বিটিফোরসেভেনফোন সেল এবং আমরা

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

আজ আমাদের অবস্থান, মূল্যবোধ, সমালোচনা, আর প্রতিক্রিয়া দেখে BT474 সেলের (cell) কথা না বলে পারছি না। BT474 একটি ব্রেস্ট ক্যানসার সেল লাইন। আমার এই সেলের সঙ্গে যখন পরিচয় হয়, যখন আমি Lapatinib নামের একটি ড্রাগের টেস্ট করি এই সেল ব্যবহার করে। আমাকে বেশ কিছুটা সময় ব্যয় করতে হয়েছে শুধু BT474–এর আচরণবিধি আর বৃদ্ধি বোঝার জন্যই। কারণ, যেভাবে সেলের স্বাভাবিক বৃদ্ধি হওয়ার কথা সেভাবে কাজ সে করছিল না। পর্যবেক্ষণ করে দেখলাম, একটি প্লেটে সেলের বিকাশ ঠিকমতো হয় তো আরেকটি প্লেটে কারা যেন এসে সংঘবদ্ধ হয়ে আসল সেলকে মেরে নিজেরা বাড়তে থাকে। আমি বিভ্রান্তিতে পড়ে যাই; এরা আসলে কারা হতে পারে? অনেকটা ব্যাকটেরিয়ার মতো, তথাপি না ব্যাকটেরিয়া, না ইস্ট, না ফাঙ্গাস! কী করা যায়? অতঃপর এই সেল নিয়ে আগে যারা কাজ করেছেন, তাদের সঙ্গে সমস্যাটা নিয়ে কথা বলি। কিছু অস্বাভাবিক BT474 সেলের ছবি তাদের দেখাই। মতামত, নতুন আগমনকারীরা আর কেউ না, তাদের পরিচয়, তারা ‘cell debris’। বাংলায় যাকে বলে ‘সেল ধ্বংসাবশেষ’। সেল ধ্বংসাবশেষ সেলের অরগানিক বর্জ্য পদার্থ, যা সাধারণভাবে সেল মরে গেলে নির্গত হয়। কিন্তু সমস্যা হয় যখন মাত্রাতিরিক্ত সেল ধ্বংসাবশেষ হয়, আর তখন আসল সজীব সেলকে খুঁজে পাওয়া যায় না। তাই আমি সেল ধ্বংসাবশেষের মধ্যে BT474–এর স্বাভাবিক অস্তিত্ব খুঁজে পাইনি। অবশেষে আবার নতুন BT474 নিয়ে আমার গবেষণা শুরু করি।

আমার কাজের এ অভিজ্ঞতা বর্ণনা করার একটি কারণ আছে। তা হলো, আমরাও আসলে পরিস্থিতি সাপেক্ষে সেই ক্যানসার সেল BT474–এর মতোই আচরণ করি। অত্যন্ত অনুতাপের সঙ্গে প্রকাশ করতে হয়, যখনই দেখি আমাদের মধ্যে কেউ নেতৃত্ব দিয়ে নতুন কোনো সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করার চেষ্টা করছে, তখনই আমরা দুটি দলে বিভক্ত হয়ে যাই, স্বপক্ষ আর বিপক্ষ।

স্বপক্ষ দলের ব্যক্তিরা নিজেদের চিন্তা আর মূল্যবোধের ক্ষেত্রে মিথ্যা অহমিকায় রপ্ত নয়, তাই তাদের ‘ধ্বংসাবশেষ’ হয় না, তারা ইতিবাচক যুক্তির পক্ষে। পক্ষান্তরে, বিপক্ষে যারা অবস্থান করে, নিজেদের চিন্তা আর বিবেচনা মূল্যবোধের ‘ধ্বংসাবশেষ’ তারা নিজেরাই তৈরি করে, যেখানে স্বাভাবিক বিকাশের পথ হয় ব্যাহত, নেতিবাচক ভূমিকাই থাকে মুখ্য। তাদের চেনা বড় কঠিন। কখনো মনে হয় সেলের ধ্বংসাবশেষের মতো আচরণ করে আবার কখনো মনে হয় ব্যাকটেরিয়া, ইস্ট কিংবা ফাঙ্গাসের মতো হয়ে সাধারণ মানুষের জীবনের সঙ্গে মিশে তাদের জীবন সংক্রমিত করে।

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

আমার এ বক্তব্য উপস্থাপন করার মূল কারণ সাম্প্রতিক সময়ের করোনার ভ্যাক্সিন উদ্ভাবনের সম্ভাবনা এবং বাংলাদেশ গ্লোব বায়োটেকের অবদানের মূল্যায়ন প্রসঙ্গে। গ্লোব বায়োটেকের ড. আসিফ মাহমুদ প্রেস কনফারেন্সে বলেন, করোনা ভ্যাক্সিন উদ্ভাবনের ব্যাপারে বাংলাদেশ আশাবাদী। প্রাথমিকভাবে তারা র‌্যাবিট (rabbit) মডেলে অ্যান্টিজেন প্রয়োগের পর সফলভাবে SARS-CoV-2–এর বিরুদ্ধে এর প্রতিরোধ ক্ষমতা পর্যবেক্ষণ করেছেন এবং অ্যান্টিবডি শনাক্ত করেছেন। যদিও অনেক পথ বাকি আছে নির্ধারিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে, এরপরও তিনি যে আশার আলোর কথা দৃঢ়প্রত্যয়ের সঙ্গে ব্যক্ত করেছেন তার মূল্য কি আমাদের জন্য কম? আমরা অনেকেই এই সাহসী পদক্ষেপের জন্য সাধুবাদ জ্ঞাপন করেছি, আবার অনেকে অহেতুক সমালোচনায় লিপ্ত হয়েছি। আফসোস! আমরা কি আমাদের দেশের যোগ্য ব্যক্তির কাজের সঠিক মূল্যায়ন করতে পারব না? কেন আমরা স্বাগত জানাতে কার্পণ্য দেখাব, যারা নতুন কিছু উন্মোচনের পথে অবদান রাখার ব্যাপারে এগিয়ে আসেন? কেন আমরা তাদের জয়গান করতে পারি না বা চাই না? তাদের পথকে আরও প্রসারিত করার জন্য কেন আমরা সহজে এগিয়ে আসতে পারি না? ঠিক এমনিভাবে কিছুদিন আগেই আমরা পেয়েছিলাম গণস্বাস্থ্য উদ্ভাবিত করোনা শনাক্তকরণ কিট, সেটাকেও অতিরঞ্জিত আর অবজ্ঞার চক্রে নিপীড়িত হতে হয়েছে। কোন স্বার্থের জন্য এই কাজগুলো হয়, তা আমরা নিজেরাও জানি না। নেতিবাচক সমালোচনার অন্তরালে হারিয়ে যায় আমাদের প্রতিভার মূল্যবান অবদান। প্রকৃতপক্ষে আমাদের এরূপ কর্মকাণ্ডে আমরা নিজেরাই হারিয়ে যাই, মাথা নিচু করে পরে থাকি আমাদেরই ধ্বংসাবশেষ হয়ে।

BT474–এর মতো যদি আমাদের ধ্বংসাবশেষ সংখ্যায় অনেক বাড়তে থাকে, তবে তা আমাদের জন্য এক মহা বিপৎসংকেত। আমাদের কাজ এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে ওই ধ্বংসাবশেষকে বাদ দিয়ে। সংঘবদ্ধ হতে হবে সজীব, নবীন ও মুক্তচিন্তার মতাদর্শের তরুণদের। এটা ঠিক যে বিজ্ঞানের অগ্রগতির ক্ষেত্রে গঠনমূলক সমালোচনা খুবই প্রয়োজন এবং স্বাভাবিক, কিন্তু অবাঞ্ছিত, মূল্যহীন আর অর্বাচীন বিতর্ক, নতুন উন্মোচনের পথকে শুধু ব্যাহতই করে না, নিজেদের ভেতরের আবর্জনাকে আর অসমতাকে আরও অনেক বাড়িয়ে তোলে। কিন্তু এ অবস্থার পরিবর্তন হতে হবে। তাই আর নয় নেতিবাচক সমালোচনা, সব ধ্বংসাবশেষ সরিয়ে আমাদের নবীন, মেধাবী আসিফ মাহমুদের মতো প্রজ্ঞাশীল সাহসী তরুণ গবেষকদের এগিয়ে আসতে হবে। আমরা হারাতে চাই না ড. আসিফ, ড. বিজন কুমার শীলদের অবদানকে। বিজ্ঞানকে সাধারণ মানুষের প্রয়োজনে কাজে লাগাতে হবে। আমরা নবীনেরা এই পরিবর্তন আনার অপেক্ষায় আছি।


*লেখক: রিসার্চ সায়েন্টিস্ট, ক্যানসার রিসার্চ, ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র। [email protected]