বানভাসি মানুষের পাশে

দেশ বন্যায় কবলিত। মানুষের দুর্দশার শেষ নেই। প্রতি মুহূর্তে এই কষ্টটা হৃদয়টাকে একেবারে আঁকড়ে ধরে বসে আছে। সাতসমুদ্র তেরো-নদীর এপারে আমি বসবাস করলেও মন কিন্তু এখানে বসবাস করতে চায়নি; চাচ্ছে না। দিনরাত সে বসত করে সাতসমুদ্রের ওপারে, ওই সবুজের লীলাভূমিতে, জন্মেই সে যা দেখেছে। সেভাবেই সে নিজেকে গড়ে তুলেছে। এখন এত বৈভব, এত ঝিকমিক, এত দালান-কোঠা, কংক্রিট তার একদম পছন্দের নয়। সে চায় খেতের মাঝখানের আল দিয়ে হাঁটতে, মুক্ত সমীরণে শ্বাসপ্রশ্বাস নিতে। কোমল হৃদয়ের মানুষের সঙ্গে কোলাকুলি করতে, অফুরন্ত সময় নিয়ে প্রিয়জনের সঙ্গে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ঘুরে বেড়াতে। তাই সময়ের ছকে বাঁধা জীবন থেকে সে পালিয়ে যেতে চায় তার সেই ফেলে আসা পথের খোঁজে। পাবে কী পাবে না, সে অন্য হিসাব।

এতক্ষণ আমি আমার শরীর, মন ও অবস্থানগত দৃষ্টিভঙ্গির তফাৎ বা দ্বন্দ্ব নিয়েই কথা বলছিলাম। ব্যক্তিকে তার মনের বিরুদ্ধে কত যে সিদ্ধান্ত নিতে হয়, ইচ্ছের বিরুদ্ধে কত জায়গায়ই না অবস্থান করতে হয়, কাজ করতে হয়। আমি জীবন জীবিকার প্রয়োজনে সূর্য উদয়ের এই দেশ জাপানে বসবাস করলেও মন কিন্তু পড়ে থাকে ওই বাংলাকে ঘিরে।
অনলাইনে পত্রিকার পাতায় যখন বন্যার সর্বশেষ পরিস্থিতি দেখি আর ভাবি, তখন নিজের অজান্তেই চোখের সম্মুখে এসে দেখা দেয় ১৯৮৮ সালের স্মরণকালের সেই ভয়াবহ বন্যা। আমি তখন দেশে। ছাত্রজীবন আমার। ছাত্রজীবনে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিলাম কতগুলো সংগঠনে সঙ্গে। তার মধ্যে দুটো সংগঠনের কথা খুব বেশি মনকে নাড়া দিয়ে যায়। তার একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন স্বরশ্রুতি। অপরটি নাট্য সংগঠন ঢাকা নাট্যম। এই সংগঠনের বর্তমান কোনো কার্যক্রম না থাকলেও একটা সময় তার খুব উদ্যম ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া একদল ছাত্র-ছাত্রী দলটিকে পরিচালনা করত বলা যায়। আমি নিজেও ঢাকা নাট্যমের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি নিষ্ঠার সঙ্গে। নিজের কথা এত জোর দিয়ে বলছি এর কারণ হচ্ছে, এখনো অন্তরের গহিনে সেই সহজ-সরল ও সৎ বিশ্বাসটা দৃঢ়ভাবে লালন পালন করছি বলেই।
১৯৮৮ সাল। বন্যা পরিস্থিতি চরমে এসে গেল। বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের সকলে মিলে বন্যার্তদের পাশে দাঁড়াব। নাট্যকর্মীরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলাম। যদিও গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন ও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট সর্বদাই আর্তমানবতার কাজ করেছে ও করে যাচ্ছে।
সেবার নাট্যকর্মীরা মিলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের ক্যাফেটেরিয়াতে দিনের পর দিন রুটি বানাতে শুরু করলাম। উদ্দেশ্য বানভাসি মানুষের মাঝে বিতরণ করব। কেবল মঞ্চে কাজ করেন নাট্যকর্মীরাই নন; মঞ্চ ও সেসময়ের বাংলাদেশ টেলিভিশনে কাজ করেন জনপ্রিয় অভিনেতা-অভিনেত্রীরাও এলেন আমাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতে। আমরা কেউ সারা দিনভর রুটি বানাচ্ছি, আবার দল বেঁধে ঢাকা শহরের বাসায় বাসায় ঘুরে অর্থ, পুরোনো কাপড় জামাসহ আরও কত কী সংগ্রহ করেছি, এমনকি ওষুধের দোকানে গিয়ে বন্যার্তদের জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধও সংগ্রহ করেছি।

বানানো রুটি ও সংগৃহীত কাপড় জামা, ওষুধ এবং আরও কত কিছু নিয়ে অনেকগুলো দলে বিভক্ত হয়ে সকালে বেরিয়ে পড়তাম। কোনো কোনো দল চলে যেত মুগদাপাড়া, বাসাবোর পেছন দিকে, আবার কোনো দল যেত কামরাঙ্গীরচর চরে কিংবা বুড়িগঙ্গা পেরিয়ে জিঞ্জিরাতে। একেকটি দলে সাধারণত একেকজন দলনেতার ওপর দায়িত্বটি অর্পিত হতো। আমি নিজেও দলনেতার দায়িত্ব পালন করেছি। মাসব্যাপী বন্যার্তদের জন্য স্বেচ্ছাসেবকের কাজ করেও বিন্দুমাত্র ক্লান্তি অনুভব করিনি।
একদিনের একটি বেদনার কথা যা আজও ভুলতে পারিনি। আমরা কামরাঙ্গীরচর চরে পৌঁছালাম কয়েকটি নৌকা করে। নৌকাগুলো ইঞ্জিনচালিত। গিয়ে দেখি চারদিকে জলবন্দী হয়ে আছেন মানুষ আর মানুষ। ঘরের চালাও ডুবুডুবু করছে। আর একেকটি ঘরের চালার ওপরে বসে আছেন অসংখ্য মানুষ! কীসের যেন অপেক্ষা তাদের। আমাদের দেখেই মুহূর্তেই সাঁতরে চলে এল কত কিশোর-কিশোরী ও নারী-পুরুষ। কেউবা অ্যালুমিনিয়ামের পাতিল ভাসিয়ে তাতে ভর করে, কেউ আবার কলাগাছের ভেলায় চড়ে। আমাদের ত্রাণকর্মীদের নৌকাগুলোকে জেঁকে ধরল সাহায্য নেবার জন্য। আমরা আমাদের ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করার প্রায় শেষ পর্যায়ে লক্ষ্য করলাম অদূরেরই একটি ঘরের চালার ওপরে বসে একজন বৃদ্ধা আমাদের উদ্দেশে হাত নাড়ছেন। আমরা বুঝে নিলাম, তাঁর শক্তি নেই আমাদের কাছে এসে ত্রাণ নেওয়ার। কোনো বাহনও নেই যে তাতে করে তিনি আসবেন। আমরা বৃদ্ধার জন্য ত্রাণসামগ্রী রেখে দিলাম। সবশেষে গেলাম তাঁর কাছে। গিয়ে দেখি তিনি যে ঘরের চালার ওপর বসে আছেন সেই ঘর বানের জলে ভিজে ভিজে কাত হয়ে কোনোরকমে দাঁড়িয়ে রয়েছে। দু-এক দিন পরে হয়তো ভেঙেও পড়তে পারে। বৃদ্ধাকে ত্রাণসামগ্রী বিতরণকালে আমাদের সকলের চোখ প্রায় অশ্রুতে ঝলঝল করছিল।
সেদিন সেই বৃদ্ধার সামনে বানের জলে প্লাবিত না হয়ে অশ্রুজলে প্লাবিত হয়েছিলাম এবং যতটুকু অশ্রুজলে প্লাবিত হয়েছিলাম, তার চেয়ে ঢের বেশি আজও প্লাবিত হচ্ছি হৃদয়ের অশ্রুজলে এই প্রবাসে দিনযাপন করে করে সেই বৃদ্ধার অসহায়ত্বের কথা চিন্তা করে।
আজ যখন জাপানে বসে বন্যার খবর পাই, সেই ১৯৮৮ সালের বানভাসি মানুষের মুখমণ্ডলগুলো চোখের সামনে জ্বলজ্বল করে ওঠে। সে বছর ত্রাণকর্মী হিসেবে আমরা নাট্যকর্মীরা যারা গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের ছোট ব্যানার গায়ে ধারণ করে একসঙ্গে কাজ করেছিলাম, সেই সকল সহযোদ্ধাকে এই ২০১৭ সালে এসেও খুব মনে পড়ছে।
আমরা জাপানপ্রবাসীরা মিলে এখানেও হৃদ্যতার মাঝে ছোট ছোট বাংলাদেশ গড়ে তুলেছি। অর্থাৎ হৃদয়ের গভীরে সযত্নে বাংলাকেই লালন করে থাকি। আর তাই তো বাংলাদেশের দুর্দিনে দেশের মানুষকে সহযোগিতার হাত প্রসারিত করে থাকি। কখনো চ্যারিটি কনসার্ট করে, কখনো মিটিং করে, কখনো টোকিও বৈশাখী মেলার মধ্য দিয়ে। সবচেয়ে আশ্চর্য হওয়ার বিষয় হলো, আমাদের আয়োজিত চ্যারিটি কনসার্টগুলোতে জাপানি শিল্পীরাও বাংলায় গান গেয়ে যোগ দিয়ে থাকেন। আমরা বাংলাদেশিরা নিজের দেশই নয়, আমরা সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছি জাপানের ভূমিকম্প ও প্রলয়ংকরী সুনামির দুর্দিনে। এমনকি নেপালের ভূমিকম্পেও।
এ বারও বাংলাদেশের বন্যা কবলিত মানুষের জন্য জাপানপ্রবাসীরা বিভিন্নভাবে এগিয়ে এসেছেন। আমি নিজেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের মধ্য দিয়ে জানতে পারলাম, দেশে লেখক-শিল্পী সমাজ মিলে বানভাসি মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছেন। সেই সংবাদ পেয়ে আমার অনেক পরিশ্রমে উপার্জিত অর্থ প্রেরণ করে লেখক-শিল্পী সমাজের সঙ্গে অংশ নিতে বিন্দুমাত্র বিলম্ব করলাম না।
এই মুহূর্তে এই পরবাসে কর্মব্যস্ততার মাঝেও সারা দিন কেবল বন্যার্তদের কথাই ভাবছি। ভাবছি—বঙ্গোপসাগরের পাশ ঘেঁষে একটি বদ্বীপ। যার নাম বাংলাদেশ। আমার প্রাণপ্রিয় মাতৃভূমি। সেই ভূমিতে বানের জলে ভাসছেন যে বৃদ্ধ, তিনি আমার পিতামহ কিংবা মাতামহ। আর ওই বৃদ্ধা নিশ্চয় আমার পিতামহী অথবা মাতামহী। আর জলের ভেতরে দাঁড়িয়ে যিনি আহাজারি করছেন তিনি তো আমারই মা। বানের জলে ভেসে ভেসে সাঁতরে এসে যেই কিশোর-কিশোরী সাহায্য নেবার আশায় হাত পাতছে তারা তো আমার সহোদর বা সহোদরা। কিংবা আমিই সেইজন যে বানভাসি হয়ে অপেক্ষারত একমুঠো ভাত অথবা এক টুকরো শুকনো রুটির জন্য।
জুয়েল আহ্সান কামরুল: টোকিও, জাপান।