানাডীয় সাহিত্যের প্রতি দেশের মানুষদের, বিশেষ করে পাঠকদের মনোযোগ আকর্ষণও এই প্রকল্পের লক্ষ্য। সন্দেহ নেই, এই প্রকল্পে অন্তর্ভুক্তি একজন কবি-লেখকের জন্য সম্মাননাও বটে।