বুক পকেটে লুকানো ম্যাগনোলিয়া

দুই পাশে কটন ফিল্ড। একটু বাতাস হলে সাদা তুলো উড়ে এসে চুলে আটকায়। বরফ কুচির মতো। আমার ভালো লাগে না। মনে মনে কারও খোলা চুলের ঘ্রাণ খুঁজি। বাতাসের ঝাপটায় সে খোলা চুল আমার মুখে এসে আদর বুলালে কী আর ক্ষতি!
আমি কল্পনায় খোলা চুলের কাউকে খুঁজি। আর বাস্তবে খুঁজি গ্যাস স্টেশন। রাস্তায় গাড়ি বন্ধ হয়ে গেলে বিপদ। রাস্তাটা চলে গেছে কটন ফিল্ড আর ফার্ম হাউসের মধ্য দিয়ে। ফিয়াদভিলের দিকে। ফিয়াদভিলের আগে কোনো গ্যাস স্টেশন নেই। রাস্তার দুই পাশে ডগউড গাছের সারি। মাঝে মাঝে জঙ্গল থেকে দুষ্টু হরিণের পাল বের হয়ে রাস্তা ক্রস করে। হরিণেরা পথ ভুল করে কি না জানি না, আমি করি! প্রায় সময়ই এই রাস্তাটা ভুল করি। এক্সিট ৯৫-এ চলে যাই। ১০৫-এ না গিয়ে।
গ্যাস স্টেশনটা খুঁজে পাই ডান সিটিতে। ‘ডান’ ছোট শহর। নর্থ ক্যারোলাইনার এই শহরে আমার অনেক স্মৃতি। সমুদ্রে নেমে ডুবতে ডুবতে বেঁচে যাওয়ার গল্পটা আমি বলিনি কাউকে। থাক না, কিছু গল্প গোপনই থাক! কান্নার গল্প বলতে নেই। তাতে ব্যথা বাড়ে। কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে!
এখানে সাদাদের বাস। রেড ইন্ডিয়ান মানে অরিজিনাল আমেরিকানরা থাকে। একটা সাদা মেয়ে একবার ভুল করে ভালোবেসেছিল আমায়। নাকি আমি বেসেছিলাম! পাইপার স্যেভিজ নাম। আমাদের মোটেলের ফ্রন্ট ডেস্কে কাজ করত সে। পাইপারের পিঙ্গল চুল, টোল পড়া গাল আর নীল চোখের ভাষা বুঝতে বুঝতেই অন্য এক ডাকাত এসে ছিনিয়ে নেয় তাকে! সেই গল্পও বলা হয়নি কখনো। থাক না, কিছু গল্প না হয় গোপনই থাক। কার কী ক্ষতি তাতে!
ডান সিটিতে কিছু ইন্ডিয়ান আছে। মোটেল বিজনেস করে তারা। মুখে হাসিখুশি, স্বভাবে জালিম! ‘প্যাটেল’ পদবি সবার। প্রকাশ প্যাটেল, ইন্দ্রজিৎ প্যাটেল, রমা প্যাটেল—এমন চার-পাঁচ হালি প্যাটেলে ডান সিটি ভরা।
ছোট্ট এই গ্যাস স্টেশনে আমি অবশ্য কোনো প্যাটেলের খোঁজে আসিনি আজ। এসেছি গাড়িতে গ্যাস ভরতে।
২৫ ডলারের রেগুলার গ্যাসের কথা বলে ক্রেডিট কার্ড বাড়িয়ে দিই ক্যাশিয়ারকে। মাঝবয়সী ক্যাশিয়ারের চেহারা দেখে বুঝে যাই সেও কোনো প্যাটেল-টাটেলই হবে হয়তো।
ক্যাশিয়ার রিসিপ্ট হাতে দিয়ে জিজ্ঞেস করে, আমি ইন্ডিয়ান কি না?
প্রশ্নটা খুব পরিচিত আমার কাছে। গোঁফের কারণে, নাকি নাক মুখের কারণে জানি না। অনেকেই আমাকে কেরালা-তামিলের বলে ভুল করে!
আমি ভুল শোধরাই সবখানে। এই গ্যাস স্টেশনেও। ক্যাশিয়ারকে বলি—না, বাংলাদেশি।
মধ্যবয়সী ভদ্রলোক এবার বেরিয়ে আসেন। আমার সামনে দাঁড়ান। আমি কিছুটা ভয় পাই। নর্থ ক্যারোলাইনাতে গান লিগ্যাল। সবার পকেটেই দু-একটা গান থাকে। মুরব্বি গুলি টুলি করে দেবেন কি না কে জানে! আমি মনে মনে বলি, গুলিটা মাথায় বা পিঠে করিস কাকু, বুকে না। ওখানে একজনকে লুকিয়ে রেখেছি। ভালোবাসা আর মায়া দিয়ে। দেশে সে আমার অপেক্ষায় আছে। তাকে মারিস না। আমাকে মার!
কিন্তু নাটকের মোড় ঘুরে যায় অন্যদিকে। আর্টিস্ট তার মতো করেই ডায়ালগ দেয়। অভিনয় করে। আমার মতো করে নয়।
ক্যাশিয়ার ভদ্রলোক বলেন—বাংলাদ্যেশে কোনাই আন্নের বাড়ি?
আমি নড়েচড়ে উঠি। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারি না। গত সপ্তাহে কানে পানি ঢুকেছিল। সুইমিং করার সময়। এক কান বন্ধ এখন। রেডিও টিউন করার মতো শো শো শব্দ হয়। তাই ভাবি ভুল শুনেছি। তিনি আবারও বলেন, বাংলাদ্যেশে কোনাই আন্নের বাড়ি?
নাটকের মোড় যে এভাবে ঘুরে যাবে ভাবিনি। আমি অবাক হয়ে উত্তর দিই, নোয়াখালী, মাইজদীর কাছে। আন্নেও তো মনে অয় নোয়াখালী।
ক্যাশিয়ার শব্দ করে হাসেন। আমার সঙ্গে কোলাকুলি করেন। তার মুখ থেকে জর্দার ঘ্রাণ পাই। আমার আপন মনে হয় তাঁকে। বাবা জর্দা দিয়ে পান খান। বাবাকে মনে পড়ে তখন!
ক্যাশিয়ার হাসতে হাসতে বলেন—আংগো বাড়ি দাগনভূঞা। দেখছনি কারবার, ইয়ানে আইও নোয়াখাইল্লা হাই গেছি।
: হ, কাগু। আই তো ইন্ডিয়ান প্যাটেল মনে করি কতা কই নো আন্নের লগে!
: আরে বাতিজা কইয়ো না, আই ১৭ বছর দরি ইয়ানে থাই। গ্যাস ইস্টিশন তিন আন কিনছি। প্যাটেল না পটল অই হালারহুত থালারা তো গোডা শহর কিনি হালাইব মনে হয়!
লার্জ কাপে পুরো একটা কফি শেষ হয়। আমাদের গল্প আর ফুরায় না। তিনি একে একে বলে যান তার ছেলে, ছেলের বউ, নাতির লম্বা সব গল্প। ভদ্রলোকের নাম হাসেম মুনশি। আমেরিকা এসেছেন ১৭ বছর আগে। ভাই স্পনসর করে এনেছেন। প্রতিদিন সকাল থেকে রাত, এই নির্জন গ্যাস স্টেশনে বসে হাসেম মুনশি বাঙালি কারও অপেক্ষায় থাকেন। বাংলায় কথা বলার লোক খোঁজেন! আমি একের পর এক শুনে যাই তার গ্রামের হাটের কথা, স্কুলের কথা, ঘরের কথা, পরের কথা আর আপন কথাও!
তারপর শুনি জনি ক্যাশের গান। প্রিয় কান্ট্রি সিংগার। আমার গাড়ির রেডিওতে জনি ক্যাশ গেয়ে চলেন ভাঙা গলায়—
‘You are the rose of my heart,
You are the love of my life.
A flower not fading nor falling apart,
If you're tired, rest your head on my arm.
Rose of my heart.’
এক পাশে ক্যাপ ফেয়ার নদী। অন্যপাশে ঘন জঙ্গল। তার মধ্য দিয়ে গাড়ি চলে ৮০ মাইল বেগে। পেছনে পড়ে থাকে ফিয়াদভিল, নির্জন গ্যাস স্টেশন আর নিঃসঙ্গ হাসেম মুনশি।
কেউ প্রেম খোঁজে, কেউ টাকা। আমি নাটক বানাই। এখানে, ওখানে, সেখানে শুধু গল্প খুঁজি। কত কত গল্প রোজ আমার দরজায় এসে কড়া নাড়ে!
আমি দরজা বন্ধ করি না কোনো দিন। থাক, এই দরজা খোলাই থাক!
...
হিমু আকরাম: নাট্যকার, পরিচালক, হাইপয়েন্ট স্ট্রি, নর্থ ক্যারোলাইনা, যুক্তরাষ্ট্র।
ইমেইল: <[email protected]>, ফেসবুক: