বিগ ব্যাং ও মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ

বিগ ব্যাং অর্থাৎ মহা বিস্ফোরণ হচ্ছে মহাবিশ্বের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ নিয়ে এ পর্যন্ত চলে আসা ধারণাগুলোর মধ্যে অন্যতম ও সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য। আর মজার ব্যাপার হচ্ছে, তাত্ত্বিক পদার্থবিদ স্টিফেন হকিং তাঁর এ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম বইটিতে এই বিগ ব্যাং ও পরবর্তীকালের মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ সাধারণ মানুষের বোধগম্য করে তোলার জন্য একটিমাত্র গাণিতিক সূত্র (E =MC^2) ব্যবহার করেছিলেন। আর তিনি বলেছিলেন, ‘যদি আমি বই থেকে এই সূত্রটিও বাদ দিতাম তাহলে নিশ্চিত যে বইটির জনপ্রিয়তা আরও দ্বিগুণ বেড়ে যেত।’ এবার আসি আসল প্রসঙ্গে। সবার জন্য এই বিগ ব্যাং-এর মতো বিষয়টিকে সহজ ও অল্প কয়েক লাইনে চমকপ্রদভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করলাম।
বিজ্ঞানীদের ধারণা, ১৫ বিলিয়ন বছর আগে আমাদের এই মহাবিশ্ব একটি অসীম অথবা অতি ক্ষুদ্রাকার ভরসম্পন্ন অতি উত্তপ্ত বিন্দুতে পুঞ্জীভূত ছিল। পদার্থবিজ্ঞানের ভাষায় এই অবস্থাকে বলা হয় সিঙ্গুলারিটি (Singularity) (এই প্রতিবেদনের সঙ্গে ব্যবহৃত ছবি দেখুন। ছবিটি উইকিপিডিয়া থেকে নেওয়া)।
এরপর মাত্র এক সেকেন্ডের ব্যবধানে ঘটল বিরাট ও অকল্পনীয় এক বিস্ফোরণ। ইতিমধ্যে তাপমাত্রা নেমে এল প্রায় পাঁচ বিলিয়ন ডিগ্রি সেলসিয়াসে। মূলত এটাই ছিল বিগ ব্যাং।
এরপর তিন শ হাজার বছর পেরিয়ে গেল। মহাবিশ্বের তাপমাত্রা এমন একটি পর্যায়ে নেমে আসল, যেটা পরমাণুর (Atom) গঠন তৈরি করতে লাগল। মহাবিশ্বের প্রথম পরমাণু ছিল ক্ষুদ্রতম হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম। হাইড্রোজেন পরমাণুতে বিদ্যমান থাকে একটিমাত্র ইলেকট্রোন, যেটি আরেকটি প্রোটনকে কেন্দ্র করে ঘুর্ণায়মাণ। অপরদিকে হিলিয়ামে আছে দুইটি ইলেকট্রোন, যেটা অপর দুটি নিউট্রন ও দুটি প্রটোনকে কেন্দ্র করে ঘুরছে।
এর আরও প্রায় এক মিলিয়ন বছর পরের কথা। আমাদের সদ্যোজাত মহাবিশ্ব তখনো কোনো গ্রহের জন্ম দেয়নি। শুধুমাত্র অতি উত্তপ্ত মেঘ ও ধুলিকণায় পূর্ণ ছিল। আর এই মেঘ ও ধুলিকণায় বিদ্যমান ছিল ৯৮% হাইড্রোজেন ও ২% হিলিয়াম। আর এটাকে আমরা বিজ্ঞানের পরিভাষায় বলে থাকি নেবুলা।
আরও প্রায় ১০ বিলিয়ন বছর অতিবাহিত হলো। কালের আবর্তনে যে নেবুলার জন্ম হয়েছিল সেগুলোর মধ্যে শুরু হলো একধরনের ফিউশন রিঅ্যাকশন। ফিউশন রিঅ্যাকশন হলো যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ক্ষুদ্র পরমাণুগুলো পরস্পর সংঘর্ষ করে বৃহদাকার পরমাণুতে পরিণত হয়। পাশাপাশি নেবুলার প্যাটার্ন ও সাইজও ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হতে থাকল। এমন একটি পর্যায় এল যখন নেবুলা এক ধরনের বৃত্তাকার চাকতির মতো গঠন প্রাপ্ত হতে লাগল। এই চাকতি সদৃশ রিংয়ের কেন্দ্রস্থলে আবির্ভাব হতে লাগল এক অতি বৃহৎ আকৃতির গোলাকার বল। যতক্ষণ না পর্যন্ত ফিউশন রিঅ্যাকশন শুরু হতো ততক্ষণ পর্যন্ত এই দানবীয় বলটি অত্যন্ত উত্তপ্ত হতে থাকত। আর সেই দানবীয় উত্তপ্ত বলটি হলো আমাদের আজকের সূর্য।
অন্যদিকে যেই চাকতি সদৃশ রিংগুলো গঠিত হয়েছিল সেগুলোর মধ্যে শুরু হতে থাকল অতি মাত্রার সংঘর্ষ। বস্তুত এই সংঘর্ষগুলো ঘটত নানা ধরনের কণা ও ধূলিকণার মধ্যে। আর সময়ের ধারাবাহিকতায় এই সংঘর্ষে জন্ম নেয় নয়টি গ্রহ—মার্কেউরী, ভেনাস, আর্থ (আমাদের পৃথিবী), মার্স, জুপিটার, স্যাটার্ন, ইউরেনাস, নেপচুন ও প্লুটো। আর হ্যাঁ, এগুলোর মধ্যে একটি, যেটিতে আমরা আজ সবাই আছি, সেটা আমাদের পৃথিবী। কিন্তু গল্প এখানেই শেষ নয়...।
এই সৌরজগত সৃষ্টির আরও ৩০ মিলিয়ন বছর পর, আমাদের পৃথিবী গ্রহের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয় মঙ্গল গ্রহের সম আকৃতির গ্রহগুলো। জন্ম নিল নতুন উপগ্রহের। এর একটি হলো আমাদের চাঁদ।
এতক্ষণ বললাম শুধু মহাবিশ্বের উৎপত্তির আদ্যোপান্ত। কিন্তু এ ছাড়াও আরেকটি বিষয় নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হয়েছে সেটা হলো, মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ (Expansion of the Universe)। এই বিষয়টির সত্যতা প্রমাণ করার জন্য আমাদের দুটি প্রশ্নের উত্তর বের করতে হবে।
১) আমাদের পৃথিবী থেকে নক্ষত্রের দূরত্ব কত?
২) নক্ষত্রগুলো যে পরস্পর থেকে সত্যিকার অর্থে যোজন যোজন দূরে যাচ্ছে সেটা কীভাবে নিশ্চিত হব?
এই দুটি প্রশ্নের উত্তর আমাদের মহাবিশ্ব সম্প্রসারণ তত্ত্বকে আরও বেশি জোরদার করবে।
প্রথমে আসি নক্ষত্রগুলো আমাদের পৃথিবী থেকে কত দূরত্বে অবস্থান করছে সেটা জানার জন্য। এর জন্য আমরা Parallax মেথডের সাহায্য নিতে পারি। আমাদের পৃথিবী থেকে সবচেয়ে কাছের নক্ষত্র হচ্ছে Alfa Centauri। মনে করা যাক আমরা গ্রীষ্মকালে আমাদের পৃথিবী থেকে আমরা সুদূর আকাশে একটি নক্ষত্রকে অবলোকন করার চেষ্টা করছি। তাহলে কোনো একপর্যায়ে আমাদের Alfa Centauri সেই নক্ষত্রের পথটিকে আটকে দেবে। সেই পথটিকে আমরা একটি সরলরেখা কল্পনা করি। এবার ধরে নেওয়া যাক শীতকালে পৃথিবী থেকে আমরা সুদূর আকাশে অন্য একটি নক্ষত্রকে অবলোকন করার চেষ্টা করছি, তাহলে কোনো একপর্যায়ে আবারও Alfa Centauri সেই নক্ষত্রের পথটিকে আটকে দেবে। সেই পথটিকে আমরা একটি সরলরেখা কল্পনা করি। সত্যিকার অর্থে পরবর্তী সরলরেখাটি হবে অন্য কোনো কৌণিক দূরত্ব থেকে। যেহেতু আমরা দুইটি ভিন্ন ঋতুতে দূরত্ব মাপছি। তাহলে সেই সরলরেখা দুইটি কোনো একটা বিন্দুতে ছেদ করবে এবং সেখানে একটা কোণ তৈরি করবে। এবার দুটি সরলরেখার উৎপত্তিস্থলের দূরত্ব ও কোণ পরিমাপ করা আমাদের পক্ষে সম্ভব। অবশেষে জ্যামিতিক সূত্র প্রয়োগ করে আমরা একটি সরলরেখার দৈর্ঘ্য মাপলেই বের হয়ে যাবে পৃথিবী থেকে Alfa Centauri-এর দূরত্ব। এভাবে Alfa Centauri-এর দূরত্ব জানলে অন্য তারাদের দূরত্বও বের করা সম্ভব।
সবশেষে তারাদের সরে যাওয়া প্রমাণ করার জন্য আমরা ডপলার ইফেক্ট পদ্ধতি ব্যবহার করতে পারি। ডপলার ইফেক্ট পদ্ধতিতে এটা বারবার প্রমানিত হয়েছে যে ছায়াপথ সব সময়ই সম্প্রসারিত হচ্ছে এবং নক্ষত্রগুলো একে অপর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।
এভাবে জন্ম হয়েছিল আমাদের মহাবিশ্বের, সেখান থেকে আমাদের ছোট্ট পৃথিবী ও সেই সঙ্গে মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ।
(লেখক কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের শিক্ষার্থী)