২০০৭ থেকে প্রতিবছর সেপ্টেম্বর মাসের ১৬ তারিখ বিশ্ব গণপরিবহন দিবস হিসেবে উদ্যাপন করা হয়। কাজ থাকুক বা না থাকুক প্রতিদিনই মানুষকে ঘর থেকে বের হতে হয়, এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতে হয় এবং একসময় ঘরে ফিরেও আসতে হয়। আর এ জন্য কোনো নির্দিষ্ট সময় নেই। কিন্তু অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজের সময়টাতেই রাস্তায় ভিড় উপচে পড়ে।
সামর্থ্যবানদের নিজেদের বাহন আছে। তবে সাধারণের জন্য সব দেশেই আছে সরকারি ও বেসরকারি গণপরিবহনব্যবস্থা। নগর এবং পরিবহন পরিকল্পনাবিদেরা একটি নগরের জনসংখ্যা, চাহিদা, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, পরিবেশ ইত্যাদি বিবেচনায় বহু আগে থেকেই একটি নগরের গণপরিবহনব্যবস্থা কেমন হবে, তা ঠিক করেন এবং সেভাবেই তা গড়ে তোলেন। ২০১০ সালে যেখানে বিশ্বে নগরবাসী ছিল মাত্র ১০ শতাংশ, সেখানে ২০৩০ সালে তা অনেক বেড়ে গিয়ে হতে যাচ্ছে ৬০ শতাংশ এবং এটাই প্রথমবারের মতো ঘটনা যে গ্রামের থেকে শহরের জনসংখ্যা অধিক হচ্ছে।
এই বিপুলসংখ্যক মানুষের চলাচল ছন্দময় এবং স্বচ্ছন্দ করতে সংশ্লিষ্ট পরিকল্পনাবিদেরা এখন থেকেই গলদঘর্ম হচ্ছেন। কেননা বিপুলসংখ্যক নগরবাসী তাঁদের দৈনন্দিন কাজের জন্য ২০৫০ সালে গণপরিবহনে ভ্রমণ করবেন ৫০ ট্রিলিয়ন অর্থাৎ ৫০ লাখ কোটি কিলোমিটার। আর এ জন্য প্রয়োজন পড়বে সুশৃঙ্খল, সুদক্ষ এবং সর্বোপরি পরিবেশবান্ধব গণপরিবহনব্যবস্থা।
পরিবহন নেটওয়ার্কে উদ্ভাবন এবং যোগ করতে হবে নতুন ধরনের পরিবহন। স্থল, জলপথের সঙ্গে তৃতীয় মাত্রা যোগ করে আকাশে স্বল্প উচ্চতায় যানবাহন চলাচলের ব্যবস্থা করা মোটেই কল্পনাবিলাস নয়, এ হলো বাস্তবতা। ইউরোপীয় বিমান নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান এয়ারবাসের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘আগামী ৫, ১০, ২০ এবং ৩০ বছরের কথা আমাদের এখনই ভাবতে হবে। ব্যস্ত সড়কগুলো যানজটমুক্ত করতে হলে নিম্ন আকাশকে আয়ত্তে আনতে হবে।’
পরিবেশের দিকে খেয়াল রেখেই ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যবহারকে নিরুৎসাহিত করার জন্য ইউরোপের অনেক শহরেই নিখরচার গণপরিবহনব্যবস্থার কথা খুব গুরুত্বের সঙ্গে ভাবা হচ্ছে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের দ্বিতীয় ক্ষুদ্রতম দেশ লুক্সেমবার্গ হচ্ছে পৃথিবীর প্রথম দেশ, যেখানে সবার জন্য নিখরচার গণপরিবহন চালু করা হয়েছে। ফ্রান্সের হাইপারলুপ, এয়ারবাস এবং মহাশূন্য গবেষণার জন্য খ্যাত তুলুজ নগরীতে আগামী বছর থেকে চালু হতে যাচ্ছে ইউরোপের প্রথম কেব্ল কার গণপরিবহন।
এদিকে ছয় বছর ধরে গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেমের (জিপিএস) আরেক উদ্যোক্তা টমটম প্রতিবছর বিভিন্ন দেশের, বিভিন্ন নগরীর যানজটের সূচক প্রকাশ করে থাকে। এ সূচকে প্যারিস নগরীর অবস্থান ৪১তম, লন্ডনের ঠিক পরে এবং নিউইয়র্কের সমান সমান। এ নগরীতে যানজটে বাড়তি খরচ হয় ৩৬ শতাংশ সময়। তাই সড়ক ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত বিশেষজ্ঞরা ফুটওভার ব্রিজ ও আন্ডারপাসকে যথেষ্ট মনে করছেন না এবং টমটমের যানজট সূচকে প্যারিসকে আরও নিচে নামিয়ে আনার জন্য নানা রকম উপায় খুঁজছেন।
এ সূচকটিতে যানজটের কঠিন জটে আক্রান্ত প্রথম পাঁচটি নগরীর মধ্যে আমাদের প্রিয় ঢাকা নগরীর নাম না দেখতে পেয়ে বেশ হর্ষ-উৎফুল্ল হয়ে নিচের দিকে যেতে যেতে সারা বিশ্বের ৫৬টি দেশের ৪০৩টি নগরের মধ্যে কোথাও ঢাকাকে খুঁজে পেলাম না। আমার দেখায় ভুল হতে পারে ভেবে আবারও তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখলাম। না, কোথাও আমাদের রাজধানীর নাম-নিশানা নেই! এ সূচকে প্রথম হওয়ার শোচনীয় শিরোপাটি জুটেছে মুম্বাই নগরীর। এখানে গন্তব্যে পৌঁছাতে যেটুকু সময় লাগার কথা, তার থেকে ৬৫ শতাংশ সময় বেশি লাগবে। এই শীর্ষ পাঁচের মধ্যে ভারতের নতুন দিল্লি পেরুর লিমা শহরের সঙ্গে ভাগাভাগি করে তৃতীয় হয়েছে। আর একদম শেষ অর্থাৎ ৪০৩তম হচ্ছে মার্কিন মুল্লুকের এক শহর, নাম গ্রিন্সবোরো—হাই পয়েন্ট। এ শহরে যানজটের কারণে মাত্র ৯ শতাংশ সময় বেশি খরচ হয়।
সে যা–ই হোক, আড়াই কোটি জনসংখ্যার ঢাকাকে বাদ দিয়ে এমন সূচক করা উচিত হয়েছে কি না এমনটা যখন ভাবছিলাম ঠিক তখনই অনেকটা কাকতালীয়ভাবে চোখে পড়ল ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেসের ২৩ অক্টোবর ২০১৯ তারিখের এক প্রতিবেদন।
এ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘টমটম ট্রাফিক সূচকে ঢাকাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি, তবে সন্দেহ নেই যে বিশ্বের সবচেয়ে খারাপ যানজটের শহর হচ্ছে ঢাকা। ঢাকাকে উল্লেখ করা হোক বা না হোক, যানজট হচ্ছে ঢাকাবাসীর জন্য নিত্যদিনের দুঃস্বপ্ন। তারা পরিবারকে বঞ্চিত করে এবং বিনোদনের পরিবর্তে অনেকখানি সময় যানজটে অপচয় করে থাকে। এতে তাদের ওপর প্রচণ্ড মানসিক এবং শারীরিক চাপ পরে। ফলে অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। আর সংগত কারণেই ডাক্তার এবং ওষুধের জন্য বাড়তি খরচ জোগাতে হয়।’ সংক্ষপে এই ছিল ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেসের প্রতিবেদনটির প্রতিপাদ্য।
টমটম ট্রাফিক সূচকে ঢাকাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি, তবে সন্দেহ নেই যে বিশ্বের সবচেয়ে খারাপ যানজটের শহর হচ্ছে ঢাকা। ঢাকাকে উল্লেখ করা হোক বা না হোক, যানজট হচ্ছে ঢাকাবাসীর জন্য নিত্যদিনের দুঃস্বপ্ন। তারা পরিবারকে বঞ্চিত করে এবং বিনোদনের পরিবর্তে অনেকখানি সময় যানজটে অপচয় করে থাকে। এতে তাদের ওপর প্রচণ্ড মানসিক এবং শারীরিক চাপ পরে। ফলে অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। আর সংগত কারণেই ডাক্তার এবং ওষুধের জন্য বাড়তি খরচ জোগাতে হয়।
পত্রিকার খবরের সঙ্গে অনেকের অভিজ্ঞতা মিলে যায়। আকাশযানে দেড়, দুই হাজার মাইল তিন বা চার ঘণ্টায় উড়ে এসে, বিমানবন্দর থেকে ১০–১৫ মাইল পথ যেতে কোনো কোনো সময় গাড়ির মধ্যে ৪–৫ ঘণ্টা বসে বসে নানা রকম ভেঁপু, হর্ন ইত্যাদি শুনতে হয়। নিরুপায় হয়ে কিছুই করার থাকে না। কাজের জায়গায় পৌঁছাতে যেখানে আধা ঘণ্টার বেশি সময় লাগার কথা নয়, সেখানে কত সময় লাগে, তা ভুক্তভোগীই বেশি জানেন। সাধারণত দিনের ২৪ ঘণ্টাকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়, ৮ ঘণ্টা কাজ, ৮ ঘণ্টা বিনোদন এবং ৮ ঘণ্টা বিশ্রাম বা ঘুম। আমরা কাজে আসা-যাওয়ার পথে অনেকখানি সময় অপচয় করে ফেলি, তাতে অসহনীয় দুর্ভোগের সঙ্গে যুক্ত হয় শ্রমঘণ্টা অপচয়জনিত জাতীয় উৎপাদনশীলতার ক্ষতি এবং মূল্যবান জ্বালানির অপচয়।
বিশ্ব গণপরিবহন দিবস আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে বসবাসযোগ্য পরিকল্পিত নগরী গড়ে তুলতে হলে গণপরিবহনের মতো অত্যাবশকীয় একটি বিষয়টিকে পাশ কাটিয়ে তা মোটেই সম্ভব নয়।