বাবার ডে কেয়ারে

লেখকের দুই ছেলে
লেখকের দুই ছেলে

শুক্রবার বিকেলের দিকে যখন বাড়ি ফিরি তখন শরীর খুব ক্লান্ত লাগলেও দুদিনের সাপ্তাহিক ছুটির কথা মনে করে মেজাজ কিছুটা ফুরফুরে লাগছিল। ফেরার পথে জরুরি দু-একটি কাজ শেষ করে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বিকেল ৫টা বেজে যায়। বছরের এই সময়টা অর্থাৎ ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে বিকেল ৫টা মানে প্রকৃতি তার নিকষ কালো আঁধারের চাদরে পূর্ণ রাতের ঘোষণা করে ফেলে। অথচ তিন মাস আগেও রাত দশটার সময়েও সূয্যি মামা পাটে যাওয়ার আলসেমিতে ঝুলে থাকে তো থাকেই। সামারে তাই বাচ্চাদের ছকবাধা নিয়ম অনুযায়ী রাত ৯টায় ঘুমাতে যাওয়ার অলিখিত আইনে বিছানায় পাঠাতে ভীষণ কসরত করতে হয়। বাইরে ভর দুপুরের আলোর তীব্রতায় রাতের ঘুম আসে কি করে? আর এই শীতের সময়টায় তেমন বেশি বলতে হয় না। কোনো কোনো দিন নিজেরাই রাত ৮টা থেকেই ঘড়ি দেখা শুরু করে দেয়। রাত লম্বা হওয়ার আপাতত এই সুবিধাটি দেখতে পাচ্ছি ও উপভোগ করছি।
যা হোক ফুরফুরে মেজাজে ঘরের কলিং বেল টিপতেই ছোট ছেলে দুটি দৌড়ে এসে আসসালামুয়ালাইকুম বাবা বলেই জড়িয়ে ধরে। আমিও দুটিকে জড়িয়ে ধরে বড় একটা হাঁক দিয়ে দুই কোলে তুলে নিয়ে সোজা সোফায় এনে ফেলে দিয়ে কতক্ষণ ঝাঁপটাঝাঁপটি করে নেই। দুটোকেই এক সাথে সোফায় শুইয়ে ঝাপটে ধরে আদরের নামে অবিরত চুমা আর সঙ্গে সুড়সুড়ি। এদের খিলখিল স্বর্গীয় অট্টহাসিতে ঘরে যেন সুখের কালবৈশাখী বয়ে যেতে থাকে। ঠিক সে সময় এদের মা কিচেনে রান্নায় ব্যস্ত। তখন জেলাসিতেই কি না, একটা ভাব ধরে আমাদের পিতা-পুত্রের এই খুশির জোয়ারে বাঁধা দিতে চেষ্টা করে। কিন্তু ওই অবস্থায় আমরা বাপ-বেটার যেন থোড়াই কেয়ার করার সময় থাকে। ১০-১৫ মিনিট এই জোয়ারে ভেসে আমি ওপরে যাই চেঞ্জ করে ফ্রেশ হওয়ার জন্য। নিচে এসে দেখি চা বিস্কুট টেবিলে দেওয়া হয়েছে।

শুক্রবার বিকেল বলেই হয়তো। এমনিতে উইকডেতে রাত ৮টায় ডিনার করা হয়ে যায়। তাই উইকডেতে বৈকালিক জলযোগ করি না। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠতে হয় বলে চা খেয়ে রাতের ঘুম হারামে সাহস পাই না। শুক্রবার রাতে সে ভয় নেই বলেই মাঝে মাঝে তা করে থাকি। অবশ্য চা বিস্কুট খাওয়ার পরে বুঝতে পারি কেন এই অযাচিত খাতির। একটু পরেই মিহি আর মোলায়েম সুরে বাচ্চাদের মা আমাকে বলল, তাঁর অফিস থেকে জরুরি টেলিফোন এসেছে, শনিবারে কাজে যেতে হবে। এখনো না করে দেবার অপশন হাতে রেখেছে, রাত ৮টার আগে কনফার্ম করে দিতে হবে, যাবে কি যাবে না। আমি জানতে চাই কতক্ষণের জন্য যাবে? আমাকে বলা হলো খুব ভোরে অর্থাৎ ৬টায় গিয়ে দুপুর ১২টার মধ্যেই চলে আসবে। আমি বলি, তুমি না গেলে কি সমস্যা হবে? সে বলে সিরিয়াস সমস্যা হবে না, তবে সদ্যপ্রাপ্ত প্রমোশনে এটা একটা নেগেটিভে ইমপ্যাক্ট পড়তে পারে। ওভারটাইম চার্জ হবে কি না জানতে চাইলে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ায়। উপায় যেহেতু শৃঙ্খলে কিছুটা বাঁধা আর বাড়তি দুটো পয়সাও আসবে, আমি বলি আচ্ছা যাও তা হলে। আমাকে বলা হলো তুমি শুধু বাচ্চাদের সকালের নাশতাটি করাবে, দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা আমি এসেই করব। ঠিক আছে বলে সিদ্ধান্ত হয়ে যায়।
সকালবেলা কিছুটা দেরি করে ঘুম ভাঙে। তাও ছেলে দুটি (৫ ও ৭ বছর বয়স) বরাবরের মতো জোট বেধে এসে ঘুমন্ত আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ায়। দুটোকে দুপাশে কম্বলের ভেতর ঢোকাই। চলে বেশ কিছুক্ষণ চর দখলের খেলা। অর্থাৎ ছোটটা আমার ওপর চড়ে বসে তো বড়টা তাকে ফেলে দিয়ে আমাকে দখল করে বসবে। পরে ছোটটা এসে তা উদ্ধারের পালা। এভাবে কিছুক্ষণ চলার পর আমরা হাত মুখ ধুয়ে নিচে কিচেনে আসি নাশতা করার উদ্দেশ্যে। জিজ্ঞেস করি কি নাশতা করবে বাবা? দুধ, সিরিয়াল, ব্রেড জেলি, ক্রিম চিজ ব্রেড নাকি ডিম রুটি। একবার একজন বলে দুধ সিরিয়াল তো আরেকজন বলে ক্রিমচিজ ব্রেড। আবার আরেকজন বলে ডিম রুটি। তো এটার দেখাদেখি অন্যটিও বলে সেও ডিম রুটি খাবে। শেষে আমরা সবাই ডিম রুটি নাস্তা করি এক সাথে। ডিম ভাঁজতে হবে কুসুম না ভেঙে। কুসুম যদি ভেঙে যায় তা হলে আর সেই ডিম খাবে না। আস্ত কুসুম রেখে ডিম ভাজা যে কী ডিগদারি কাজ আমি কী আগে জানতাম? তাহলে তো এই ডিম নাশতার কথা জীবনেও উচ্চারণ করতাম না। যা হোক ডিম ভাঁজতে গিয়ে দুটির কুসুম গেল ভেঙে আর সে দুটি যে কার ভাগ্যে পড়েছে তা কী আর বলার অপেক্ষা রাখে? রুটিও পোড়ার হাত থেকে রক্ষা পায়নি সবগুলো।

খাবার খাচ্ছে লেখকের দুই ছেলে
খাবার খাচ্ছে লেখকের দুই ছেলে


এদিকে বেলা তো আর বসে নেই। দুপুর গড়িয়ে একসময় বেলা ১টা বেজে গেল। আমার শঙ্কিত মন কীসের যেন অভাব অনুভব করছে। আমি ভাবছি এই এল বলে, তাই ফোন করে আর খবর নিচ্ছি না। তখনই তার ফোন এল। ফোন ধরে যা শুনলাম তার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। তার কাজে নাকি এমন ভাবে ভজগট পেঁচিয়ে গেছে যে সে কখন বাসায় আসতে পারবে কিছুই আন্দাজ করতে পারছে না (তার কাজ হচ্ছে ল্যাবে ওষুধ তৈরির আগে কেমিক্যাল টেস্ট করা, এটা পাস হলে কোম্পানির ওষুধ উৎ​পাদনে যাবে)। তবুও আমি জিজ্ঞেস করি অনুমানে কয়টা বাজতে পারে। ওপাশ থেকে উত্তর আসে রাত ১২টাও বাজতে পারে। আমি শুনে স্তব্ধ হয়ে যাই। তখন বাজে দুপুর ১টা আর সে বলছে তার আসতে রাত ১২টাও বাজতে পারে।
আমি পড়লাম এক মহা ফাপরের মধ্যে। আর এই দীর্ঘ কাজের অবসাদের দুশ্চিন্তার চেয়েও তাৎক্ষণিক ভাবে আমার কাছে যেটি বড় দুশ্চিন্তা হয়ে কপালে ভাঁজের রেখা ফেলে দিচ্ছে তা হলো বাচ্চাগুলোকে আমি কী লাঞ্চ দেব? টেনশনে আমার বাইরে (ঘরের সামনে দম নিতে) যাওয়ার মাত্রা বেড়ে গেল। বেলা ২টার দিকে রাইস কুকারে ভাত চড়িয়ে দিয়ে বুদ্ধি আঁটতে থাকি সবচেয়ে সহজ কী লাঞ্চ তৈরি করা যায়। হঠাৎ বুদ্ধি এল, পেঁয়াজ দিয়ে ডিম ভাজি করে আমি যদি ভাত মেখে দিই তা হলে হয়তো খেয়ে ফেলবে। উত্তেজনার বসে সব রেডি করে ডিম ভাঁজতে গিয়ে দেখি পেঁয়াজের সঙ্গে কাঁচামরিচও মেখে একাকার করে ফেলেছি। কেমন লাগে মেজাজটা তখন? এদিকে সকালে আমি দুটি ডিম অলরেডি সাবাড় করে ফেলেছি। এখন তো স্বাস্থ্যের জন্যও খাব না। আর এমনিতে খেতেও ইচ্ছা করছে না। তখনই আকস্মিক ভাবে বাচ্চাদের মায়ের ফোন এল। জানতে চাইল এদের লাঞ্চ দেওয়া হয়েছে কিনা। আমি সংক্ষিপ্ত ভাবে সব খুলে বলি। তখন সে আমাকে বলে ফ্রিজে বাচ্চাদের জন্য চিকেন রান্না করা আছে। মাইক্রোওভেনে গরম করে নিলেই হবে। আমি যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচি। আচ্ছা বলে ফোন রেখে দিয়ে লাঞ্চ প্রিপেয়ার করি।
এর মধ্যে আমি যতবার বাইরে থেকে ঘরে ঢুকছি ততবারই বাচ্চা দুটি মাম মাম বলে একবুক আশা নিয়ে দৌড়ে দরজায় যাচ্ছে। আমাকে দেখে হতাশামিশ্রিত কণ্ঠে বলছে ওহ বাবা তুমি!

(​লেখকের ইমেইল: [email protected])