বিশ্ববিদ্যালয় র্যাঙ্কিংয়ে আমরা কোথায়
সম্প্রতি বিশ্বব্যাপী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র্যাঙ্কিং মূল্যায়নকারী প্রতিষ্ঠান কিউএস (যুক্তরাজ্যভিত্তিক শিক্ষা ও গবেষণা সংস্থা) বিশ্বসেরা এক হাজার বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকা প্রকাশ করেছে। এই র্যাঙ্কিংয়ে বিশ্বের সবচেয়ে সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নাম উঠে এসেছে। তা ছাড়া সুনির্দিষ্টভাবে আমেরিকা, ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য, এশিয়ার কোনো দেশে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার অবস্থা কেমন, সে সম্পর্কে ধারণা দিয়েছে।
র্যাঙ্কিংয়ে বরাবরের মতো এবারও বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান শেষ ২০০-তে। বাংলাদেশের সেরা দুটি বিশ্ববিদ্যালয় যেমন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এই র্যাঙ্কিংয়ে স্থান পেয়েছে, তা–ও শেষের দিকে, ৮০১ থেকে ১০০০–এর মধ্যে (উল্লেখ্য, এই র্যাঙ্কিংয়ে ৫০০-এর পরে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সুনির্দিষ্ট অবস্থান প্রকাশ করে না কিউএস)।
কিউএসের প্রকাশিত নতুন এই র্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশ থেকে মাত্র দুটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থান পেলেও পার্শ্ববর্তী ভারতের ২১টি ও পাকিস্তানের ৭টি বিশ্ববিদ্যালয় স্থান করে নিয়েছে এবং ভারতের ৮টি ও পাকিস্তানের ৩টি বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বসেরা ৫০০–এর মধ্যে রয়েছে। তা ছাড়া এশিয়ার অন্যান্য দেশের মধ্যে চীনের ৫১টি, জাপানের ৪১টি, দক্ষিণ কোরিয়ার ৩০টি, মালয়েশিয়ার ২০টি, তাইওয়ানের ১৬টি, সৌদি আরবের ১০টি, থাইল্যান্ডের ৮টি, ইন্দোনেশিয়ার ৮টি, হংকংয়ের ৭টি, ইসরায়েলের ৬টি, ইরানের ৫টি, ফিলিপাইনের ৪টি ও সিঙ্গাপুরের ৩টি বিশ্ববিদ্যালয় এই তালিকায় স্থান পেয়েছে এবং অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ই প্রথম ৫০০–এর মধ্যে রয়েছে। বিশেষ করে সিঙ্গাপুর (১১তম), চীন (১৫তম), হংকং (২২তম), জাপান (২৪তম), দক্ষিণ কোরিয়া (৩৭তম), মালয়েশিয়া (৫৯তম) এবং তাইওয়ানের (৬৯তম) বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থান তুলনামূলকভাবে অনেক এগোনো।
প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কেন এই তালিকায় ভালো অবস্থান পেল না বা দেশে এত বিশ্ববিদ্যালয় থাকতে কেন মাত্র দুটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থান পেল? এ নিয়ে অবশ্যই আমাদের ভাবতে হবে। এ ধরনের র্যাঙ্কিংকে অবহেলা বা পাশ কাটিয়ে গেলে চলবে না। নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
কিউএস প্রকাশিত এই র্যাঙ্কিংকে বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য একটি বিশ্ববিদ্যালয় র্যাঙ্কিং মনে করা হয়। এই র্যাঙ্কিংয়ে ছয়টি সূচকে মোট ১০০ স্কোর ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক মান নিরূপণ করা হয়। একাডেমিক খ্যাতি (স্কোর ৪০), গ্র্যাজুয়েটদের চাকরির বাজারে সুনাম (স্কোর ১০), শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত (স্কোর ২০), শিক্ষকদের গবেষণা উদ্ধৃতি বা সাইটেশন (স্কোর ২০), আন্তর্জাতিক শিক্ষক অনুপাত (স্কোর ৫) ও আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী অনুপাত (স্কোর ৫)।
সূচকের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক খ্যাতি অর্জন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা নির্ধারিত হয় মূলত শিক্ষা ও গবেষণার মান নিয়ে। আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো (সরকারি ও বেসরকারি) কোনো সূচকের বিপরীতে কী অবস্থায় আছে, তা আমরা ভালো করেই জানি। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, আমরা সবকিছু জেনেবুঝেও কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিইনি বা নিতে পারেনি এবং এখনো পারছি না। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও এসব সূচকের বিষয়ে অনেকটা উদাসীন। বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক উন্নয়ন, নিয়োগ, টেন্ডার, আন্দোলন, কনফারেন্স, অনুষ্ঠান, বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধাসংবলিত কার্যকালাপ হলেও শিক্ষা ও গবেষণার মান নিয়ে ফলপ্রসূ কিছুই হয় না। যেন এসব সূচক নিয়ে ভাবার সময় নেই। যেন কোথাও কেউ নেই। আর যাঁরা এসব নিয়ে ভাবতে চান, উদ্যোগ নিতে চান, তাঁদের সামনে এগোতে দেওয়া হয় না। এভাবে চলতে থাকলে হয়তো আমরা একদিন কোনো তালিকাতেই স্থান পাব না।
কিউএস প্রকাশিত র্যাঙ্কিংকে মূল্যায়ন না করলেও আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার প্রকৃত অবস্থা মোটেও আবশ্যক নয়। বর্তমানে বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষার ব্যাপক প্রসার ঘটলেও এর গুণগত মান এখনো নিশ্চিত করা যায়নি। গবেষণা খাতে আমাদের আর্থিক অপ্রতুলতা থাকলেও যতটুকু গবেষণা হচ্ছে, সেখানে আন্তর্জাতিক মান নিশ্চিত করা হচ্ছে না। তা ছাড়া গবেষণায় তথ্য চুরি, অর্থ লোপাট প্রভৃতি সমালোচনা তো রয়েছেই। গত কয়েক বছরে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে হেকেপের (উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়ন প্রকল্প) আওতায় শত শত কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে, কিন্তু এতে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার গুণগত মান কতটুকু বৃদ্ধি পেয়েছে, সে প্রশ্ন থেকেই যায়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক নিয়োগ, গবেষণা প্রকল্প মনিটরিং সব সময় স্বচ্ছ হয় না। আমরা শিক্ষকেরা অনেক ক্ষেত্রেই নৈতিকতা হারিয়ে ফেলেছি। লেখাপড়া, গবেষণা ফেলে বিভিন্ন প্রশাসনিক সুবিধা পেতে প্রতিনিয়ত লবিং করছি। বেশির ভাগ ছাত্রছাত্রীই এখন আর লেখাপড়া, গবেষণায় মনোনিবেশ করছেন না। সর্বোপরি আমরা শিক্ষক-ছাত্র-প্রশাসন সবাই মিলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার উপযুক্ত পরিবেশ প্রায় নষ্ট করে ফেলেছি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মান বাড়াতে আমাদের এসব অপচর্চা থেকে অবশ্যই বেরিয়ে আসতে হবে। এর বিকল্প নেই। কারণ, বিশ্ববিদ্যালয়কে পেছনে রেখে একটা দেশ কিছুতেই এগোতে পারে না।
* সহযোগী অধ্যাপক, পবিপ্রবি ও এক্স-টিচিং ফেলো, ইউনিভার্সিটি সায়েন্স মালয়েশিয়া