বাবার মায়া আর ভালোবাসার ছায়া

লেখিকার বাবা
লেখিকার বাবা

তখন অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে পড়ি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলে থাকি। বড় আপা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন। আমার আরও দুই ভাই ঢাকায়। আর ভাইবোন ছোট। ওরা বাড়িতে স্কুল–কলেজে পড়ে। আব্বা তখন পটিয়া পিটিআইতে। প্রতি মাসে আব্বা পটিয়া থেকে ঢাকায় নেমে আমাদের সঙ্গে দেখা করে, আমাদের মাসের খরচ দিয়ে গাবতলী গিয়ে বাসে ঊঠে মাগুরায় যেতেন।
কোন মাস তা মনে নেই। আব্বার আসার খবর নেই।
আমি বাড়িতে ফোন দিলাম। মানে আমার চাচাতো ভাইয়ের বাসায়। তখন আমাদের বাসায় ফোন ছিল না। আম্মা বললেন, তোমার আব্বার পা ভেঙে গেছে। তাই আসতে পারছেন না এই মাসে। পা ভালো হলে বাড়িতে আসবেন। টাকা আমি মাগুরা থেকে কাউকে দিয়ে পাঠিয়ে দেব। তোমরা চিন্তা করো না।
আম্মার সঙ্গে কথা বলে খুব খুব খারাপ লাগছিল আমার আব্বার জন্য। আব্বা পা ভেঙে বসে আছেন। ওখানে আব্বার পরিবার পরিজন কেউ নেই। কত কষ্ট করছেন একা একা। মনে করতেই আমার চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগল।
আমি আমার ভাইকে খবর দিলাম। বললাম আগামীকাল পটিয়া যাব, তুই আমার সঙ্গে যাবি, আব্বার কত কষ্ট হচ্ছে।
যে কথা সেই কাজ। দুই ভাইবোন চট্টগ্রামের বাস ধরলাম। সেই প্রথম আমার চট্টগ্রাম যাওয়া। চট্টগ্রামে বাস থেকে নেমে বহদ্দারহাট গেলাম। ওখান থেকে টেম্পোতে চড়ে পটিয়া স্টেশনে। আমরা স্টেশনে নামার পর একজনকে জিজ্ঞাসা করলাম, ভাই পটিয়া পিটিআই যাব, কত দুর বলতে পারেন। ভদ্রলোক আমাদের হাত দিয়ে দেখিয়ে দিলেন, একদম কাছে, রাস্তার ওপারে। আমরা রাস্তা পার হয়ে পিটিআই–এর ভেতরে প্রবেশ করলাম। গেটের ভেতরে ঢুকেই ডানে অফিস। যেখানে আমার আব্বা বসেন। অনেক বড় রুম। ওই রুমেই একপাশে একটা চৌকি দেওয়া হয়েছে। আমার আব্বা ওখানে বসেই অফিস করেন। রাতে ওখানেই ঘুমান। আমরা আমাদের পরিচয় দিলে পিয়ন আমাদের অফিসের ভেতর নিয়ে গেলেন। ওই রুমে তখন দুই–তিনজন ছিলেন।

বাবা–মার সঙ্গে লেখিকা ও তার বোনেরা
বাবা–মার সঙ্গে লেখিকা ও তার বোনেরা

আমার যে কী হলো। আমি আব্বার পায়ের কাছে গিয়ে বসলাম। আব্বার পা ধরলাম যেখানে ব্যান্ডেজ বাঁধা। চোখে কোথা থেকে যেন পানির ধারা বইতে লাগল অঝোরে। আমি রীতিমতো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছি। আমার ভাইটা চুপ করে বসে আছে। আব্বা আমার মাথায় হাত দিয়ে আমাকে শুধু বলছেন, মা আমার কিছু হয়নি, কয়েক দিন পরেই ঠিক হয়ে যাব।
এত পানি কোথায় ছিল কে জানে। আপনজনের কিছু হলে যে বুকের ভেতর কেমন লাগে, চোখের পানি যে আটকে রাখা যায় না, জীবনে সেই প্রথম অনুধাবন করেছিলাম।
তিন দিন আব্বার সঙ্গে থেকে আমরা ঢাকায় ফিরে এসেছিলাম।
আজ কেন জানি আব্বার কথা খুব মনে পড়ছে। যে মানুষটা বটগাছের মতো ছায়া হয়ে আমাদের মাথার ওপরে ছিলেন, সেই মানুষটা হঠাৎ করেই আমাদের না বলে অজানার দেশে পাড়ি জমালেন। আব্বা হয়তো ভেবেছিলেন একটু অসুস্থ হলেই সবগুলো ছুটে আসবে তাই অসুস্থ না হয়ে সবাইকে না জানিয়ে নীরবে চলে যাই। মাঝে মাঝে মনে মনে আব্বার সঙ্গে কথা বলি। আব্বা তুমি সেই পা ভাঙার মতো কেন অসুস্থ হলে না, তাহলে আমি শোনা মাত্রই পৃথিবীর যে প্রান্তে থাকতাম চলে আসতাম। কিন্তু তুমি তো সে সুযোগ দিলে না। কেন দিলে না আব্বা, না হয় আর একবার তোমার কাছে বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতাম। আর তুমি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে, বলতে, মা আমার কিছু হয়নি।