বিকেরি ক্রিক জলপ্রপাতের হাতছানি

বিকেরি ক্রিকের প্রাকৃতিক দৃশ্য
বিকেরি ক্রিকের প্রাকৃতিক দৃশ্য

বসন্তের বিরতি চলছিল। মার্চের ১১ থেকে ১৫ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ। মনে মনে ভাবছিলাম দু-এক দিনের জন্য কোথাও থেকে ঘুরে আসা গেলে মন্দ হতো না। একটুখানি দম নেওয়া যেত। অনুজপ্রতিম শাহরিয়ারের কাছে ইচ্ছেটুকু ব্যক্ত করলাম।

শাহরিয়ার বলল, ভাই, নাইজেরিয়ার বন্ধু ইসমাইল ১২ তারিখে আটলান্টায় যাচ্ছে। জিজ্ঞেস করলাম কী কাজে? শাহরিয়ার জানাল, পাসপোর্ট নবায়নের কাগজগুলো কনস্যুলেট অফিসে জমা দিতে। আমি বললাম, কতক্ষণ সময় লাগবে? শাহরিয়ার জানাল ঘণ্টাখানেকের বেশি লাগবে না। শুধু পাসপোর্ট নবায়নের কাগজগুলো কনস্যুলেট অফিসে জমা দেবে। বললাম যাব। তবে শর্ত হচ্ছে আশপাশের কোনো প্রকৃতির নিবিড় স্পর্শে নিয়ে যেতে হবে। শাহরিয়ার বলল, ওকে। আমাদের হাতে যথেষ্ট সময় থাকবে।

আমরা দুজনই গুগল করতে থাকি। সার্চ করতে থাকি আটলান্টা শহরের আশপাশে প্রকৃতির কোনো সতেজ অবস্থান? গুগল করতেই কয়েকটি জলপ্রপাতের ছবি সামনে চলে আসে। সব কটিই জর্জিয়া অঙ্গরাজ্যে অবস্থিত। ভরা জোয়ারে টইটম্বুর একেকটি জলপ্রপাত। কিন্তু যে দু-একটা মনে ধরে, সব কটিই একটু দূরে দূরে। প্রায় দুই ঘণ্টার বেশি ড্রাইভ। কাছের মধ্যে যেটা দেখা যাচ্ছে, সেটাও একেবারে মন্দ নয়। বিকেরি ক্রিক ওয়াটার ফলস। আটলান্টা শহর থেকে ঘণ্টাখানেকের ড্রাইভ।

বিকেরি ক্রিকের প্রাকৃতিক দৃশ্য
বিকেরি ক্রিকের প্রাকৃতিক দৃশ্য

ভোররাতে আমরা বের হলাম। সঙ্গে আরও আছে মিশুক ও শাহরিয়ার আজিজ। চারদিকে তখনো আবছা অন্ধকার। শীতের আমেজ তখনো বহাল তবিয়তে বিরাজমান। বাইরে হিমশীতল হাওয়া বইছে। পথের দুই ধারে ল্যাম্প পোস্টের মিটিমিটি আলো জ্বলছে। দু-একটি গাড়ি শাঁই শাঁই করে মিলিয়ে যাচ্ছে দূরের বনের অন্ধকারে। যেতে যেতে চারপাশটা হালকা হতে শুরু করে। পথের দুই ধারের সতেজ বাসউড বৃক্ষের গায়ে লুকিয়ে থাকা ঘন অন্ধকার ধীরে ধীরে বাষ্পের মতো উধাও হতে থাকে। দেখতে দেখতে পুব আকাশে লাল সূর্যটা টগবগিয়ে জেগে উঠতে থাকে একটু একটু করে। আমরাও এগিয়ে চলি আটলান্টার পথে।

শাহরিয়ারের পাকা হাতের ড্রাইভিংয়ে একসময় পৌঁছে যাই গন্তব্যে। আটলান্টা অবার্ন থেকে বেশি দূরে নয়। মাত্র দেড় থেকে দুই ঘণ্টার ড্রাইভ। নাইজেরিয়ার কনস্যুলেট অফিসে যখন পৌঁছালাম, তখন ঘড়ির কাঁটায় সকাল সাড়ে নয়টা। ইসমাইলকে রেখে আমরা চলে গেলাম সিরিয়ানস নামে এক ইন্ডিয়ান গ্রোসারি শপে। যে যার মতো ডাল, মিষ্টি আর সবজি বাজার সেরে নিয়েছি। এর মধ্যে বন্ধু ইসমাইল জানাল, তার কাজ প্রায় শেষ। আমরা ওকে নিয়ে গেলাম আল মদিনা রেস্টুরেন্টে। আফগানি একটি রেস্টুরেন্ট। তখন বেলা এগারোটা ছুঁই–ছুঁই করছে। ভোররাতে বের হওয়াতে সকালের নাশতাটা করা হয়নি। ওখান থেকে সুখ্যাত মজাদার মাটন বিরিয়ানি খেয়েই বের হয়ে গেলাম। গন্তব্য বিকেরি ক্রিক ওয়াটার ফলস।

জিমি কার্টার রোড ধরে ব্রোক রান পার্ক। এরপর ডানউডকে পেছনে রেখে বিকেরি ফলসের দিকে এগিয়ে চলেছি। চমৎকার বাঁধাই করা পথ। চেটাহোচি নদীর পাশ ধরে আঁকাবাঁকা পথ। কখনো কখনো পথের সঙ্গে নদীর জলের মিলিয়ে যাওয়ার প্রয়াস। শীতের ঝরা পাতার বিবর্ণ রূপ। ছোট ছোট পাহাড়ের গায়ে ওঠা নামা সমুদ্রতরঙ্গের মতো অন্তহীন পথের ছুটে চলা। গাঢ় নীল আকাশের নিচে ঝকঝকে রোদ। শীতল বাতাসের অবিরাম বয়ে চলা। স্বল্প সময়ের নাতিদৈর্ঘ্য ভ্রমণ। একটা সময় মনটাকে জিমি কার্টার রোডের অন্তমিলে রৌজ ওয়েলের পথে। সেই রৌজ ওয়েল পথ ধরেই পৌঁছে যাই বিকেরি ক্রিক ওয়াটার ফলসের প্রবেশ দ্বারে।

বিকেরি ক্রিকের প্রাকৃতিক দৃশ্য
বিকেরি ক্রিকের প্রাকৃতিক দৃশ্য

গাড়ি পার্ক করে যখন হেঁটে চলেছি, তখন দূর থেকেই ভেসে আসছে কল কল রব। পাশে ঝোলানো ম্যাপটা একপলক দেখে নিলাম। চমৎকার একটি ঘূর্ণমান বনপথ। সেই পথ চলে গেছে পাহাড়ের পাদদেশে, যেখানটায় জলপ্রপাতটি এসে পড়েছে। মাঝেমধ্যে খাড়া ঢাল বেয়ে নিচে নেমে গেছে পাহাড়ি পথ। যেখানে খাড়া ঢাল সেখানে কাঠের সিঁড়ি বসানো। সে পথ ধরেই হেঁটে চলেছি। পথের বাঁ পাশটা ওপরের দিকে উঠে গেছে। ডান পাশটা ঢাল বেয়ে নেমে গেছে পাহাড়ের ঠিক পাদদেশে। পাহাড়ের পাদদেশ ধরে কল কল রবে বয়ে চলেছে নীলাভ জলের ছড়া। ছড়ার দুই পাশটা খাড়া ঢাল বয়ে উঠে গেছে পাহাড়ের চূড়ায়। পাহাড় সমেত নিবিড় বন্য প্রকৃতি। উঁচু উঁচু বৃক্ষ, মোটা মোটা লতাগুল্ম। দীর্ঘ শীতের তীব্রতায় গাছের পাতারা আগেই ঝরে পড়েছে। পত্রপল্লব হারিয়ে নগ্ন প্রকৃতি যেন তার নিগূঢ় রূপ ধারণ করে আছে। আপন সৌন্দর্য ও নিবিড় প্রাচুর্যে প্রকৃতি যেন আজ আত্মহারা।

হেঁটে চলেছি শীতল জলধারার পাশ ধরে। ছোট ছোট পাথরের চিকচিকে অবস্থান। উৎসুক মনের নিবিড় চাহনি। ঝরঝর রবে মাতোয়ারা আবেগপ্রবণ মন। এতটা পথ হাঁটার পরেও দেখা মেলে না আরাধ্যের সেই জলপ্রপাতের। পায়ে হেঁটে চলি আরও কিছু পথ। অবশেষে অদূরেই দেখতে পাই বিকেরি ফলসের সতেজ অবস্থান। একটা আনন্দের ঢেউ খেলে গেল মনের রাজ্যে। যতই এগোতে থাকি, ততই যেন বাড়তে থাকে গর্জন। বাড়তে থাকে বড় বড় পাথরের অনড় অবস্থান। শীতল জলধারার ঝরঝর রব টানতে থাকে আরও নিকটে। জলের মধ্যে পা ভিজাতেই হিমশীতলের উষ্ণ অনুভূতি। আরও একটু এগিয়ে গেলে হিমহিম জলের গাঢ় বাষ্প আছড়ে পড়ে চোখে মুখে। এক অন্য রকম অনুভূতি। অন্য রকম শিহরণ আর অবাক বিস্ময়ে কেটে যায় অনেকটা সময়। অবিরাম জলপ্রপাতের খিল খিল হাসির শব্দে আবিষ্ট হয়ে ওঠে দেহমন। হাঁটুপানিতে নেমে দাঁড়াই। তাকিয়ে থাকি জলপ্রপাতের মুখ পানে। বিরামহীন ঝরে পড়ছে পাহাড়ের আবেগ সিক্ত অশ্রু। হাত দুটি পাখির মতো মেলে ধরি দুই প্রান্তে। তাকিয়ে থাকি ওপরে, দূর দিগন্তের দিকে। জলপ্রপাতের ওপরে পাহাড়ের দুই পাশ থেকে আছড়ে আছে পত্রহীন উঁচু উঁচু বৃক্ষ। তার ওপরে গাঢ় নীল আকাশ। কোথাও কালো মেঘের ছিটেফোঁটাও নেই। শীতল স্নিগ্ধ জলের ঝাপটা এসে পড়ছে দেহে। ভারী স্নিগ্ধ আনন্দের সুখানুভূতি।

লেখক
লেখক

দুপুরটা গড়িয়ে পড়ছে একটু একটু করে। আশপাশে খুঁজে দেখি নাইজেরিয়ার বন্ধু ইসমাইলকে। তাঁকে খুঁজে পাচ্ছি না। মিশুকও অনেকটা অসুস্থ হয়ে বসে আছে অদূরে, পাথরের ওপর। একটা সময় শাহরিয়ার জানান দিল, ভাই আমাদের উঠতে হবে। বেলা ঘনিয়ে আসছে। ঘোর কাটতেই টের পেলাম দুপুরটা গড়িয়ে পড়ছে বিকেলের কোলে। স্মৃতির পাতায় ধরে রাখার জন্য কয়েকটা ছবি তুলে নিই তড়িঘড়ি করে। একটা সময় জলের গড়িয়ে চলার পথ দেখতে দেখতে ফিরতে থাকি। মাঝপথে ঝোপের আড়ালে দেখতে পেলাম বন্ধু ইসমাইলকে। নিবিড় ধ্যানে কলকল রবে জলের ছুটে চলার আঁকাবাঁকা পথে আত্মমগ্ন সে। নিয়মের বেড়াজালে প্রকৃতির এই রূপ সমুদ্রের মায়া ত্যাগে ফিরতে থাকি, পুরোনো সেই পথ ধরে।

ফিরতে ফিরতে একটি আকুতি জেগে ওঠে মনে। পড়ন্ত বিকেলের এ সময়টাতে টংয়ে বসে যদি খাওয়া যেত এক কাপ চা! দীর্ঘশ্বাসটা বের হয়েই গেল। শাহরিয়ার বলল, ভাই, চলেন। বললাম, কোথায়? ও বলল, বিসমিল্লাহ রেস্টুরেন্টে। ওখানে ভালো চা পাওয়া যায়। মনে মনে ভাবলাম, আবার রেস্টুরেন্ট। রেস্টুরেন্টে তো আর টংয়ের চা পাওয়া যায় না। ভেতরে গিয়ে দেখি নামে রেস্টুরেন্ট হলেও আদতে কিন্তু ফেলে আসা চাচার টংয়ের মতোই। চা, শিঙাড়া, সমুচাও আছে। গরম-গরম। আবার বাইরেও কয়েকটা চেয়ার–টেবিল ফেলানো আছে। চারপাশে কিছু সিগারেট ও কাগজের টুকরো পড়ে আছে। সব মিলিয়ে একটা দেশীয় রাস্তার পাশে কোনো দোকানের আবহ। টংয়ের আমেজে বাইরে বসেই খেলাম চা, শিঙাড়া ও সমুচা।

বিকেরি ক্রিকে যাওয়ার পথে লেখক (বাঁ থেকে দ্বিতীয়)
বিকেরি ক্রিকে যাওয়ার পথে লেখক (বাঁ থেকে দ্বিতীয়)

বিসমিল্লাহ রেস্টুরেন্ট থেকে ফিরছি নীড়ের টানে অবার্নে। এমন সময় মিশুক গোঁ ধরল আটলান্টার ডাউন টাউন হয়ে যাবে। তখন সাঁঝের টানে চারপাশ খানিকটা আঁধার করে আসছিল। শেষ অবধি সংক্ষিপ্ত রাস্তাকে সাঙ্গ করে ছুটে চললাম ডাউন টাউনের ওপর দিয়ে। আকাশ ছোঁয়া ইমারত দেখতে দেখতে একটা সময় আটলান্টাকে পেছনে ফেলে চলতে থাকি ৮৫ ইন্টার স্ট্রিট ধরে। গ্রান্টভিল, হোগেন্সভিল ও ওপেলিকাকে পেছনে রেখে চলে আসি নিজের ছোট্ট শহর অবার্নে।

তখন মাঝরাত। বাইরে হিম শীতল বাতাস হু হু করে বইছে। দূর আকাশে ভাঙা চাঁদের হাসির লুকোচুরি। থোকা থোকা কাল মেঘের ছোটাছুটি। শীতল স্নিগ্ধ পরিবেশে কিছুক্ষণ পায়চারি। তারপর হেলেদুলে নীড়ে ফিরি। পাতলা ঘুমের ঘোরে সুখানুভূতি চাদরে নিবিড় ঘুমের খোঁজাখুঁজি।
...

মনির হোসেন: পিএইচডি অধ্যয়নরত, অবার্ন বিশ্ববিদ্যালয়, আলাবামা, যুক্তরাষ্ট্র।