বাস্তব জীবনের পথের পাঁচালী
নদীভাঙনের পর হাসান, হোসেনের বাবা চরভবানীপুর থেকে কুষ্টিয়ার শহরতলি বাড়াদিতে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করল। ব্যাপারটা যত সহজে লিখে ফেলা গেল, সেটা মোটেও ততটা সহজ ছিল না।
নদীভাঙনের শুরুতেই হাসানের দাদি পরিজান বিবি তাঁর ছোট দেবরের সঙ্গে সলাপরামর্শ করে কুষ্টিয়ায় জায়গা কেনার জন্য মনস্থির করেন। উনিও কুষ্টিয়া শহরে বসবাস করেন। এরপর পালের গরু বিক্রি করে টাকা জোগাড় করা হলো। অবশিষ্ট টাকার জোগান এল হাসানের মায়ের গয়না বিক্রি থেকে।
একদিন সুবহে সাদিকের সময় একটা বড় নৌকা ভাড়া করে চর ভবানীপুর থেকে বাড়াদির উদ্দেশে রওনা দিল। প্রমত্ত পদ্মার তালবাড়ি নামক জায়গা থেকে গড়াই নামের একটা শাখানদ বের হয়ে কুষ্টিয়া শহরের কোল ঘেঁষে বয়ে গেছে। গড়াই নদে গিয়ে রেনউইক ঘাটে নৌকা ভিড়েছিল। তারপর সেখানে থেকে মানুষে টানা বড় ভ্যানে করে ঘর নিয়ে এসে বাড়াদিতে তোলা হয়েছিল।
বাড়াদিতে আসার পর হাসান, হোসেন দুই ভাইয়ের মনের বিস্ময় আর কাটে না। হাসানের চেয়ে হোসেন দুই বছরের ছোট কিন্তু উচ্চতা প্রায় সমান দুজনের। চরভবানীপুরে বিদ্যুৎ ছিল না, তাই টেলিভিশন বা ভিসিআর নিয়মিতভাবে দেখার সুযোগ ছিল না। বছরে এক–দুবার শহর থেকে ডায়নামো ভাড়া করে ভিসিআর নিয়ে আসা হতো। আর টিভি তারা একবারই দেখেছিল। একবার চরভবানীপুরে একটা লটারির আয়োজন করা হয়েছিল। তাদের স্কুলের মাঠে সেই লটারির ড্র অনুষ্ঠিত হয়েছিল সবার সামনেই। সেই লটারিতে প্রথম পুরস্কার হিসেবে ন্যাশনাল ব্র্যান্ডের সাদাকালো টিভি দেওয়া হয়েছিল। সেই টিভি যিনি পেয়েছিলেন, তিনি শহর থেকে ব্যাটারি ভাড়া করে নিয়ে এসে উঠোনে টিভি চালিয়ে দিলে আশপাশের সব গ্রামের মানুষ এসে ওনার উঠানে ভিড় করে টিভি দেখত। সেই টিভিতেই হাসান একটা অনুষ্ঠান দেখেছিল অবাক বিস্ময়ে। ইংরেজি সেই অনুষ্ঠানের মাথামুণ্ডু যদিও সে কিছুই বুঝে উঠতে পারেনি। বাড়াদিতে এসে তারা জানল সেই ইংরেজি শোর নাম ‘ম্যাকগাইভার’।
এরপর হাসান, হোসেনের জীবন চলতে শুরু করল ‘পথের পাঁচালী’র অপু আর দুর্গার জীবনের নিয়মে। অবশ্য তখনো তারা জানে না যে একজন দুনিয়াবিখ্যাত বাঙালি অন্য একজন বিখ্যাত বাঙালির একটা বইয়ের ওপর একই নামে একটা চলচ্চিত্র নির্মাণ করে গেছেন। নতুন জায়গায় এমনিতেই তাদের ঘুম আসে না। তার ওপর নতুন জায়গায় বিভিন্ন ধরনের শব্দও শোনা যায়। রাতের বেলায় একটা নির্দিষ্ট সময় পরপর একটা চলমান শব্দ একদিক থেকে অন্যদিকে চলে যায়। কখনো পশ্চিম থেকে পুবে, আবার কখনো পুব থেকে পশ্চিমে চলে যায় সেই শব্দ। একটানা ঘটঘট শব্দ করে সেটা যেতে থাকে। অন্যান্য শব্দের সঙ্গে এটার সবচেয়ে বড় অমিল হলো অন্যান্য শব্দ যেখানে একটা বিন্দু থেকে উৎসারিত হয়, এই শব্দটা অনেকখানি জায়গা জুড়ে তৈরি হয়। হাসান, হোসেনের মাথায় কোনোভাবেই আসে না এই শব্দের উৎসটা আসলে কী বস্তু। একদিন মাকে জিজ্ঞেস করার পর বলেছিল রেলগাড়ি। এরপর হাসান আর হোসেন একদিন বেরিয়ে পড়ল রেলগাড়ির খোঁজে।
বাসা থেকে বের হয়ে বেশ কিছুদূর হেঁটে যাওয়ার পর রেললাইন। দুভাই বাসা থেকে বের হয়ে রাস্তা ধরে হাঁটা শুরু করল। শুরুতেই বাগাড়েদের বড় মাঠটা পেরিয়ে হুদাদের বিশাল বাগান। বাগাড়ে একটা বংশের নাম। বড় একটা বাঘা আইড় মাছ দিয়ে তাদের পূর্বপুরুষ খানা দিয়েছিল। সেখান থেকেই এই অদ্ভুত নামকরণ। হুদাদের বাগানে বনজ বৃক্ষের পাশাপাশি নানান রকমের ফলদ বৃক্ষের ছড়াছড়ি। আম, সফেদা, চালতা, কতবেল, বেল, নারকেল প্রায় সব ফলের গাছই সেখানে আছে। গ্রামের দুরন্ত ছেলেদের জন্য এই ফলের গাছগুলো আশীর্বাদস্বরূপ। তারা বিভিন্ন উপলক্ষে এসব গাছ থেকে ফল চুরি করে। হাসান, হোসেনও বেশ কয়েকবার পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে এসে ফল চুরি করে নিয়ে গেছে। অবশ্য বাসায় ফিরে সে জন্য মায়ের কাছ থেকে বকুনিও হজম করতে হয়েছে।
হুদার বাগানের কোল ঘেঁষে বয়ে চলেছে একটা খাল, যেটাকে স্থানীয়রা বলে গড়াই নদ। কুষ্টিয়া চিনিকলের বর্জ্য নিষ্কাশনের জন্য গড়াই নদ পর্যন্ত খনন করা হয়েছিল এই খাল। বর্ষার মৌসুমে গড়াই নদ থেকে পানি এসে ঢুকে পড়ে। পানির সঙ্গে আসে পলিমাটি এবং অনেক রকমের মাছ। তখন গড়াই নদের দুপাশে মানুষ বসে যায় বড়শি নিয়ে। আর অন্যান্য সময় মোটামুটি শুকনায় থাকে। আর যখন চিনিকল চালু থাকে, তখন গন্ধে এই খালের কাছে ঘেঁষা মুশকিল হয়ে দাঁড়ায়। কারণ, চিনিকলের বর্জ্য বয়ে যায়। বাড়াদি থেকে জগতি এবং চৌড়হাস যেতে এই খাল পার হয়ে যেতে হয়। তখন পর্যন্ত জগতির রাস্তায় বাঁশের সাঁকোয় ছিল পারাপারের একমাত্র উপায়। অবশ্য হুদার বাগানের পাশের এই জায়গাটাতে সেতু আছে। কারণ, এদিক দিয়ে মানুষজন শহরে চলাচল করে এবং গাড়িঘোড়া আসা–যাওয়া করে।
হাসান আর হোসেন দুভাই সেতু পার হচ্ছে, এমন সময়ে আবারও রাতের শোনা সেই চলমান শব্দটা তাদের কানে এল। শব্দটা অনেক কাছে হলেও সেটা তারা দেখতে পাচ্ছিল কারণ, সামনেই সারি সারি বাড়িঘর। তারা দ্রুত পা বাড়াল। বাড়াদি রেলগেটের কাছে এসে তারা থামল। দেখল রাস্তাটাকে মাঝ বরাবর কেটে দুটো লোহার পাত উত্তর থেকে দক্ষিণে চলে গেছে। আর সেই পাতের শুরুতেই অনেক বড় এবং ভারী লোহার তৈরি একটা গেট আছে। লোহার পাত দুটোর উল্টো পাশেও একটা গেট আছে। আর তার কোনায় ইটের তৈরি ছোট একটা কুঁড়েঘরের মতো যদিও উচ্চতা অনেক বেশি কিন্তু আকৃতি খুবই ছোট। তারা বুঝল রেলগাড়িটা এই দুটো পাতের ওপর দিয়ে যাওয়া–আসা করে কিন্তু বুঝতে পারল না ঠিক কীভাবে রেলগাড়িটা যায়।
হাসান আর হোসেন রেলের পাত দুটোর পাশের জায়গা দিয়ে দক্ষিণ দিকে হাঁটতে শুরু করল। রেললাইনের ধার দিয়েই লোহার খুঁটিতে করে বিদ্যুতের তারের মতো অনেকগুলো তার চলে গেছে অবশ্য বেশ নিচু দিয়ে। তারা ঠিক বুঝে উঠতে পারে না এই তারগুলো কেন এত নিচে দিয়ে গেছে। এগুলো কি তাহলে বিদ্যুতের মতো শক দেয় না? কিছুদূর যাওয়ার পরই তারা একটা উঁচু লোহার খুঁটি দেখতে পেল। সেই লোহার খুঁটির মাথায় একটা পাখা টানানো। ওদের প্রতিবেশী আজাদ বলেছিল এই পাখা যখন নিচের দিকে ঝুলে থাকে, তখন রেলগাড়ি যায় না কিন্তু যখন রেলগাড়ি আসার সময় হয়, তখন এটা ওপরের দিকে উঠে ভূমির বরাবর দাঁড়ায় অনেকটা ট্রাফিক পুলিশের হাত তুলে দাঁড়ানোর মতো। তারা অপেক্ষা করতে থাকল কখন এই পাখাটা ওপরে উঠবে।
অপেক্ষার প্রহর আর ওদের শেষ হতে চাইছে না। অনেক অপেক্ষার পর একসময় পাখাটা ওপরে উঠল আর ওরা কানে আবারও দূর থেকে আসা সেই চলমান শব্দটা শুনে মনের মধ্যে একধরনের উত্তেজনা বোধ করতে শুরু করল। পাশের রাস্তা দিয়ে কে যেন যাচ্ছিল। তিনি ওদের ডেকে সাবধান করে দিলেন যেন ওরা রেললাইনের পাশে থেকে সরে আসে। দুজন রেললাইনের পাশ থেকে সরে এসে রাস্তায় দাঁড়াল। এই রাস্তাটা রেললাইনের পাশাপাশি দক্ষিণ দিকে চলে গেছে। একটু পরই ঝমঝম শব্দ তুলে রেলগাড়িটা চোখের নিমেষে ওদের সামনে দিয়ে চলে গেল। ওরা যেন নিজেদের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না যে তারা নিজেদের চোখে রেলগাড়ি দেখেছে। ওরা সবচেয়ে অবাক হলো রেলগাড়ির চাকা দেখে। রেলগাড়ির চাকার এক পাশে কোনো খাঁজ নেই। তাই ওরা ভাবছিল এটা পড়ে না গিয়ে কীভাবে এত দ্রুত চলে গেল। পরবর্তীকালে তাদের এই ভাবনাটা বহুদিন ভাবিয়েছে কিন্তু তারা এর কূলকিনারা করতে পারেনি।
এরপর একদিন সালামদের বাসায় ওরা একটা সিনেমা দেখল, নাম ‘পথের পাঁচালী’। দেখে ওরা খুবই অবাক হলো। এ তো হুবহু ওদের দুই ভাইয়ের গল্প কিন্তু তফাত হচ্ছে ছবিতে এক ভাই আর এক বোন। তা ছাড়া বাকিটা হুবহু মিলে যায়। ওরা তখনো জানত না যে এই ছবির গল্পের লেখক কে আর এই ছবির পরিচালকই বা কে? এরপর সময়ের পরিক্রমায় ওরা দুই ভাই বড় হয়ে যায়। জানতে পারে গল্পের লেখক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় আর পরিচালকের নাম সত্যজিৎ রায়। ওরা যেহেতু ছবিটা দেখেছিল, তাই পরিচালকের প্রতিই বেশি আকর্ষণ বোধ করল। এরপর পুরোনো ‘শারদীয়া আনন্দলোক’ পড়তে গিয়ে ওরা অবাক হয়ে আবিষ্কার করল পরিচালক নিজেই আবার লেখকও। আনন্দলোকের শারদীয়া সংখ্যার প্রতিটিতে তাঁর সৃষ্ট চরিত্রের অন্ততপক্ষে একটা করে কমিকস থাকে। বেশির ভাগই ফেলুদাকে নিয়ে কমিকস, যিনি সব রহস্যময় সব সমস্যার সন্ধান করেন। মাঝেমধ্যে প্রফেসর শংকুরও কমিকস থাকে।
এরপর হাসানের বন্ধু শাহেদদের বাসায় একটা বই পেল, নাম ‘এবারো বারো’। গল্পের বইয়ের এমন অদ্ভুত নাম দেখে হাসান খুবই অবাক হলো। পরে ভেতরে গুনে দেখে সেখানে বারোটি গল্পই আছে, তাই এমন নামকরণ। ছোটগল্পও যে এমন টানটান উত্তেজনায় ভরা থাকতে পারে, এই গল্পগুলো পড়ার আগে হাসানের জানা ছিল না। এরপর কুষ্টিয়ার সবচেয়ে বড় বইয়ের দোকান বইমেলায় গিয়ে হাসান সত্যজিৎ রায়ের সব বই একে একে কিনে ফেলল। মজার ব্যাপার হচ্ছে ওনার বেশির ভাগ বইয়েরই প্রচ্ছদ এবং অলংকরণ আবার ওনার নিজের হাতে করা। ওনার লেখা যতই পড়ে, ততই মুগ্ধ হয়। হাসান মনে মনে ভেবে অবাক হয় একই মানুষের মধ্যে এত গুণ কীভাবে থাকতে পারে। তখন জানতে পারল উনি বিখ্যাত লেখক উপেন্দ্রকিশোরের নাতি এবং আরেক বিখ্যাত লেখক সুকুমার রায়ের ছেলে।
এরপর হাসান মুখিয়ে থাকল ওনাদের লেখা পড়ার জন্য। উপেন্দ্রকিশোর পড়তে গিয়ে হাসান খুবই অবাক হলো। ছোটবেলায় নানি–দাদিদের মুখে এই গল্পগুলোয় তো শুনেছে সে। আর সুকুমার রায়ের ছড়া সে যতবার পড়ত, ততবার তার মনে খটকা লাগত। একজন মানুষের কল্পনা কতটা মজার হতে পারে। এরপর সে ওনাদের সব বই কিনে নিজের ছোট একটা আলমারি ভরে ফেলল এই ভেবে যে নিজের মেয়ে যখন বড় হবে, তখন যেন ওনাদের গল্প এবং ছড়াগুলো পড়ে শোনাতে পারে। জীবনের বহমানতায় হাসান একসময় অস্ট্রেলিয়ার সিডনি চলে এল। আসার সময় মালামাল অনেক হিসাব করে নিয়ে আসছিল কিন্তু তবু স্যুটকেসের এক ফাঁকে উপেন্দ্রকিশোরের ‘চিরকালের সেরা’ আর সুকুমার রায়ের ‘সমগ্র শিশুসাহিত্য’ নিয়ে নিল। এরপর একেবারে রুটিন করে প্রতিদিন ঘুমাতে যাওয়ার আগে হাসান তার মেয়ে তাহিয়াকে ওই দুটো বইয়ের যেকোনো একটা থেকে পড়ে শোনায়। এভাবে গল্প শুনতে শুনতে মেয়েটা একসময় ঘুমিয়ে পড়ে। পরের দিন ঘুমাতে যাওয়ার আগে আবারও তাকে সেই জায়গা থেকে পড়ে শোনাতে হয়।
এরপর ২ মে সত্যজিৎ রায়ের জন্মদিনে হাসান ভাবল পরিবারের সবাই মিলে ‘পথের পাঁচালী’ সিনেমাটা আবারও দেখবে। সব কাজ সেরে রাতে সবাই মিলে দেখতে বসল। একেকটা দৃশ্য দেখায় আর হাসান তার মেয়ে তাহিয়াকে বুঝিয়ে দেয়। যখন বৃষ্টি শুরু হলো, তখন তাহিয়া নিজে থেকেই বলল, ‘বাবা, আমরাও তো এইভাবেই বৃষ্টিতে ভিজি।’ হাসান বলল, হ্যাঁ, বাংলাদেশে আসলে এইভাবেই বৃষ্টি উদ্যাপন করা হয়। এ ছাড়া যখন দুর্গা পেয়ারা চুরি করে নিয়ে এল, তখন তাহিয়া বলল, ‘আমি এইবার বুঝেছি তুমি কেন মাঝেমধ্যে আম আর লেবু চুরি করে নিয়ে আসো। এখানে কি চুরি করে নিয়ে আসছ, সেটা ব্যাপার না, চুরি করাটাতেই তোমার আনন্দ।’ এই কথা শুনে হাসানের গিন্নি হাসানের দিকে কটমট করে তাকাল। এরপর যখন অপু আর দুর্গা মিলে রেলগাড়ি দেখতে গেল, তখন হাসান বলল আমরাও দুভাই এভাবেই রেলগাড়ি দেখতে গিয়েছিলাম ছোটবেলায়। ‘পথের পাঁচালী’র গল্প এগিয়ে যেতে থাকে তার পরিচালকের নির্দেশনায়। ছবির শেষে অপু পরিবার শহরের পথে পা বাড়ায়। হাসান আর হোসেনের জীবনের গল্পও একই রকমভাবে সেই কুষ্টিয়ার চরভবানীপুর থেকে শুরু হয়ে শহরতলি বাড়াদি হয়ে সাত সমুদ্র তেরো নদীর পারের এই সিডনি এসে থেমেছে। কে জানে সামনে হয়তোবা আরও কোনো চমক অপেক্ষা করছে।