বিয়ের পর প্রবাস, যৌক্তিকতা কতটুকু
প্রবাসজীবনের চার বছর হতে চলল। সবার শুধু একটাই প্রশ্ন, ‘ভাই দেশে যাবেন না? বিয়ে করবেন না?’
হ্যাঁ, প্রশ্নগুলোর শতভাগ যুক্তিও আছে। বয়সও প্রায় ২৭-এর ঘরে কড়া নাড়ছে। যত সহজ প্রশ্ন, তার চেয়ে শত গুণ কঠিন তার উত্তর ও তা বোঝানো।
যে কোম্পানিতে চাকরি করি, তাতে দুই বছরে মাত্র দুই মাস ছুটি পাওয়া যায়। অন্যদিকে শুধু কোম্পানির চাকরি নামমাত্র, পার্ট টাইম না করলে পেটে-ভাতে চলতে হবে। সবদিক চিন্তা করে দুই বছর পরপর দুই মাসের ছুটি পেলেও, পার্ট টাইম হারানোর ভয়ে ছুটি নেওয়ার কথা চিন্তাও করি না। আর পার্ট টাইম পাওয়াটাও কঠিন। আবার যাঁকে দিয়ে যাবেন, তাঁর যদি লোভ পেয়ে বসে, তবে সেটাও তিনি মালিককে বলে হাতিয়ে নিতে পারেন। তখন ছুটি থেকে এসে দেখবেন, শুধু কোম্পানির চাকরি, পার্ট টাইম আর নেই। সেটা খুঁজতেও আরও ছয় মাস। আর মাথায় ভর করবে একরাশ টেনশন।
এদিকে দুই মাসের ছুটি নিয়ে তড়িঘড়ি বিয়ে করে একটি মেয়েকে তার অচেনা বাড়িতে রেখে এলেন। এই দুই মাসে যাকে সবচেয়ে আপন মনে হয়েছিল, তাকে ভর করে অন্যদের আপন করার আগেই সে দুই মাস ছুটি কাটিয়ে আবার প্রবাসে...স্বামীকে ছাড়া একজন নারীর জন্য প্রায় সম্পূর্ণ অচেনা বাড়িতে নিজেকে সবার সন্তুষ্টি ধরে রেখে চলাটাও কঠিন। আবার যদি এ দুই মাসে বাচ্চা না হয়, তবে তো এই অচেনা বাড়িটা তাঁর কাছে মরুভূমির মতো।
এ ক্ষেত্রে অনেকে পরামর্শ দেন, ‘দুই বছর পরপর ছুটিতে যাবি আর একটা করে বাচ্চা রেখে আসবি। এতে বউ ওদিকে ব্যস্ত থাকবে আর তুই নিশ্চিন্তে প্রবাসে কাজ করবি।’ তবে আমি কেন জানি এই পরামর্শ একদম মেনে নিতে পারি না। মনে প্রশ্ন জাগে, প্রবাসীদের বউ কি বাচ্চা লালন-পালনের জন্য? তার চাওয়া-পাওয়ার কোনো মূল্য নেই?
বলবেন, পুরুষদেরও তো একই! হ্যাঁ, আছে, তবে পুরুষ প্রবাসে নিঃসঙ্গ একা থাকেন না। সব সময় কাজে ব্যস্ত থাকেন আর পুরুষ মানুষের মনের সঙ্গে নারীর তুলনা করবেন না। পুরুষ প্রকৃতিগতভাবে মানসিকভাবে শক্তিশালী হয়। স্বামীহীন একজন নারীর জন্য আজকের সমাজে চলা কত কঠিন, তা আমার চেয়ে ভালো কেউ জানে না।
আমরা চার ভাইয়ের মধ্যে আমি সবার ছোট। আমার বড় তিন ভাই একসময় মধ্যপ্রাচ্যে ছিলেন, এর মধ্যে মেজো ভাই এখন একটি মুদিদোকান দিয়ে স্থায়ীভাবে দেশে রয়েছেন। ২০১৭ সালে কুয়েতে আসার আগে আমি কিছুদিন বাড়িতে ছিলাম। এ ছাড়া অধিকাংশ সময় পড়াশোনার সুবাদে বাড়ির বাইরে থাকতে হয়েছে। তখন বুঝতে পেরেছিলাম, একজন প্রবাসীর বউয়ের জন্য জীবন কত কঠিন। তেল থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় সব চাহিদার ক্ষেত্রে আমাদের এসে বলতে হতো। ‘ছোট ভাই আজকে একটু বাজারে যাবেন?’ অনেক সময় খুশিমনে যেতাম, অনেক সময় বিরক্ত নিয়ে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের ব্যাপারে শ্বশুর-দেবরকে বলা ঠিক আছে, কিন্তু মেয়েদের এমন অনেক জিনিসের প্রয়োজন হয়, যা তাঁরা শ্বশুর বা দেবরকে বলতে পারেন না।
তাঁদের স্বামী কর্তৃক শুরুর দিকে বাজারে যাওয়া মানা থাকলেও, ধীরে ধীরে নিজের প্রয়োজনীয় জিনিসগুলোর কেনার জন্য শাশুড়িকে নিয়ে বাজারে যাওয়া শুরু হয়, কিছুদিন পর শাশুড়িও আর যেতে চান না। তখন রবীন্দ্রনাথের ‘একলা চলো’ গানটাই যেন তাঁর টিকে থাকার একমাত্র পথপ্রদর্শক। এখন আবার অধিকাংশ পরিবার ভিন্ন ভিন্ন, আগের মতো যৌথ পরিবারের ব্যবস্থা আর নেই। সে ক্ষেত্রে একা একটি মেয়েকে পুরো পরিবার সামাল দেওয়া অনেক কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
অন্যদিকে অধিকাংশ প্রবাসী ১৬ থেকে ১৮ বছরের মেয়েদের বিয়ে করেন। সে ক্ষেত্রে মাত্র দুই মাস স্বামীর সাহচর্য পাওয়া বয়ঃসন্ধিকালীন একটি মেয়ের জন্য নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা, হাতে আগুনের জ্বলন্ত কয়লা রাখার মতোই কঠিন। অনেকে রাখতে পারেন, অনেকে পথভ্রষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে, যা একটি সুস্থ পারিবারিক সমাজব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার প্রধান অন্তরায় হতে পারে।
আমি একজন প্রবাসী হিসেবে এ জুলুম মন থেকে মেনে নিতে পারি না। আমি প্রবাসে যাওয়া বা থাকার বিরোধী নই। তবে আমার মতে, বিয়ের পর ‘প্রবাস’ নয়। গেলেও ছয় মাস অন্তর দেশে পরিবারের কাছে ফিরতে হবে।
তাই বয়স যতই হোক, যখন মনে হবে দেশে গিয়ে কিছু করতে পারব, ঠিক তখনই প্রবাসকে সালাম বলে বিদায় জানাব ইনশা আল্লাহ। আর বিয়েটা ঠিক তখনই!
*লেখক: আরিফুল ইসলাম আরিফ, কুয়েত