বাবা, বড্ড ভালোবাসি তোমাকে
২০০৫ সালের কথা। বাবার তখন সরকারি চাকরির শেষ বছর। শিক্ষকতা পেশায় দীর্ঘ দুই যুগের বেশি সময় কাটিয়ে এলপিআর (অবসর প্রস্তুতিমূলক ছুটি) শুরু হবে এবার। আমরা তিন ভাইবোন সবাই তখন পড়াশোনার মধ্যেই ছিলাম। বাবার চাকরিসূত্রে মফস্বলে থাকতাম আমরা। বাবাকে কখনো চাকচিক্যময় জীবন যাপন করতে দেখিনি। এদিক থেকে মায়েরও অনেকখানি অবদান ছিল। বাবা-মাকে আমরা ভাইবোন শত অনুরোধ করেও নতুন কাপড়চোপড় কেনার জন্য রাজি করাতে পারতাম না। তা সত্ত্বেও আমাদের আবদারগুলো শত কষ্ট হলেও পূরণ করার সাধ্যমতো চেষ্টা করতেন বাবা। তাঁর বাড়ির একমাত্র ছোট ছেলে হওয়ায় বাবার কাছে ঈদের সময় আমার করা আবদার পূরণ করা হতো সবার আগে।
কোরবানি ঈদ শুরুর সপ্তাহখানেক আগে বাবা আমাদের সবাইকে ডেকে বললেন, চাকরিরত অবস্থায় শেষ ঈদ হওয়ায় এবার তিনি আমাদের ভালো কিছু কিনে দিতে চান। আমার প্রয়োজন ছিল এক জোড়া ভালো চামড়ার জুতার। কিছু না ভেবেই বাবার কাছে আবদার করে বসলাম। বাবা মৃদু হাসি দিয়ে বললেন, ‘দেখা যাক।’ ঈদের সময় ঘনিয়ে আসতে লাগল। ধরে নিয়েছিলাম, এবার হয়তো আর সাধের জুতা কেনা হয়ে উঠবে না। ঈদের আগের দিন সন্ধ্যায় ঠিকই বাবা দেশীয় এক নামী ব্র্যান্ডের চামড়ার স্যান্ডেল কিনে আনলেন আমার জন্য। বললেন, হেঁটে দেখ তো বাবা! মাপ ঠিক হয় কি না।’
আমি তো মহা খুশি। আমাকে এতটা খুশি হতে দেখে বাবার চোখের কোনায় জমা থাকা অশ্রুবিন্দু চশমার আড়ালে থাকলেও আমার মনের আড়াল হয়নি। সেদিন বুঝিনি বাবা কেন আবেগাপ্লুত হয়েছিলেন। এর মধ্যে প্রায় ১৫ বছর কেটে গেল। আজ আমি বাইরে বৃত্তি নিয়ে পড়াশোনা করছি। পকেটমানি জমিয়ে মাকে বিভিন্ন সময় কিছু কিনে দিলেও বাবাকে সেভাবে দেওয়া হয়ে ওঠেনি। যাহোক, ঈদের ঠিক দুই দিন আগে দেশে এলাম। মা আর দুই বোনের জন্য এবারও কেনাকাটা করা হলো। এবার আর ভুল করলাম না। বাবার জন্য বিদেশ থেকে চামড়ার এক জোড়া জুতা নিয়ে এলাম। নিজেই তাঁর পায়ে পরিয়ে দিলাম। বাবা জুতা পরে হেঁটে দেখছেন আর বললেন, ‘কেন অযথা বাড়তি খরচ করতে গেলি!’
বাবার চোখে আজও পানি। পার্থক্য এবার—শুধু তিনি একা নয়, তাঁর ছেলেও কাঁদছে আজ। আনন্দের কান্না, তৃপ্তির কান্না। মুখ ফুটে বলতে চাইলাম, কিন্তু কী এক অজানা কারণে পারলাম না এবারও। কখনো তোমায় সামনাসামনি বলা হয়ে ওঠেনি, ‘বাবা, বড্ড ভালোবাসি তোমাকে।’
*লেখক: ইমরান রহমান, পিএইচডি গবেষক, মালয়েশিয়া।