বিশ্ব প্রেমিক
আমাদের কিশোর বয়সে একটা ছবি দেখেছিলাম নাম ‘বিশ্ব প্রেমিক’ যেখানে দেখানো হয় হুমায়ুন ফরীদি তাঁর চেয়ে বয়সে অনেক ছোট নায়িকা মৌসুমীর প্রেমে পড়েন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ফেল করতে করতে ফরীদি আদু ভাই হয়ে যান। এই সময় মৌসুমী এসে সেখানে ভর্তি হন। নায়ক রুবেল এবং নায়িকা মৌসুমীকে ছাপিয়ে ফরীদির অভিনয় এবং ছবিতে তাঁর চরিত্রের কষ্টের জন্যই তাঁকে মনে রেখেছি। আমার চরিত্রও অনেকটা সে রকম টপাটপ প্রেমে পড়ি। একটা প্রেম থেকে উঠতে না উঠতেই আবার একটাতে পড়ি, এমনকি একই সঙ্গে একাধিক প্রেমেও পড়ি। আজ সে গল্পই বলব আপনাদের অস্ট্রেলিয়া আসার পরও আমার দুজনের সঙ্গে গভীর প্রেম হয়েছে, যাকে বলে একেবারে সোনায় সোহাগা। তাদের সঙ্গে মন দেওয়া–নেওয়া হয়ে গেছে অস্ট্রেলিয়ায় পা রাখার প্রথম দিন থেকেই। তাদের দুজনের সঙ্গেই আমার সপ্তাহে পাঁচ দিন নিয়ম করে দেখা করতে হয়, না হলে মন খারাপ করে।
তাদের দুজনের দুটো সুন্দর নামও দিতে হয়েছে, তাদের আবদারেই বিশেষ করে ছোটজনের আবদারে। কারণ, ছোটজনের সঙ্গে আমার আগে পরিচয় হয়েছিল। এরপর একদিন বড়জনের সঙ্গে পরিচয়ের পর ছোটজন জিজ্ঞেস করল, হ্যাঁ গো তুমি আর আমাকে আগের মতো সময় দিচ্ছ না কেন? আমি বললাম, তোমার সতিন জুটেছে গো। কোনো ভণিতা না করে সরাসরিই বললাম, কারণ আমি আবার মিথ্যা বলতে পারি না। ছোটজনের দেখলাম মনটা ভীষণ খারাপ হলো। চোখে পানি টলমল করলেও নিজেকে ধরে রাখল। কারণ, এতগুলো লোকের সামনে কেঁদে দিলে বিশ্রী দেখাবে ব্যাপারটা।
সে নিজেকে দ্রুতই সামলে নিয়ে বলল, আচ্ছা ঠিক আছে। তুমি যেই দেশে এসেছ, এখানে টাকা থাকলে ঘণ্টায় ঘণ্টায় প্রেমিকা পাওয়া যায়। সেখানে তো তুমি মাত্র আর একজনকে জুটিয়েছ। যাহোক, এখন প্রেমিকা যেহেতু দুজন, তাহলে দুজনের আলাদা পরিচয়ও দরকার। তুমি আমাদের দুজনের দুটো নাম দিয়ে দাও। আমি বললাম ঠিক আছে, আমায় একটু ভাবতে দাও। শুনে সে বলল, এখানে ভাবাভাবির কী আছে। আচ্ছা আমি তোমাকে সাহায্য করছি। আচ্ছা দেখতে কে বেশি সুন্দর আমি না সে? আমি বললাম, অবশ্যই তুমি। কী সুন্দর তোমার নীল রং, জানো আমার বন্ধুরাও আমাকে কৃষ্ণ নামে ডাকত, যার গায়ের রং ছিল নীল।
আর সে দেখতে হলুদ বর্ণের। অবশ্য হলুদও আমার প্রিয় রং। কারণ, হলুদ আমার প্রিয় চরিত্র হিমুর পছন্দের রং। তাই আমারও প্রিয়। কিন্তু নীল আমার বেশি প্রিয়, কারণ আকাশের রং নীল। তাই তোমাকে দেখলে আকাশ দেখার প্রশান্তি অনুভব করি। কিন্তু আমি বর্ণবিদ্বেষী না, তাই গায়ের রং দিয়ে তোমাদের বিচার করতে পারব না। আমায় মাফ কর। সে তখন বলল, তাহলে কে দেখতে বেশি লম্বা। আমি বললাম, এদিকে অবশ্য সে এগিয়ে। সে তোমার চেয়ে বেশি লম্বা। সে তখন বলল, তাহলে তো সমস্যা মিটেই গেল। তুমি তাকে বড় মানে বড় প্রেমিকা আর আমাকে ছোট মানে ছোট প্রেমিকা বলবে। আমি বললাম, তোমার সঙ্গে আমার আগে পরিচয়, তাই বয়সে তুমিই বড়। কিন্তু সে বলল, সেটা বুঝেছি তাই তো বড়র অধিকারটা খাটিয়ে নামকরণটা করছি।
তুমি আর না করো না। আর আমি তোমাকে হারাতে চাই না। নামে কী আসে যায় বল। তোমাকে যে তা–ও পাচ্ছি, সেটাই অনেক। আরেকজনকে পাওয়ার পরও তুমি আমাকে সময় দিচ্ছ, সেটাই আমার জন্য অনেক বড় পাওয়া। কারণ, এই যান্ত্রিক নগরে কেউ কাউকে এক সেকেন্ড সময় দিতে চায় না। সবাই শুধু দৌড়াচ্ছে আর দৌড়াচ্ছে। আমি বললাম, আচ্ছা ঠিক আছে তাহলে। এভাবেই আমি এর পর থেকে দুই দুজন প্রেমিকা নিয়ে বসবাস করছি।
তাদের জন্য একটা টাইম টেবিল করে নিয়েছি, সেই মোতাবেক তাদের সময় দিয়ে চলেছি। খুব ভোরে অ্যালার্মের শব্দে ধড়মড় করে ঘুম থেকে উঠে পড়ি। কারণ, বড় প্রেমিকা অপেক্ষায় থাকে। তার সঙ্গে দেখা করার সময় সকাল ৬টা ২৩। এক মিনিট এদিক–ওদিক হলে সে আমার ওপর রাগ করে বাসার দিকে হাঁটা দেয়। তাই কোনোমতে প্রাতঃক্রিয়া সম্পন্ন করে দাঁতে ব্রাশের দুই ঘষা দিয়ে, প্যান্ট–শার্ট পরে ব্যাগটা পিঠে ঝুলিয়ে এক দৌড়। হাঁটতে হাঁটতে কতবার যে ঘড়ি দেখি, তার হিসাব নেই। যদিও তার নাম বড়, কারণ লম্বায় সে বড়, কিন্তু তার স্বভাবে কিশোরীর চপলতা রয়ে গেছে। সে কখনোই আমি আসার আগে আসবে না। সব সময়ই আমাকে আগে আসতে হবে। আবার এসেও এক মিনিট দেরি করবে না। দৌড়ে এসে যে তার হাতটা ধরব, সেই উপায়ও নেই।
তার বাবা গেটের দুই পাশে দুজন দারোয়ান দাঁড় করিয়ে রেখেছে। তারা আমার পাস চেক করে তবেই ভেতরে ঢুকতে দেয়। এটা আসলে তার মায়ের বুদ্ধি, তার মা তার বাবাকে বলেছে যেহেতু এই ছেলে পিছু ছাড়ছে না, ওকে একটা পাস দিয়ে দাও, যাতে ও গেটে এসে দেখালে দারোয়ান ভেতরে ঢুকতে দেয়। আর যেহেতু আমার মেয়েও ওকে ভীষণ পছন্দ করে, তাই আর দ্বিমত করো না। আমি মনে মনে ওর মাকে একটা ধন্যবাদ দিয়েছি আর ওকে সামনাসামনি বলেছি তোমার মা না থাকলে আমাদের প্রেমের ইতি টানতে হতো কবেই। এটা শুনে ও বলল, তুমি আমাকে চেন না, আমার অনেক জিদ। তোমাকে পাস না দিলে আমি নাওয়া–খাওয়া ছেড়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়েছিলাম। আমি বললাম, ধন্যি মেয়ে তুমি।
এরপর আমরা দুজনে হাত ধরাধরি করে হাঁটতে থাকি আমার কর্মস্থলের দিকে। ঘড়ি ধরে ঠিক প্রায় ৪৫ মিনিট হাঁটার পর আমাদের দুজনের রাস্তা আলাদা হয়ে যায় আর আমরাও তখনকার মতো বিচ্ছিন্ন হয়ে যাই। বিকেলে আবার অফিস থেকে ফেরার পথে তার হাত ধরে হাঁটা দিই। এভাবে চলতে চলতে আমাদের কত কথা হয়। বিশেষ করে সকালে যেহেতু কাঁচা ঘুম ভেঙে উঠি, তাই বেশির ভাগ সময়ই তার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ি আর সে আমাকে বয়ে নিয়ে চলে। আর আমাকে ঝাড়ি দেয় এত করে বলি একটু তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ো, তুমি তো সেটা না শুনে রাত জেগে গান শুনো। তুমি জেগে থাকলে অন্তত তোমার সঙ্গে দুটো ভালোমন্দ কথা শেয়ার করা যায়। আমি বলি, শেয়ার তো আমিও করতে চাই, কিন্তু এত ক্লান্ত থাকি যে আর চোখ খুলে রাখতে পারি না। তবে ফেরার পথে অনেক কথা হয়। আমার দেশের খবর নেয়। আব্বা-মা কেমন আছেন, ভাই-বন্ধুরা কেমন আছেন ইত্যাদি ইত্যাদি। আমিও মাঝেমধ্যে জিজ্ঞেস করি ওর পরিবারের কথা। এভাবে গল্প করতে করতে কখন যে ৪৫ মিনিট পার হয়ে যায়, টেরই পাই না।
মাঝেমধ্যে লেগে যায় আমাদের। সেদিন যেমন বলছিল তুমি সামনের সিটের ওই সানগ্লাস পরা মেয়েটার দিকে বারবার তাকাচ্ছিলে কেন? আমি বললাম, ওকে দেখতে অবিকল কোনো একটা সিনেমার নায়িকার মতো লাগছিল, সেটা মনে করার চেষ্টা করছিলাম। শুনে তার সে কী রাগ। আমি বললাম, আমার জীবনের প্রথম এবং শেষ দুটো প্রেমই তুমি। শুনে মনে মনে খুশি হলেও বাইরে কপট রাগ দেখিয়ে বলল, যাও তুমি আমাকে একটুও ভালোবাস না। আমি বললাম, তাহলে কাকে বাসি? সে বলল, তুমি ছোটকে বেশি ভালোবাস? আমি বললাম, মোটেও না। তাহলে তো আমি তোমার প্রমেই পড়তাম না। তুমি বেশি সুন্দর বলেই না তোমার প্রেমে পড়েছিলাম। এভাবেই ছোট প্রেমিকার চোখ ফাঁকি দিয়ে চলে আমাদের গভীর প্রেম। অবশ্য ছোট সবই জানে এবং মেনে নিয়েছে। কারণ, মেনে নেওয়া ছাড়া ওর কোনো উপায় ছিল না। মেনে না নিলে হয়তো আমাকে এখন যেটুকু সময়ের জন্য পাচ্ছে, সেটুকুও পেত না।
এরপর একসময় বড় প্রেমিকার হাত ছেড়ে দিয়ে একটু এগিয়ে গিয়ে ছোট প্রেমিকার হাত ধরি। তারপর ছোট প্রেমিকার সঙ্গে খিটিরমিটির করতে করতে পৌঁছে যাই অফিসে। অবশ্য ছোট প্রেমিকার সঙ্গে সময় কাটাই খুবই সামান্য, মাত্র ১৫ থেকে ১৭ মিনিট। সেই সামান্য সময়েই তার সঙ্গে কত কথা হয়। কারণ, সিডনিতে আসার পর আমার একমাত্র সম্বল ছিল ছোট প্রেমিকার কোল। আমি যখনই কোনো খারাপ সময়ের মধ্য দিয়ে যেতাম, তখনই আমি তার কাছে গিয়ে তার কোলে মাথা রেখে নির্ভার হয়ে ঘুম দিতাম। সে তখন পরম মমতায় আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিত। আর বলত, শোন তুমি একটা নতুন দেশে এসেছ, শুরুতে কষ্ট তো একটু হবেই।
কিন্তু এই খারাপ সময়টুকু পার করে দিতে পারলেই তুমি দেখা পাবে সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের। আমি তার কথায় খুবই ভরসা পেতাম। কারণ, সে সিডনিতে আছে অনেক দিন ধরে। সে আমার পরিবারের সব খবর জানে তবু আমাকে ভালোবাসে একেবারে নিঃস্বার্থভাবে। এবং কোনো দিন কোনো কিছুর জন্য অভিযোগ করেনি এখন পর্যন্ত। আমি খুবই সৌভাগ্যবান যে সিডনিতে আসার পরপরই তার মতো একজন নিঃস্বার্থ পরোপকারী মানুষের দেখা পেয়েছিলাম। আমি শুধু স্বার্থপরের মতো তার কাছ থেকে নিয়েই গেছি এবং এখনো নিচ্ছি, কিন্তু প্রতিদানে তাকে দিইনি কিছুই। সে অবশ্য চায়ও না। তার আমাকে ভালোবেসে যাওয়াতেই আনন্দ।
আমি কোন ধরনের মানুষ, তার উত্তরে ফেসবুকের একটা অ্যাপের ফলাফল এসেছিল ‘ওমেনাইজার’। আসলেই আমার চরিত্র সেই রকম। তাই এই দুজন প্রেমিকা থাকা সত্ত্বেও আমি আবার প্রেমে পড়ে গেলাম। এবং এইবারে প্রেমটাকে একটু উচ্চাভিলাষী প্রেমই বলতে হয়। একগাদা টাকা জরিমানা দিয়ে মেয়ের বাপের কাছ থেকে মেয়ের সঙ্গে প্রেমের ছাড়পত্র নিলাম। তার পর থেকে আগের দুজনের চোখকে ফাঁকি দিয়ে নতুনজনের সঙ্গে আমার প্রেম চালিয়ে যাচ্ছি। নতুন প্রেমিকার অনেক দেমাগ আর খরচের হাতও খুবই বড়। তাকে খাওয়াতে পরাতে আমার ফকির হওয়ার জোগাড়। আবার ছয় মাস অন্তর অন্তর তার জন্য সিকিউরিটি পাসের মতো একটা করে পাস কিনতে হয়, তা না হলে তার সঙ্গে রাস্তাঘাটে ঢলাঢলি করা যাবে না।
কী আর করা। কথায় বলে, শখের দাম লাখ টাকা। আমি সেই শখ পূরণ করতে গিয়ে মোটামুটি পথের ফকির হতে বসেছি। তবু এই নতুন প্রেমটা পুষে রেখেছি। এই নতুন প্রেমিকা আমাকে তেমন কোনো কাজে সাহায্য করতে পারে না। মাঝেমধ্যে অনেক কষ্ট করে ঘুম থেকে উঠে আমার সঙ্গে স্টেশন পর্যন্ত হেঁটে যায়। তবে আমার বউ আর মেয়ের সঙ্গে অনেক মাখামাখি সম্পর্ক তার। কিন্তু আমার বউ আর মেয়ে তো জানে না যে এই মেয়েটা তাদের সংসারে লালবাতি জ্বালানোর তালে আছে।
যাহোক, সিডনিতে এসে অনেক ধরনের বিলাসিতা চরিত্রে ঢুকে গেছে। তার মধ্যে তিনজন প্রেমিকার সঙ্গে সমানতালে প্রেম চালিয়ে যাচ্ছি। বউ সবকিছুই জানে, তবু সংসার করে যাচ্ছে।
কারণ, কিছু বললে যদি আবার আমি সংসার ছেড়ে ভেগে যাই। আধুনিক কালের এই নাগরিক যান্ত্রিকতায় আমরা সবাই দিন দিন যন্ত্রে পরিণত হচ্ছি। তাই আমি যে এর মধ্যে থেকেও একজন রক্ত–মাংসের মানুষের মতো প্রেম চালিয়ে যাচ্ছি, তাই গিন্নি সবকিছু বুঝেও চুপ করে আছে আর আমি সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে যাচ্ছি। হয়তো জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এমনই থাকব আমি। প্রেমিকার সংখ্যা হয়তো কমবে–বাড়বে, হয়তো পুরোনো প্রেমিকার জায়গায় আসবে নতুন প্রেমিকা। তবু আমি চাই আমার মনে প্রেম বেঁচে থাকুক।
কারণ, আমার গুরু নচিকেতা বলেছেন:
‘সংকীর্ণ মনের মানুষ যারা তারাই তো ভালোবাসে একবার
যার মন বড় যত দেখে ভালো অবিরত তারাই তো ভালোবাসে বারবার’
পাদটীকা: যে বা যারা ছোট প্রেমিকা, বড় প্রেমিকা এবং বড়লোক প্রেমিকার নাম বলতে পারবে, তাদের জন্য আছে বিশেষ পুরস্কার।