বিপদে আছি: শেষ পর্ব
আমাদের বাসার ড্রয়িংরুমে নিপার পরিবার এবং আমার পরিবারের মধ্যে জরুরি মিটিং চলছে। নিপার পরিবারের ইচ্ছা নিপার সব অপরাধ ক্ষমা করে আমার পরিবার যেন নিপাকে ঘরে তুলে নেয়। কিন্তু আমার পরিবার রাজি নয়। তাদের এক কথা, পরপুরুষের সঙ্গে চলে যাওয়া মেয়েকে তারা কোনোভাবেই মেনে নেবে না। আমার পরিবারের সবাই চাইছে আমি এখনই নিপাকে তালাক দিয়ে দিই। আমি কোনো কথা না বলে চুপচাপ সবার কথা শুনছি। নিপা আসার পর থেকে একটাও কথা বলেনি। অসহায়ের মতো মাথা নিচু করে সে বসে আছে। অথচ দুই দিন আগেও এই মেয়েটি তার চঞ্চলতা দিয়ে বাসাটি মাতিয়ে রেখেছিল।
আমি আজ সকালে থানা থেকে ছাড়া পেয়েছি। নিপার বাবা-মা আমাকে ছাড়িয়ে এনেছেন। কনস্টেবল আবুল ভাইয়ের ধোলাই খেয়ে আমার অবস্থা খুবই খারাপ। পুরো শরীরে ব্যথা। আমাকে এত মারার পরও আমি নিপা কোথায় আছে, সেটা পুলিশকে বলিনি। তার কারণ, নিপা আমাকে অনুরোধ করেছিল কাউকে কিছু না বলার জন্য। বিয়ের পর স্ত্রী প্রথম কিছু আবদার করল। সেটা তো আর না রেখে পারা যায় না, তাই না?
সেদিন যখন সিনেমা হল থেকে বের হয়ে নিপাকে পেলাম না, তখন নিপার নম্বরে ফোন দিয়েছিলাম। কিন্তু নিপার ফোন তখন বন্ধ ছিল। এরপর আমি যখন চারদিকে পাগলের মতো নিপাকে খুঁজছি, ঠিক তখনই নিপার ফোন থেকে একটা টেক্সট মেসেজ এল। মেসেজটি ছিল, ‘আমি জানি তুমি এখন আমাকে খুঁজছ। শোনো, আমাকে খোঁজার কোনো দরকার নেই। আমি ভালো আছি। তুমি বাসায় চলে যাও। আমি আমার বয়ফ্রেন্ড সাব্বিরের সঙ্গে চলে যাচ্ছি। ও আমাকে খুব ভালোবাসে। ছয় মাস আগে ওর সঙ্গে আমার পরিচয়। তার পর থেকেই আমাদের সম্পর্ক। তোমার চিন্তার কিছু নেই, আমি সময়মতো তোমাকে ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দেব। তুমি অন্য কাউকে বিয়ে করে নিয়ো। ও, আরেকটি কথা, আমি কার সঙ্গে গেলাম, কোথায় গেলাম, সেটা আমার মা-বাবা বা অন্য কাউকে বোলো না।’
থানা থেকে চলে আসার সময় আবুল ভাই আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললেন।
-ভাই কাঁদেন ক্যান? আপনি আমাকে হাগাতে পারেননি, সেই দুঃখে কাঁদছেন?
-আপনার মতো একজন নিরাপদ মানুষকে অন্যায়ভাবে মেরেছি বলে কাঁদছি। আসলে আমি আমার স্ত্রীকে খুব ভালোবাসি। যখন শুনলাম আপনি আপনার স্ত্রীকে খুন করেছেন, মাথায় কেমন জানি আগুন ধরে গিয়েছিল। তাই আপনাকে এত মেরেছি। আপনাকে কথা দিলাম, আজকের পর আর কারও গায়ে হাত তুলব না। এমনকি বড় স্যাররা বললেও না। প্রয়োজনে চাকরি ছেড়ে দেব। তবু কাউকে মারব না। সে যত বড় আসামি হোক না কেন। কাউকে বিচার করা আমাদের কাজ না। এটা আদালতের কাজ।
মিটিংয়ে আমি কোনো কথা বলছি না, কারণ আমি পরিবারের সবার মতামত বোঝার চেষ্টা করছি। বড় বোন বললেন,
-যে মেয়ে বিয়ের পর স্বামীকে রেখে বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে চলে যায় এবং দুই দিন তার সঙ্গে থেকে আসে, তাকে তো আমরা কেন, দুনিয়ার কেউই ঘরে তুলবে না। আপনারা আপনাদের মেয়েকে নিয়ে যান।
নিপার মা-বাবা কোনো উত্তর দিলেন না। এবার দুলাভাই বললেন,
-আপনাদের মেয়ের জন্য আমরা এখন আত্মীয়স্বজন কারও সামনে মুখ দেখাতে পারছি না। আপনার মেয়ের কারণে আমাদের ছেলেকে থানা-পুলিশ করতে হলো। তাকিয়ে দেখেন ছেলেটাকে পুলিশ মেরে কী করেছে। আমরা এই মেয়েকে কোনোভাবেই ঘরে তুলতে পারব না।
হঠাৎ করে চোখে পড়ল, নিপা মাথা নিচু করা অবস্থাতেই গোপনে চোখের পানি মুছছে। নিপার চোখে পানি দেখার পর মনে হলো, এভাবে আর চুপ করে থাকা যায় না।
-আমি বুঝলাম না, বিয়ে করেছি আমরা দুজন। এখন আমরা একসঙ্গে থাকব, নাকি ডিভোর্স দেব, সেটা তো আমরা ঠিক করব। এটা আমার আর নিপার ব্যাপার। আপনারা কথা বলছেন কেন? আমি ঠিক করেছি, নিপাকে সম্মানের সঙ্গে ঘরে উঠিয়ে নেব। আর ঘরে ওঠাব বলছিই বা কেন? এটা তো ওরই ঘর। কারও করুণা নয়, ও ওর দাবি নিয়েই ঘরে উঠবে।
আপা আমার কথা শেষ না হতেই ধমকে উঠলেন,
-তুই চুপ কর গাধা। মা শোনো, তোমার পোলার আসলেই কোনো মেরুদণ্ড নাই। অপদার্থ একটা।
মা আপার কথার কোনো উত্তর না দিয়ে নিপাকে প্রশ্ন করলেন,
-আচ্ছা মা, তুমি কি বলবে, কেন তুমি এমন করলে? আর যখন চলেই গেলে, তখন ফিরেই-বা আসতে চাইছ কেন?
নিপা কথা বলার আগে আমি বললাম,
-মা, এসব প্রশ্ন করে তুমি ওকে বিব্রত করছ কেন? নিপা শোনো, তোমার কিছু বলার দরকার নাই। তুমি চুপ থাকো।
নিপা এবার চোখ তুলে আমার দিকে তাকাল। তারপর কিছুক্ষণ আমার চোখের দিকে একইভাবে তাকিয়ে রইল। খেয়াল করলাম, ওর চেহারায় এতক্ষণ যে অসহায় ভাবটা ছিল, তা এখন আর নেই। সেখানে ফুটে উঠেছে নির্ভার একটা ছায়া। নিপা আমার চোখের দিকে তাকিয়েই বলল,
-তুমি এত ভালো কেন?
এরপর নিপা মায়ের দিকে তাকিয়ে বললেন,
-সাব্বির অনেক বড় ব্যবসায়ী। ওর সঙ্গে পরিচয় হয়েছে মাত্র ছয় মাস। আমাদের মধ্যে একটা সম্পর্ক গড়ে উঠছিল। একসময় আমি বুঝতে পারি, ও মাদকাসক্ত। ওর সঙ্গে অনেক নারীর সম্পর্ক আছে। আমি ওর কাছে থেকে চলে আসার চেষ্টা করতে থাকি। ওর ধারণা ছিল, ওর টাকাপয়সা, বিলাসবহুল জীবনযাপন দেখে অন্যদের মতন আমিও ওর সঙ্গেই থাকব। আমি হুট করে এভাবে বিয়ে করে ফেলব, সেটা ও বুঝতে পারেনি। বিয়ের পরদিন ও আমাকে অভিনন্দন জানিয়ে মেইল করে। ও আমার সঙ্গে একটু দেখা করার আবদার করে। আমি রাজি না হলে ও বলে, শুধু পাঁচ মিনিট কথা বলবে। সরাসরি আমাকে বিয়ের শুভেচ্ছা জানাবে। এটুকুই ওর চাওয়া। আমি তাতেও রাজি হইনি। তখন ও আমাকে হুমকি দিল, যদি আমি একবার দেখা না করি, তাহলে ও আমার স্বামীকে খুন করবে। আসলে আমি এ কথায় ভয় পেয়ে যাই। কারণ, আমি জানি, ওর সেই ক্ষমতা আছে। এরপর আমি দেখা করতে রাজি হই। ও-ই বলল সিনেমা দেখতে বসুন্ধরায় যেতে। বসুন্ধরায় ওদের অনেক দোকান আছে। বলল, তার কোনো একটাতে বসে শুধু পাঁচ মিনিট কথা বলবে।
এটুকু বলে নিপা থেমে যায়। একটু পর আবার বলা শুরু করে,
-আমি সিনেমা হল থেকে বাথরুমের কথা বলে বের হলেই সাব্বিরের এক কর্মচারী আমাকে ওর দোকানে নিয়ে যায়। দোকানের পেছন দিকে ওর ছোট্ট একা অফিস রুম আছে। ওখানে আমি যেতে চাইনি। কিন্তু ও আমাকে জোর করে রুমে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়। তারপর আমার কাছে থেকে ফোন নিয়ে রানাকে টেক্সট পাঠায়। ওই রুমেই শয়তানটা আমাকে দুদিন আটকে রেখে নির্যাতন করেছে। পরে র্যাব গিয়ে সাব্বিরকে আটক করে এবং আমাকে উদ্ধার করে নিয়ে আসে। আমি এ বাসায় আসতে চাইনি। মা-বাবা আমাকে জোর করে নিয়ে এসেছে। মা-বাবা কী চায় আমি জানি না। তবে আমি ডিভোর্স চাই। আমার পক্ষে রানার সঙ্গে আর সংসার করা সম্ভব নয়।
এ কথা বলেই নিপা হু হু করে কেঁদে ওঠে। আমি আমার আসন থেকে উঠে গিয়ে সবার সামনে নিপার হাতটি ধরি। তারপর ওকে আমাদের রুমে নিয়ে আসি। নিপাকে বিছানায় বসিয়ে আমি নিপার পায়ের কাছে মেঝেতে বসি।
-নিপা শোনো, আমাদের জীবন থেকে আমরা ওই দুটো দিন বাদ দিয়ে দেব। মাত্র দুটো দিন তো, দুটো মানুষের পুরোটা জীবন বদলাতে পারে না, তাই না? তুমি আমার কাছে আগে যা ছিলে তা-ই আছ, তা-ই থাকবে।
-তুমি এত ভালো কেন? আপা ঠিকই বলে, তোমার আসলেই মেরুদণ্ড নাই। না হলে এমন পচা বউকে কেউ সঙ্গে রাখতে চায়?
-তুমি পচা না। যারা তোমাকে ছুঁয়েছে, তারাই পচা।একজন নোংরা মানুষের নোংরামিতে কেউ পচে যায় না।
-তোমার কথা হয়তো ঠিক। কিন্তু শুধু তোমাকে-আমাকে নিয়েই তো আমাদের জীবন না। এখানে আমাদের পরিবার, আত্মীয়স্বজনও আছে। তুমি তো বুঝতে পারছ, তারা কেউই আমাকে গ্রহণ করতে চাচ্ছে না। আমি যদি এখন তোমার জীবনে থেকে যাই, তাহলে সারা জীবন সবাই আমাকে বাঁকা চোখে দেখবে। সবাই বলবে, রানা ধর্ষণের শিকার এক মেয়ের সঙ্গে সংসার করছে। কেউ আমাদের মন থেকে মেনে নিতে পারবে না।
-কাউকে মেনে নিতে হবে না। এটা তোমার আর আমার জীবন। দরকার হলে আমি আর তুমি সবার থেকে অনেক দূরে চলে যাব।
-পরিবার থেকে, সবার কাছ থেকে দূরে চলে গেলে তুমি ভালো থাকবে না রানা। তা ছাড়া আমি চাইলেও ওই ভয়ংকর দুটো দিন ভুলতে পারব না। আমার শুধু মনে হচ্ছে আমার শরীরটায় পচন ধরেছে। এই পচা শরীরটা আমি আর বহন করতে পারছি না। আমি তোমাকে ঠকাতে চাচ্ছি না।
-তুমি আমাকে ঠকাতে পারবেও না। কারণ তোমার ভালোবাসা শুধু আমার জন্য। ওখানে কি আর কারও ভাগ আছে?
-না, নেই। তোমার সঙ্গে তিন দিন থেকে আমি বুঝে গেছি, কত অসাধারণ একটা ছেলে তুমি। একটু বোকা, তবে অনেক ভালো। তোমার সবচেয়ে ভালো গুণ কী, তা তুমি জানো? তুমি নারীকে নারী নয়, মানুষ হিসেবে দেখো। এটা সবাই পারে না।
-এত প্রশংসা করলে তো ফুলে যাব।
-হা হা হা...। আচ্ছা ফুলতে ইচ্ছা হলে একটু ফুলে যাও। সমস্যা নাই। রানা, তোমার কাছে আজ দুটো জিনিস চাইব, আমাকে দেবে?
-অবশ্যই। দুটো কেন, হাজারটা চাও।
-না দুটো হলেই চলবে।
-তবে একটা কথা, তালাক চাইতে পারবে না। ওটা আমি তোমাকে দেব না।
-ঠিক আছে চাইব না। তবে আমার দুটো কথা তোমাকে অবশ্যই রাখতে হবে।
-ঠিক আছে বলো
-আমাকে এখন খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কপালে একটা চুমু দাও। যাতে স্বামীর পবিত্র ছোঁয়ায় আমার শরীরটা পবিত্র হয়ে যায়।
আমি নিপাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম।
-আরও শক্ত করে ধরো। পারলে আমাকে তোমার পাঁজরের মধ্যে ঢুকিয়ে ফেলো। যাতে কেউ আমাকে আর ছুঁতে না পারে। কেউ আমাকে আর খুঁজে না পায়।
বলেই নিপা কেঁদে উঠল। আমি নিপাকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম। তারপর কপালে একটা চুমু খেলাম।
একটু পর নিপা আমাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল।
-এই গাধা,এত শক্ত করে কেউ ধরে? আমার হাড্ডিগুড্ডি সব তো গুঁড়ো হয়ে গেল।
-তুমিই তো বললে জোর করে ধরতে।
-তাই বলে এত জোরে? হা হা হা...গাধা একটা। আমার প্রথম কথাটি রাখার জন্য ধন্যবাদ।
-ওয়েলকাম। এবার অন্যটি বলো।
-তুমি আমাকে তালাক দিতে মানা করেছ,আমি তোমাকে কথা দিয়েছি, আমি তালাক দেব না। তবে আজকের পর তুমি আমার সামনে আর কখনো আসবে না। আমাকে ফোন করবে না, আমার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করবে না। তুমি চাইলে যেকোনো সময় আমাকে তালাক দিতে পারো। যাকে খুশি তাকে বিয়ে করতে পারো। আমার কোনো আপত্তি থাকবে না।
-নিপা, তুমি এগুলো কী বলছ? এটা সম্ভব নয়।
-কেন সম্ভব নয়? তুমি আমাকে এইমাত্র কথা দিয়েছ।
-আমি যদি জানতাম তুমি এমন কিছু চাইবে, তাহলে কথা দিতাম না। আমি তোমাকে না দেখে থাকতে পারব না। তোমার থেকে দূরে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব না।
-কেন? তোমারও কি সাব্বিরের মতো আমার দেহটা দরকার? দেহভোগ ছাড়া শুধু স্বামী হিসেবে থাকা যায় না?
-নিপা, তুমি অনেক বড় কথা বলে ফেলেছ। এত বড় কথা না বললেও পারতে। তুমি এই কথা বলে আমার ভালোবাসাকে অপমান করেছ। ওকে, তুমি যখন চাচ্ছ, আমি তোমার সামনে আর আসব না। কিন্তু আমরা কি সারা জীবন এভাবেই থাকব?
-জানি না।
বলেই নিপা দরজার দিকে পা বাড়াল। দরজার কাছে গিয়ে একটু থামল। তারপর হঠাৎ করেই দৌড়ে এসে আমার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল। ওর চোখের পানিতে আমার বুকটা ভিজতে লাগল। আমিও নিপাকে জড়িয়ে ধরলাম। এরপর হঠাৎ করেই নিপা আমার ঠোঁটে আলতোভাবে ওর ঠোঁট ছোঁয়াল। তারপর ঝড়ের বেগে দরজা খুলে রুম থেকে চলে গেল। আমি পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থেকে তার চলে যাওয়া দেখলাম।
বি. দ্র.: নিপার সঙ্গে আমার কোনো যোগাযোগ নেই। তবে যতটুকু খবর জানি, ও এখন আমেরিকায় পড়ালেখা করছে। আর আমি? আমি এখন প্রতিরাতে রুমের দরজা বন্ধ করে লুডু খেলি। কী ভাবছেন, আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে? তাই পাগলের মতো একা একা লুডু খেলি? না, আমার মাথা ঠিকই আছে। আমি একা একা লুডু খেলি না। আসলে প্রতি রাতে নিপা আমেরিকা থেকে চলে আসে। ওর সঙ্গেই লুডু খেলি। জানেন, এই পাগল মেয়েটা লুডু খেলায় এতটা এক্সপার্ট যে আমি একটা গেমও জিততে পারি না। শেষ
লেখক: ইমদাদ বাবু, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র। [email protected]