বিশ্বময় করোনাভাইরাস-ভীতি ও আশার বাণী
মানবজাতির ভুলের মাসুলে হোক বা প্রকৃতির নিষ্ঠুর প্রতিশোধমূলক অশুভ খেয়ালে হোক, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে নানা প্রাণঘাতী মহামারি রোগের করাল গ্রাসে মায়াবী পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে অকালে প্রাণ হারিয়েছে হাজারো মানবসন্তান। মৃতের মিছিলে ভারাক্রান্ত হয়েছে অগণিত জনপদ, অনেক সময় সংক্রামক মহামারিতে কোনো কোনো জাতিগোষ্ঠীর সিংহভাগ মানুষের জীবনাবসান ঘটেছে রোগ প্রতিরোধক চিকিৎসা বা উপায় আবিষ্কার হওয়ার আগেই।
অপ্রতিরোধ্য নতুন নতুন সংক্রামক রোগের মহামারিতে জর্জরিত আমাদের বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে জানা মতে মানবজাতির ওপর মহামারি দ্বারা মৃত্যুর নিপীড়ন শুরু হয়েছে সেই খ্রিষ্টপূর্ব ৪২৬ থেকে। এরই ধারাবাহিকতায় বিশ্ববাসীকে চরম আতঙ্কের মধ্যে ঠেলে দিয়েছে সম্প্রতি উদ্ভূত সংক্রামক ব্যাধি করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯।
রোগটির উৎপত্তিস্থল চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরে। তবে এখন তা বিশ্বের প্রায় ১০৫টি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। এখন পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছেন ৪ হাজার ৬০০ জন। নিঃসন্দেহে বিষয়টি অতি উদ্বেগের। তবে অনেক সংক্রামক ব্যাধি বিশেষজ্ঞ বলছেন, রোগটি অতীতে সংঘটিত কোনো কোনো সংক্রামক মহামারির চেয়ে দ্রুত সময়ে এবং গতিতে বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়েছে, এটি নিঃসন্দেহে বড় উদ্বেগের কারণ। তবে এই রোগে মৃত্যুর হার এখন পর্যন্ত অন্যান্য মহামারির চেয়ে অনেক কম হওয়ায় কিছুটা সময় মিলছে এর চিকিৎসার জন্য। অতীতের তুলনায় চিকিৎসাশাস্ত্রের প্রভূত উন্নয়নের ফলে বিশেষজ্ঞরা চেষ্টা করতে পারছেন মহামারি ঠেকাতে এবং দ্রুততম সময়ে এর প্রতিষেধক আবিষ্কার করতে। আমরা আশা করি, তাঁরা কোভিড-১৯–এর অশুভ যাত্রা থামিয়ে মানুষের প্রাণ রক্ষা করতে পারবেন। অতীতের ইবোলা ভাইরাসে (EVD) আক্রান্তদের প্রায় ৫০ শতাংশ লোকের মৃত্যু হয়েছে (২০১৮-১৯ কঙ্গো, উগান্ডা), সার্সে (SARS) সংক্রমিত মানুষের মধ্যে থেকে মারা গেছেন প্রায় ৯ দশমিক ৬ শতাংশ (২০০২-০৪)। সেদিক থেকে কোভিড-১৯–এ আক্রান্ত বক্তিদের মধ্যে থেকে মৃত্যুর হার এখন পর্যন্ত রয়েছে ১ দশমিক ৫ শতাংশে।
চীনের স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা ৬ মার্চ জানিয়েছেন, দেশটিতে আক্রান্ত ব্যক্তিদের প্রায় ৪৫ দশমিক ৯ শতাংশ লোক রোগ থেকে মুক্তি লাভ করে হাসপাতাল ছেড়েছেন।
কোনো অকালমৃত্যুই কারও কাম্য নয়। তবে অনান্য রোগের তুলনায় কোভিড-১৯–এ মৃত্যুর ঝুঁকি কম থাকায় দুর্ভাবনা কিছুটা কম এবং সতর্ক হওয়ার সুযোগ রয়েছে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা প্রতিনিয়ত এ রোগ থেকে বাঁচার জন্য নানা পরামর্শ দিচ্ছেন, আমরা যেন তা মেনে চলি; তাহলে অনেকটাই বিপদমুক্ত থাকা যাবে। এ রোগের লক্ষণগুলো সংযুক্ত ছবি থেকে জানা যাবে এবং আক্রান্ত হলে সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ও অন্যান্য গণমাধ্যমকে এ বিষয়ে সংবাদ ও তথ্য পরিবেশন এবং শেয়ার করার ক্ষেত্রে বিশেষ দৃষ্টি রাখতে হবে, যাতে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়ে। কিন্তু অহেতুক ভীতি ছড়িয়ে না পড়ে। ধর্ম, বর্ণ, জাতি, দেশ বা অঞ্চলকে এ রোগের জন্য দায়ী করার প্রবণতা পরিহার করতে হবে। মানবজাতির ওপর সংক্রামক মহামারি রোগ নতুন নয়। এ বিষয়ে অতীতের দৃষ্টান্ত জানলে হয়তোবা সাবধান হওয়ার বেশি সুযোগ হবে। তাই অতীতের মহামারির ওপর কিছুটা আলোকপাত করলাম।
অতীতের দিকে যদি আমরা দৃষ্টি ফেরাই তাহলে দেখতে পাব, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও অন্যান্য সূত্রের সরবরাহ করা তথ্য ও উপাত্ত অনুযায়ী মহামারি রোগের তথ্য সংগৃহীত হয় খ্রিষ্টপূর্ব ৪২৬ থেকে। এর পূর্বের তথ্য মানুষের সংগ্রহে সম্ভবত নেই। জানা যায়, এ সময়ের মধ্যে পৃথিবীতে প্রায় ২৮টির মতো নানা ধরনের মরণব্যাধি মহামারিরূপে আবির্ভূত হয় এই পৃথিবীতে। একই ব্যাধি হয়তো কয়েকবার করে পৃথিবীর নানা অঞ্চলে দেখা দিয়েছে। এর মধ্যে মারাত্মক আকারে মানবজীবন–সংহারী হয়ে যে কয়েকটি রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে, এদের মধ্যে সারা বিশ্বে খ্রিষ্টপূর্ব ৪২৯-৪২৬ এবং খ্রিষ্টাব্দ ১৬৫ থেকে ১৭৯৮ পর্যন্ত ২৬ দশমিক ২৮ কোটি লোক মেরে মহামারি রোগের শীর্ষস্থানে রয়েছে প্লেগ। রোগটি যেসব নামে বহুল পরিচিত, এর মধ্যে রয়েছে ‘প্লেগ অব এথেন্স—গ্রিস’, ‘এনটোনাইন প্লেগ—রোমান সম্রাজ্য’, প্লেগ অব জাস্টিনিয়ান—ইউরোপ, মিশর ও পশ্চিম এশিয়ায়’, ‘প্লেগ অব পার্সিয়ান এবং ‘ব্ল্যাক ডেথ প্লেগ অব’ ১৩৩১-১৩৫৩ খ্রিষ্টাব্দ। ১৯১৮-১৯২০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে প্রায় ১০ কোটি লোক মেরে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ‘স্প্যানিশ ফ্লু’ (বিশ্বব্যাপী) আর ১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে অদ্যাবধি প্রায় ৩ দশমিক ২ কোটি লোক মেরে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে এইচআইভি–এআইডিএস ( HIV/AIDS)। এরপর ১৯৫৭-১৯৫৮ সালে প্রায় ২০ লাখ লোক মেরে চতুর্থ আসনে আছে এশিয়ান ফ্লু। মৃতের সংখ্যা ৭৬২ হলেও বিশ্বকে অনেক দুর্ভাবনায় ফেলেছিল চীন, হংকং, তাইওয়ান, কানাডা আর সিঙ্গাপুরে ঘটে যাওয়া ২০০৪ সালের সার্স (SARS)। এবারের কোভিড-১৯–এর দৌরাত্ম্য কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে কেউ জানে না। তবে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে আমাদের সামনে পা বাড়াতে হবে, এর কোনো বিকল্প নেই।