বিলাতে এসে যখন গাড়ি চালানো শিখলাম, তখন বিভিন্ন সময় নর্থ–ওয়েস্ট লন্ডনের অ্যাবি রোড দিয়ে যাতায়াত করতাম। একটা জিনিস প্রায়ই লক্ষ করতাম যে অ্যাবি রোডের একটি জেব্রা ক্রসিংয়ে সব সময় অনেক মানুষের ভিড় লেগে থাকত। গাড়ি স্লো করলে কিংবা থামালেও কেউ পারাপার হতো না। সবার হাতে ক্যামেরা থাকত যেন কোনো কিছুর শুটিং চলছে। প্রথম প্রথম ভাবতাম হয়তো কোনো কারণে সবাই ভিড় করছে অথবা আশপাশে কোনো মিউজিয়াম বা ট্যুরিস্ট স্পট আছে, যা দেখতে মানুষ ভিড় জমাচ্ছে। এ রকম অনেক দিন গাড়ি চালিয়ে চলে গিয়েছি, কিন্তু জানতাম না, আসল ঘটনা কী।
আরেক দিন চিন্তা করলাম ব্যাপার কী? যতবারই এই জায়গা দিয়ে গাড়ি চালিয়ে যাই, ততবারই ভিড় থাকে সকাল–দুপুর–বিকেল—সব সময়। একদিন গাড়ি পাশের রাস্তায় দাঁড় করিয়ে দেখতে এলাম কেন মানুষের এত ভিড় এই জেব্রা ক্রসিংয়ে।
লন্ডনের ৮-১০টা সাধারণ রাস্তার মতোই অ্যাবি রোডও একটি, যা উত্তর-পশ্চিম লন্ডনের সেন্ট জন্স উড এলাকার গ্রোভ অ্যান্ড রোড থেকে শুরু হয়ে কিলবার্নের কাছে গিয়ে শেষ হয়েছে। রাস্তাটির দৈর্ঘ্য মাত্র এক দশমিক চার কিলোমিটার; যা এক মাইলেরও কম। অ্যাবি রোডের খুব কাছেই রয়েছে বিখ্যাত লর্ডস ক্রিকেট গ্রাউন্ড। এই ছোট সাধারণ রাস্তাটি রাতারাতি পরিচিত হয়ে ওঠে বিশ্ববিখ্যাত রক ব্যান্ড বিটলস তাদের একটি অ্যালবামের নাম ‘অ্যাবি রোড’ দিলে।
আরও মজার ব্যাপার, এই অ্যাবি রোড বিখ্যাত হওয়ার মূল কারণ এই রোডের ওপরে পথচারী পারাপারের একটি ‘জেব্রা ক্রসিং’। বিটলস তাদের অ্যাবি রোড অ্যালবামে যে কভার ফটো ব্যবহার করে, তাতে এই জেব্রা ক্রসিং ছিল। কভার ছবিতে দেখা যায়, ব্যান্ডের চার সদস্য এই জেব্রা ক্রসিং দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন। বিশ্বের ট্যুরিস্টদের কাছে এই জেব্রা ক্রসিং একটি হটস্পট। হাজার হাজার ট্যুরিস্ট প্রতিদিন ভিড় জমান এই ক্রসিংয়ে। অ্যাবি রোড অ্যালবামের কভার ফটোর আঙ্গিকে সবাই ছবি তোলেন। ট্যুরিস্টদের কারণে অ্যাবি রোডে চলাচল করা গাড়িচালকদের প্রায়ই বিপাকে পড়তে হয়।
এই জেব্রা ক্রসিংয়ের পাশে রয়েছে অ্যাপল রেকর্ডসের স্টুডিও, যারা প্রকাশ করেছিল বিটলসের ‘অ্যাবি রোড’ নামের অ্যালবামটি। অ্যালবামটি প্রকাশিত হয় ১৯৬৯ সালে, যা ছিল তাদের শেষ অ্যালবাম—ঠিক পরের বছরই ব্যান্ডটি ভেঙে যায়। এ অ্যালবামের গানগুলো ছিল ভীষণ জনপ্রিয়, আজও এগুলো মানুষের মুখে মুখে ফেরে। ‘কাম টুগেদার’, ‘সামথিং’, ‘ম্যাক্সওয়েলস সিলভার হ্যামার’, ‘ওহ! ডার্লিং’, ‘বিকজ’ ইত্যাদি জনপ্রিয় গান ছিল এই অ্যালবামে।
ব্যান্ডের চার সদস্যের মধ্যে ছিলেন জর্জ হ্যারিসন, পল ম্যাকার্টনি, রিঙ্গো স্টার ও জন লেনন। তাঁদের মধ্যে জর্জ হ্যারিসনের জনপ্রিয়তা আমাদের বাংলাদেশিদের কাছে বেশি। কারণ, বাংলাদেশ নামটির সঙ্গে জর্জ হ্যারিসনের নামটিও যুক্ত হয়ে আছে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় জর্জ হ্যারিসন বিশ্ববরেণ্য সেতার বাদক রবিশঙ্করের সঙ্গে নিউইয়র্কে বাংলাদেশের পক্ষে কনসার্ট করে বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দেন বাংলাদেশের গণহত্যার খবর। ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ নামের কনসার্টে তাঁর গাওয়া ‘বাংলাদেশ’ গানটি বিশ্ববাসীর টনক নাড়িয়ে দেয়। জর্জ হ্যারিসন কনসার্ট থেকে প্রাপ্ত অর্থ দান করেন বাংলাদেশের অসহায় মানুষের জন্য।
বিটলসের ‘অ্যাবি রোড’ অ্যালবামের কভার ছবিটি তোলা হয় ১৯৬৯ সালের ৮ আগস্ট, বেলা ১১টা ৩৫ মিনিটে। ছবির ফটোগ্রাফার ছিলেন ইয়ান ম্যাকমিলান, যাকে মাত্র ১০ মিনিট সময় দেওয়া হয়েছিল এই ব্যস্ত রাস্তায় ছবি তোলার জন্য। আইডিয়াটি ছিল ব্যান্ড সদস্য পল ম্যাকার্টনির। ম্যাকমিলান একটি স্টেপ ল্যাডারের ওপর দাঁড়িয়ে মোট ছয়টি ছবি তোলেন। একজন পুলিশ সদস্য তখন ক্যামেরার পেছনে দাঁড়িয়ে ট্রাফিক আটকে রেখেছিলেন। ছয়টি ছবির মধ্যে একটি ছবি পল ম্যাকার্টনি বাছাই করেন অ্যালবামের জন্য। বিটলস বিশ্বব্যাপী এতই জনপ্রিয় ছিল যে ‘অ্যাবি রোড’ অ্যালবামের কাভারে ব্যান্ডের নাম কিংবা ব্যান্ড সদস্যদের নাম পর্যন্ত দেওয়া হয়নি। কভারে শুধু অ্যাবি রোড লেখা ছিল।
সেই কভার ছবির সঙ্গে সঙ্গে আজও অ্যাবি রোড এবং এর জেব্রা ক্রসিং বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তার তালিকায় রয়েছে।