বিদেশে বাংলাদেশ বলতে আমার কর্ম ও পণ্য বোঝায়

আমার নানা সুইডেনের সবচেয়ে বৃদ্ধ বিদেশি, যাকে সুইডিশ সরকার ভিসা দিয়েছিল বেড়াতে আসার জন্য। আমার ছোট মামা সুইডেনপ্রবাসী, থাকেন স্টকহোমে। নানা তাঁর বাড়িতেই ওঠেন তখন। আমি নিজেও সে সময় স্টকহোমে। আমাদের ছেলে জনাথান মৃধার সবে জন্ম হয়েছে (১৯৯৫)। আমার স্ত্রী মারিয়াসহ গেলাম নানার সঙ্গে দেখা করতে। মারিয়া নানাকে দেখেই বলল, ‘আব্রাহাম লিংকনের চেহারার সঙ্গে বেশ মিল রয়েছে তোমার। তাঁর মতো তুমিও কি সমাজসেবী? তা, নারীদের জীবন পরিবর্তনে তোমার চিন্তাভাবনা কী? শিক্ষার মাধ্যমে কীভাবে নারীর ক্ষমতায়ন ঘটানো যায় এবং তারা কীভাবে দেশ ও সমাজের টেকসই উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারে? তুমি কীভাবে নারীদের দেখ এবং তারাও সমাজ গঠনে মাঠে নামুক, তা চাও?’

নানার ভাঙা ভাঙা ইংরেজির মধ্যে আমি অনুবাদক হিসেবে কাজ করছি। জনাথান নানার কোলে শুয়ে দিব্যি ঘুমাচ্ছে। সব কথার উত্তর যথাযথভাবে শেষ হলো। তবে নারীদের কীভাবে দেখেন নানা, সে উত্তর ছিল মারিয়ার কাছে পছন্দনীয়, যা সে আজও ভোলেনি।
সেদিন নানা বলেছিলেন, ‘নারী জাতি ফুলের মতো। তাদের যত্ন করে না রাখলে তারা ঝরে যাবে। তাই আমি মনে করি, তাদের সম্মান উঁচুতে রাখা দরকার।’ হ্যাঁ, আমার নানা চেষ্টা করেছেন সেভাবেই স্বাধীনতার বিপ্লব ঘটাতে।

আমার নানার জন্ম ১৮৯২ সালে, মৃত্যুবরণ করেন ১৯৯৯ সালে। দীর্ঘ ১০৭ বছরের জীবনে চিত্রা নদীর তীরে তাঁর বিশাল বাড়ি রয়েছে, যা আজও জমিদারি ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। সেই জমিদারি দেখতে হলে যেতে হবে নড়াইলের মধ্যপল্লি ইউনিয়নের তারিখাদা গ্রামে।

ব্রিটিশ তাড়িয়ে পাকিস্তান, পাকিস্তান তাড়িয়ে বাংলাদেশ গঠনে দেশ ও জাতির জন্য সারা জীবন কাজ করেছেন তিনি। রাজনীতিতে কখন, কাকে মনোনীত করতে হবে, এটা ছিল তাঁর জন্য যেমন গুরুদায়িত্ব, একই সঙ্গে মানুষের জন্য কাজ করা, শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন করা—এসব ছিল তাঁর জীবনের উদ্দেশ্য। সুইডেনে মাসখানেক থাকা অবস্থায় নানার শারীরিক অসুস্থতা দেখা দেয়। সুইডেনে বিদেশি নাগরিকদের চিকিৎসার খরচ নিজেদের বহন করতে হয়। কিন্তু আমার নানার সামান্য শারীরিক চিকিৎসা থেকে শুরু করে সুইডেনের পুরো সময়ের সব খরচ সুইডিশ সরকার বহন করে। মাসখানেক পর সুইডেনের পক্ষ থেকে নানাকে সম্মানসূচক নাগরিকত্ব সনদটি প্রদান করা হয় মূলত একটি কারণে। সেটা হচ্ছে সুইডেনে প্রথম কোনো ১০০ বছর বয়সী ব্যক্তি এসেছেন ট্যুরিস্ট হিসেবে এবং তা–ও বাংলাদেশ থেকে। সুইডিশ কর্তৃপক্ষ বলেছিল, ‘১০০ বছর বয়সে বাংলাদেশ থেকে তুমি বেড়াতে এসেছ আমাদের দেশে এবং তোমার শখ আমাদের জাতীয় সংসদ ভবন ও গণতন্ত্রের যে সেরা চর্চা সুইডেনে আছে, সেটা দেখা—বিষয়টি আমাদের কাছে ভালো লেগেছে।’ যা–ই হোক, নানাকে সুইডিশ সংসদ ভবন ঘুরে দেখানো ও সুইডিশ সিস্টেম সম্পর্কে অবগত করানো ছিল আমাদের জন্য একটি বিশেষ সুযোগ।

যখনই কোথাও কোনো সুইডিশের সঙ্গে নানাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছি, সবাই যে কথাটি বলত, সেটা হলো, আব্রাহাম লিংকনের সঙ্গে নানার চেহারার মিল।

দুঃখের বিষয় আব্রাহাম লিংকনের জন্ম ১৮০৯ সালে, মৃত্যু ১৮৬৫ সালে। নানার জন্মের বেশ আগেই তাঁকে মেরে ফেলা হয়, না হলে লিংকনও হয়তো নানার মতো শত বছর বেঁচে বিশ্বে মানবজাতির জন্য আরও কল্যাণ বয়ে আনতেন। আব্রাহাম লিংকন বেঁচে নেই, বেঁচে আছে তাঁর নীতি ও আদর্শ। আমার নানা বেঁচে নেই, কিন্তু বেঁচে আছে তাঁর কর্মের ফল, সেটা হলো পরাধীন জাতিকে স্বাধীন করা।

আজ বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু স্বাধীন হয়নি আমাদের বিবেক, নৈতিকতা ও চরিত্র। হঠাৎ এত বছর পর কেন এসব কথা? যে নানা এসেছিলেন সুইডেনের গণতন্ত্র দেখতে, মানুষের চরিত্র বুঝতে, যাঁকে সুইডিশ সরকার সম্মানসূচক নাগরিকত্বের সনদ দিয়েছিল, সেই দেশের মানুষকে কীভাবে বাংলাদেশ তার নিজ দেশের জাতীয় ফল ভেজাল, কাঁচা, পচা কাঁঠাল, আম, সবজি ও পচা মাছ পাঠাতে পারে? ভাবতেই গা শিউরে ওঠে আমার। কবে হবে বাঙালির চরিত্রের পরিবর্তন? এত সুন্দর ফলমূল থাকা সত্ত্বেও নৈতিকতার অবনতির কারণে তা বিশ্ববাজারে বিক্রি করা যাচ্ছে না, এর চেয়ে লজ্জার, ঘৃণার আর কী থাকতে পারে? বাংলাদেশের সরকার ও কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি আচরণ পরিবর্তনের জন্য। বাংলাদেশের পরিচয় হোক তার সুকর্মে, এমন দাবি করতেই পারি সুযোগ্য নাগরিক হিসেবে। আমি আমার ‘বাংলাদেশি’ নাগরিকত্ব পেতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশ স্বাধীন করতে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিলাম। সেই দেশের নাগরিক হয়ে অনুরোধ করছি, প্লিজ, নৈতিকতার বিসর্জন না দিয়ে, দুর্নীতি না করে, ভেজালমুক্ত পণ্য বিদেশে পাঠান। মনে রাখা দরকার, বিদেশে আমাদের কর্ম ও পণ্যই আমাদের পরিচয়, আমাদের গর্ব, সবকিছুরই একটি নাম—বাংলাদেশ।

লেখক: রহমান মৃধা, সুইডেন