বাবা নেই, তাই যখনই মন চায় ছুটে আসি মায়ের কাছে

আমার মা–বাবা জীবনের শেষ দিকে বেশির ভাগ সময় সুইডেনে একসঙ্গে থাকতেন। হঠাৎ আমার মা স্ট্রোক করেন। পরে মা অচল হয়ে পড়েন। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মাকে রিলিজ করে দেয়। পরে বাসাতেই সব রকম নার্সিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়। বাবা মূলত মায়ের সঙ্গে ২৪ ঘণ্টাই থেকেছেন। আমার মায়ের যত্ন করা, বিভিন্ন বিষয় খেয়াল রাখা, মায়ের কোনো প্রয়োজন হলে সেই প্রয়োজন মিটানো—বাবা এগুলোকেই তখন তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব বানিয়ে নিয়েছিলেন। সারা জীবন শুনেছি স্বামীর প্রতি স্ত্রীর দায়িত্ব ও কর্তব্যের কথা। স্বামীরও যে স্ত্রীর প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য থাকতে পারে বা আছে, সেটা দেখেছি আমার বাবাকে দেখে। আমার অনেক ভাইবোন। বাবা চাকরি করেছেন, মা মূলত আমাদের সংসারের হাল ধরেছেন জীবনের শুরুতেই।

মা–বাবা সমন্বয়ে কাজ করেছেন, বিপদে–আপদে পরস্পর পরস্পরের পাশে থেকে নানা চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করেছেন। তাঁদের জীবন নামক সফর দেখেছি। তাঁরা ছিলেন একে ওপরের সফরসঙ্গী, শিখেছি অনেক সেই দৈনিক শিক্ষা থেকে। ২০০৬ সালে মায়ের মৃত্যুর পর বাবার দুশ্চিন্তা বেড়ে গেল, এখন কী হবে, এ চিন্তায়। কোথায়, কখন, কীভাবে মায়ের মাটি হবে? মাকে বাংলাদেশে মাটি দিতে হবে ইত্যাদি। পরিবারের মধ্যে দুটো গ্রুপ হলো—একটি গ্রুপের আশা মাকে দেশে মাটি দিতে হবে এবং সেভাবে তারা বাবাকে টেলিফোন করে মানসিকভাবে ভেঙে দিতে উঠেপড়ে লেগে গেল। পরিবারের কেউ কেউ বলেছে তখন, অর্থের কারণে আমরা মাকে দেশে পাঠাতে রাজি হচ্ছি না ইত্যাদি। উসকানি দেওয়ার মতো লোকের অভাব নেই, বিপদের সময় এটা নতুন কিছু নয়। যদিও পরিবারের সবারই কমবেশি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও দায়িত্ব নেওয়ার মতো লোকের অভাব সব সময়ই ছিল। যা হোক, শেষে মাকে লিনসোপিংয়ে (সুইডেনের একটি শহর) কবর দেওয়া হলো। মূলত, আমার ছোট ভাই সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করছে, সেটা ছিল প্রধান কারণ। পুরো দাফন থেকে শুরু করে কবর দেওয়া, জানাজা পড়ানো—সব কাজ দেখে বাবা খুবই সন্তুষ্ট হলেন, মনে হলো স্বস্তি ফিরে পেলেন, আলহামদুলিল্লাহ! পরদিন বাবা আমাদের সঙ্গে স্টকহোমে রওনা দিলেন বাংলাদেশের উদ্দেশে, কিছু ধর্মীয় অনুষ্ঠান করবেন দেশে গিয়ে।

লিনসোপিং থেকে বিদায় নেওয়ার আগে মায়ের কবরে বাবাকে নিয়ে আবারও গেলাম। বাবা ধর্মীয়ভাবে মায়ের থেকে বিদায় নিলেন। তবে কে জানত সেদিন বাবা আর ফিরে আসবেন না! এ দেখাই যে শেষ দেখা এবং আর যে দেখা হবে না!

মারিয়া, আমার স্ত্রী, গাড়ি চালাচ্ছে। আমি, বাবা ও আমার ছেলেমেয়ে গাড়িতে। মনটা খারাপ। সবাই বেশ চুপচাপ।
বাবা বেশ স্মৃতিচারণা করতে শুরু করলেন...
তোমার মা চলে গেলেন।

আমরা একসঙ্গে ৬০ বছর ধরে সংসার করছি। একটা ছোট সরকারি চাকরি দিয়ে আমি সংসারজীবন শুরু করেছিলাম।

সারা জীবন চেষ্টা করেছি সৎ থাকার জন্য। আল্লাহর কসম খেয়ে বলতে পারি, জীবনে কোনো দিন এক টাকা অসৎভাবে আয় করিনি। গ্রামের বাড়িতে মা–বাবাকেও কিছু টাকা পাঠাতে হতো। কখনো কখনো মাস শেষ হওয়ার আগে আমার বেতনের টাকা ফুরিয়ে যেত।

সৎ থাকার কারণে আয়ও ছিল খুব সামান্য। আমাদের সাত ছেলে ও চার মেয়ে ছিল। তোমার এক ভাই ও এক বোন মারা যায়।

আমার সহকর্মীদের মধ্যে আমিই সবচেয়ে গরিব ছিলাম। কিন্তু তোমার মায়ের কারণে আমি এটা কখনোই উপলব্ধি করতে পারিনি। উনি যে কীভাবে সবকিছু ম্যানেজ করতেন, একমাত্র উনিই জানেন।

আমার সাধ্যের বাইরে জীবনে কখনো কোনো দিন উনি কিছু দাবি করেননি। জীবনে কখনো আমাকে এটা বলেননি যে তুমি আমাকে এটা দিলে না, ওটা দিলে না। কখনো আমাকে আমার সামর্থ্য নিয়ে কষ্ট দিয়ে উনি কোনো কথা বলেননি। আজীবন ওনাকে শুধু সন্তুষ্টই দেখেছি।

সত্যি কথা বলতে কি, আমি ওনাকে তেমন কিছুই দিতে পারিনি। তারপরও উনি কোনো দিন আমাকে কষ্ট দিয়ে কথা বলেননি।

তোমার মা একজন নেককার মানুষ ছিলেন। উনি উত্তম আচরণের অধিকারী ছিলেন। আত্মীয়তার হক রক্ষা করেছেন। পরোপকারী ছিলেন, স্বামী-সন্তানদের হক আদায় করেছেন। ওনাকে আমি কখনো কোনো নামাজ কাজা করতে দেখিনি, আজীবন পর্দা রক্ষা করে চলেছেন। উনি ধৈর্যশীল ছিলেন এবং অল্পে সন্তুষ্ট থাকতেন।
একনাগাড়ে কথাগুলো বলে বাবা একটু দম নেওয়ার জন্য থামলেন।

এরপর আবার বলতে শুরু করলেন, ’৭১–এর যুদ্ধে তোমার মা যে ত্যাগ স্বীকারও করেছিলেন, তা তোমার থেকে আর কেউ ভালো জানে বলে মনে হয় না। একটা দেশ স্বাধীন করতে, গ্রামের সাধারণ মানুষের পাশা থেকে তাদের অনুপ্রেরণা দেওয়া, নিজের ছেলেদের এবং স্বামীকে যুদ্ধে পাঠিয়ে তোমাদের নিয়ে নিজ দেশে পরাধীন এবং শরণার্থী হয়ে দীর্ঘ নয়টি মাস সংগ্রাম করেছেন। সোনার বাংলা দেখার স্বপ্ন দেখেছেন। তোমাদের সবাইকে সেভাবে গড়ে তুলেছেন।

আমি আসলে তোমার মায়ের হয়ে তোমাকে কিছু বলার জন্য কথা বলছি না। যে নারী ৬০ বছর ধরে তাঁর স্বামী-সন্তান এবং আত্মীয়দের হক রক্ষা করে চলেছেন, তিনি অন্য কারও হক নষ্ট করতে পারেন না।

একজন জান্নাতি নারীর মধ্যে যা যা বৈশিষ্ট্য থাকা প্রয়োজন, তার সবই তোমার মায়ের মাঝে ছিল। ইনশা আল্লাহ, আল্লাহ ওনাকে জান্নাত নসিব করবেন।

আমি নিজে জান্নাতে যেতে পারব কি না জানি না। তোমরা শুধু এই দোয়া কোরো, আমি যেন তোমার মায়ের সঙ্গে জান্নাতে একত্র হতে পারি।

আর তুমি সাক্ষী থাকো আমি তোমার মায়ের ওপর পুরোপুরি সন্তুষ্ট। আল্লাহ যেন ওনাকে মাফ করে দেন।

আমি বাবার কথাগুলো অনুবাদ করছি; একই সঙ্গে এ সময় মারিয়া (আমার স্ত্রী) আমার সঙ্গে বলে উঠল, আমিন, আমিন, আমিন।

বাবাকে নিয়ে স্টকহোমে ফিরে এলাম একটা অপূর্ব ভালো লাগা নিয়ে। সুখী মানুষদের কথা শোনার মধ্যেও একটা সুখ আছে। বাবা আর মা অত্যন্ত সুখী মানুষ ছিলেন। এই সুখ স্রষ্টা সরাসরি তাঁদের অন্তরে ঢেলে দিয়েছিলেন। বাবা দেশে যাওয়ার পর মারা যান, মা আমার এখানে আছেন। যখন মন চায় ছুটে যাই মায়ের কবরে। এসেছিলাম লিনসোরিংয়ে মায়ের কাছে।