বিশ্বস্ত ও সরল সম্পর্ক দরকার
মা–বাবার সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে সবচেয়ে টানাপোড়েনে থাকে কিশোর বয়সী ছেলেমেয়েরা। এই সময়ে বড় ধরনের মানসিক পরিবর্তন হয়, সামাজিক অবস্থানও কিছুটা বদলে যায়। বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ তৈরিরও বয়স এটা। আবার এই বয়স থেকেই সন্তানের সঙ্গে মা–বাবার দূরত্ব বাড়তে থাকে। অনেক ক্ষেত্রে সে দূরত্ব পূরণ করে বন্ধুরা।
সম্পর্কের এই ঘাটতি মেটাতে সন্তানের সঙ্গে মা–বাবার একটি বিশ্বস্ত ও সরল সম্পর্ক দরকার। ছোটবেলা থেকেই এই সম্পর্ক তৈরি করতে হয়। যাতে কোনো সমস্যা হলে, বিপদে পড়লে সন্তানেরা অনায়াসে সবকিছু অভিভাবককে জানাতে পারে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, মা-বাবা মনোযোগ দিয়ে সন্তানের কথা শোনেন না, আগেই ওই বিষয়ে একটা মতামত দিয়ে দেন। দেশীয় রীতিতে সন্তানের প্রতি স্নেহ থাকলেও সম্মান দেওয়ার রেওয়াজ নেই। এ জন্য দরকার পারস্পরিক শ্রদ্ধাশীল সম্পর্ক।
পরিবারে এখন তুলনামূলকভাবে সন্তানও কম। এতে সন্তানকে ঘিরে মা–বাবার আকাঙ্ক্ষা বেড়ে যায়। তাঁরা নিত্যদিন আত্মীয় বা অন্যদের বাচ্চার সঙ্গে তুলনা করেন। নিজেদের ইচ্ছা পূরণে সন্তানদের চাপ দেন, মারধর করেন। ‘অন্যরা পারলে তুমি কেন পারবে না’—হরহামেশা এমন মন্তব্য করেন। এতে সন্তানের আত্মবিশ্বাস ও আত্মমর্যাদা বোধ কমে যায়। ধীরে ধীরে সন্তানেরা মা–বাবা থেকে দূরে সরে যায়। প্রয়োজন হলেও মা–বাবাকে অনেক বিষয়ে জানাতে পারে না।
রুচি, চাহিদা কিংবা ভালো–মন্দের মতো বিষয়গুলোতে কম সময়ে প্রজন্মগত পার্থক্যের পরিধি বড় হচ্ছে। এখানে প্রযুক্তির একটা বড় ভূমিকা আছে। যেমন আগে মা ও মেয়ে—উভয়ে একসঙ্গে বসে হয়তো সুচিত্রা সেনের সিনেমা দেখতেন। অথচ এখন তাদের চিন্তা ও রুচিতে পরিবর্তন এসেছে, নিজেদের পছন্দও পাল্টে যাচ্ছে।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির জন্য মা–বাবার মধ্যে উদ্বেগ কাজ করে। তাঁরা সন্তানকে চোখে চোখে রাখেন। কোচিং বা ক্লাসে গেলেও বারবার খোঁজ নেন। কী করছে, না করছে জানতে বন্ধু বা সহপাঠীর কাছ থেকে গোপনে খোঁজ রাখার চেষ্টা করেন। সন্তান পালনের ক্ষেত্রে মা–বাবার এই অতিরিক্ত রক্ষণশীলতা অনেক ছেলেমেয়েই নিতে পারছে না। এ জন্য তারা অনেক সময় ফোন ধরে বা ফোন বন্ধ করে রেখে দেয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বা চাকরিতে কোনো জটিলতা হলেও জানাতে চায় না। এর সমাধানে মা–বাবার দায়দায়িত্ব সম্পর্কে আরও বিশদভাবে জানা জরুরি। আবার সন্তানের বয়সের সঙ্গে সঙ্গে এই দায়দায়িত্বের ধরনও বদলে ফেলতে হয়।
পড়াশোনাসহ নানা কারণে সন্তানেরা অনেক সময় মা–বাবা থেকে দূরে থাকে। পরিবারের সবাই একসঙ্গে বেড়াতে যাওয়া, আত্মীয়স্বজনের বাসায় যাওয়া একদম কমে গেছে। পথের কষ্ট, ব্যস্ততা, প্রযুক্তির কারণে সবার মধ্যে দূরত্ব বেড়েই চলছে। আবার একসঙ্গে খেতে গিয়েও অনেকে নিজের মোবাইল ফোনে বুঁদ হয়ে থাকেন। এমনকি পারিবারিক বন্ধন ধরে রাখতে অন্তত এক বেলা একসঙ্গে খাওয়ার রেওয়াজও উঠে যাচ্ছে। ছুটির দিন বা অবসর ঘিরে সবার পরিকল্পনা আলাদা হয়ে যাচ্ছে।
সন্তানের বয়সের সঙ্গে তাল মিলিয়ে গ্রহণযোগ্য দূরত্ব দরকার। কিন্তু অনেক অভিভাবকের পুরো জগৎ, চিন্তা-ভাবনা সব সন্তানদের ঘিরে। ফলে মা–বাবা আকাঙ্ক্ষার বলয় থেকে বের হতে পারেন না। এতে কখনো সন্তানের সিদ্ধান্ত নেওয়ার দক্ষতা তৈরি হয় না। কখনো মা–বাবার ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। কখনো আবার মা–বাবার প্রতি একধরনের চাপা ক্ষোভ তৈরি হয়।
চাকরি নিয়ে দুশ্চিন্তা আগের তুলনায় বেড়ে গেছে, বাসায় গৃহকর্মী পাওয়া যায় না। ফলে প্রত্যেকের নিজেকে নিয়ে ব্যস্ততা বেড়ে গেছে। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যেও নানা কারণে দূরত্ব তৈরি হচ্ছে। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে সংসারে, সন্তান পালনে।
মা–বাবার মধ্যে সম্পর্ক ভালো না থাকায় একই সঙ্গে দুই রকম আচরণের মুখোমুখি হচ্ছে সন্তানেরা। বাবা হয়তো কোনো কাজে বাধা দিচ্ছেন, অথচ মা উৎসাহ দিচ্ছেন। বাচ্চা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। ফলে কীভাবে বাচ্চা বড় করা যায়, সে বিষয়ে একমত হওয়া জরুরি, যাতে বাচ্চার সুস্থ ব্যক্তিত্বের বিকাশ হতে পারে। আবার মা–বাবার মেজাজের ওপর নির্ভর করেও সন্তানের প্রতি আচার–আচরণ বদলে যায়, যা মোটেও ঠিক নয়।
যেকোনো সমস্যা নিয়ে ছেলেমেয়েরা তুলনামূলক মায়ের সঙ্গে বেশি আলাপ করে। মনে রাখতে হবে, মেয়ের সঙ্গে মায়ের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক হবে, কিন্তু মা-মেয়ে বন্ধু হবে না। মায়ের সঙ্গে স্ত্রীর তুলনা করা যাবে না। তাতে পারিবারিক অশান্তি কম হবে। সামাজিক কাঠামোর কারণে ছেলেরা ছোটবেলা থেকে যুক্তিনির্ভর ভাবনাচিন্তা করে। পরিবারের সঙ্গে সমস্যা ভাগাভাগি করাকে দুর্বলতা মনে করে। এই প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসতে বাবাদের মূল ভূমিকা রাখতে হবে। সন্তানের সঙ্গে গড়ে তুলতে হবে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক।
লেখক: কাউন্সেলিং সাইকোলজিস্ট