বাবারা বুঝি এমনি হন

লেখক
লেখক

হাওয়ায় ভাসছি। এয়ার এরাবিয়া বিমানের আসনের সামনে ডেটা ডিসপ্লে মনিটর বলছে বিমান ভারতের নাগপুরের আকাশসীমা অতিক্রম করে মুম্বাইয়ের সীমানা ছুঁই ছুঁই করছে। কিন্তু আমার মন পড়ে আছে বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন একটা দ্বীপ সন্দ্বীপে। আরও একটু খুলে বললে, সেই দ্বীপের এক পুরোনো টিনের ঘরে। যেখানে মাত্র এক শ দিন পেরোনো এক নবজাতক নিজের ভাষায় হয়তো কথা বলে যাচ্ছে।

আমি আমার বাচ্চার কথা বলছি। দিন দু-এক হলো মুখ দিয়ে সে সুন্দর বু-বু বলা শুরু করেছে। আমাদের গ্রামের ভাষায় বলে, এটাই নাকি বাচ্চাদের প্রথম বোল! এরা নাকি এভাবেই তাদের দাদিকে ডাকে। বলতে বলতে একসময় মুখ দিয়ে লালা গড়িয়ে পড়ে। আমি অতি যত্নে তা মুছে দিয়েছি গত কয়েক দিন।

এই তো ঘণ্টা তিনেক আগেও যখন শাহ আমানত বিমানবন্দরে ওয়েটিং রুমে বসে তাকে দেখছিলাম মুঠোফোনের ভিডিও কলে, তখনো তার মুখে সেই শব্দ, বু-বু...। গড়িয়ে পড়ছে সেই লালা, আমার খুব ইচ্ছে করছিল অতি যত্নে সেই লালা মুছে দিতে।

কিন্তু চাইলে কী আর তা পারা যায়! বাচ্চাটা আমার নাগালের অনেক দূরে তখন। হতে যাচ্ছে আরও দূরের। যেখান থেকে শুধু দেখা যাবে বড়জোর, শোনাও যাবে তার মধুর শব্দ। শুধু যাবে না ছোঁয়া। নেওয়া যাবে না বুকের মাঝখানে।

অনেক প্রবাসীর তুলনায় নিজেকে সৌভাগ্যবান ভাবি মাঝে মাঝে। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই অন্তত মাসখানিকের জন্য হলেও আসতে পারি দেশে। এবার তো শুধু বাচ্চাটাকে দেখতে আরও আগে এলাম। আসলে এসেই বুঝলাম, বাবা বনে যাওয়ার পর পৃথিবীর ধরনও অন্য রূপ। অদ্ভুত একটা রূপ। যে রূপটা শুধু বাবা বনলেই বোধ হয় উপলব্ধি করা যায়।
আমার নিজের বাবাকে দেখলেও হয়তো তার অনুভূতিগুলো কেমন ছিল, তা এত দিন বুঝতাম না। এখন বুঝি, খুব বুঝি!

আব্বা এখন আর কুলিয়ে উঠতে পারছেন না। তবুও এলেন গুপ্তছড়া ঘাট পর্যন্ত। বড় ভাই এলেন স্পিডবোটের কাছ পর্যন্ত। স্পিডবোট চলতে শুরু করে। আস্তে আস্তে বাড়তে শুরু করে গতি। হাত তুলে আব্বাকে বিদায় বলি। জবাবে আব্বাও হাত তোলেন। আস্তে আস্তে চোখের দৃষ্টিতে মিলিয়ে যায়। কেউ কাউকে দেখি না আর।

চলে আসি কুমিরা ঘাটে। আমাদের নামিয়ে বেশি দেরি করে না। ফিরে যায় সন্দ্বীপের দিকে আবার। আমি করুণ দৃষ্টিতে তার চলে যাওয়া দেখি আর ভাবি আবার কবে যাব!
ছোট ভাই ছিল শাহ আমানত বিমানবন্দর পর্যন্ত।

তারপর। তারপর আবার একা, আবার প্রবাসে দিন গোনার পালা। দিন পঞ্জিকার একেকটা দিন কবে সপ্তাহকে ছুঁয়ে দেবে। সপ্তাহ কবে মাসকে ছুঁয়ে যাবে। মাস কবে বছরকে! এভাবেই প্রতীক্ষারা হেঁটে যাবে স্বপ্নের দিকে। সেই স্বপ্ন, যে স্বপ্ন আমার বাড়ি যাবে আবার। আমি আমার বাবাকে দেখব। আমার ছেলে তার বাবাকে দেখবে।

জাহেদুল আলম: জুলেখা হাসপাতাল, দুবাই, সংযুক্ত আরব আমিরাত। ইমেইল: <[email protected]>