বাদুড় রহস্য

পড়াশোনা শেষ করে অনেক দিন ধরে চাকরি খুঁজছিলাম। মার্কিন মুল্লুকে নিজের মনের মতো চাকরি পাওয়া খুবই কঠিন। আমি নিরিবিলিতে আর নিজের মতো করে থেকে বই-টই পড়া মানুষ। এমন একটা চাকরি খুঁজছিলাম যেখানে কিছুটা একা একা থাকা যায়।
একদিন আমার প্রফেসর ড. জনের সাথে এই নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। জন আমার মাস্টার্স সুপারভাইজর। জন বললেন, ওনার এক বন্ধু ফরেস্ট বিভাগের বড় কর্মকর্তা। ওরা কী একটা প্রজেক্টের জন্য লোক খুঁজছে, জন সঠিক জানেন না। আমি যদি রাজি থাকি তবে উনি ওনার বন্ধুর সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিতে পারেন।
কয়েক দিনের মধ্যেই ড. জন আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন। বন্ধুর নাম হেলম্যান। হেলম্যান বললেন, এই কাজের জন্য ওনারা এমন একজনকে চাচ্ছেন যে কিনা একটানা জঙ্গলে, জন-মানবহীন পরিবেশে থাকতে পারবে। এই ধরনের পরিবেশে আমি থাকতে পারব, কোনো সমস্যা হবে না—এমন একটা আভাস দিতেই লোকটি আমাকে চাকরি দিয়ে দিলেন। আমার পড়াশোনা নিয়েও বেশি একটা জিজ্ঞাসা করলেন না। ভাবলাম, যাক মনের মতোই একটা চাকরি পেলাম।
চাকরির জায়গাটা অরিগন অঙ্গরাজ্যের একটা গ্রামে। জঙ্গুলে এলাকা। আমার কাজটাও জঙ্গল বিষয়ক। জঙ্গলের ভেতর বিভিন্ন ধরনের মাপজোখের কাজ-কর্ম। গিয়ে মনে হলো, আশপাশে দশ মাইলের মধ্যে কোনো বসতি নেই। জঙ্গলের মাঝখানে কাঠের তৈরি দোতলা বাড়ি। ওটাই আমার থাকার জায়গা। যে লোক আমাকে নামিয়ে দিয়ে গেল, সে বলল পনেরো মাইলের মধ্যে একটা সুপার মার্কেট আছে। আমার নিত্য প্রয়োজনীয় যা লাগে, আমাকে ওখান থেকেই কিনতে হবে। আশপাশের মধ্যে আর কিছু নেই। যাওয়ার সময় লোকটা আমাকে একটা গাড়িও দিয়ে গেল। গাড়িটা জঙ্গলে আগেই রাখা ছিল। হাতে চাবি দিতে দিতে লোকটি বলল, ‘ভালো গাড়ি, মাত্র পঞ্চাশ হাজার মাইল চলেছে। ঠিকমতো যত্ন করলে অনেক দিন চালাতে পারবেন। তবে সমস্যা একটু বেশি গ্যাস খায়।’ এরপর ‘গুড লাক’ বলে লোকটি চলে গেল।
এরপর কয়েক দিন সময় লাগল জিনিসপত্র গোছগাছ করতে আর নতুন পরিবেশে অভ্যস্ত হতে। তখন জানুয়ারি মাস। প্রচণ্ড ঠান্ডা। প্রতিদিনই বরফ পড়ে। বরফ পড়ে রাস্তাঘাটের অবস্থা খারাপ। দোকানপাট অনেক দূরে বলে, নিয়মিত শহরের দিকে যাওয়া হয় না। একবার গেলে তিন-চার সপ্তাহের জিনিসপত্র কিনে নিয়ে আসি।
দিনে কাজের সময়, সকাল দশটার মধ্যে শহর থেকে অফিসের লোকজন চলে আসে। সারা দিন তাদের সাথে থাকি। কাজ শেষে সবাই বিকেলের আলো থাকতে থাকতেই চলে যায়। আবার একাকী। খুব এনজয় করি এ একাকিত্ব। তবে সমস্যা বাঁধাল একটা ব্যাপার। আর তা বাদুড় সমস্যা। প্রথম কয়েক দিন বুঝিনি। পরে ধীরে ধীরে তা বুঝতে পারলাম।
একদিন রাতে ঘরে ফায়ার প্লেসের সামনে বসে আরাম করে বই পড়ছি। বাইরে প্রচণ্ড ঠান্ডা, বরফ পড়ছে। আমি ফায়ার প্লেসের আগুনটা নেড়ে দিয়ে যেই বইয়ের পাতায় ঝুঁকেছি, অমনি বাইরে শুনলাম খস খসে একটা শব্দ। মনে হচ্ছে কেউ যেন বাইরে কাঠের দেয়ালে শরীর ঘষছে। শীতের মধ্যে দরজা খুলে দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে না। আবার শব্দটাও বিরক্তিকর। বইয়ে মনোযোগ দিতে পারছি না। চরম বিরক্তিতে দরজা খুলে দেখি একটা বাদুড়। বারান্দার খুঁটিতে উল্টো হয়ে ঝুলে আছে। কিছুক্ষণ পর পর দেয়ালে মাথা ঘষছে। আমি কী করব বুঝলাম না। আগে কখনো এই রকম অবস্থায় পড়িনি। একটু ভয়ও পেলাম, বাদুড়টা যদি ঘরে ঢুকে পড়ে, আর আমাকে আক্রমণ করে বসে! আমি হাত নেড়ে সরানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু বাদুড়টা কোনো পাত্তাই দিল না। নির্বিকার চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। সে দৃষ্টি যেন ইঙ্গিতময়। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। বাদুড়টা পরে যেন নিজের ইচ্ছেতেই উড়াল দিয়ে জঙ্গলের আঁধারে অদৃশ্য হয়ে গেল। ঘরে ঢুকে বইয়ে মন দিলাম। বাদুড়টার কথা ভুলে গেলাম।
পরদিনও একই অবস্থা। সন্ধ্যার পর পরেই দেখি একটা বাদুড় উল্টো হয়ে ঝুলে আছে, আর কিছুক্ষণ পরপরেই কাঠের দেয়ালে শরীর ঘষছে। সেই একই বাদুড় বলে মনে হলো। ঝুলে আছে ঝুলে থাকুক। কোনো সমস্যা ছিল না। কিন্তু শব্দটাই সমস্যা। কিছু করতে পারি না। মনোযোগ সব সময় শব্দের দিকে থাকে। সেদিন কি হলো জানি না। দরজা খুলে বের হয়ে লাঠি না কি যেন একটা পেলাম হাতের কাছে, তাই ছুড়ে মারলাম। সরাসরি ওটার মাথায় গিয়ে লাগল। বাদুড়টা বারান্দায় পরে কিছুক্ষণ নড়াচড়া করে নির্জীব হয়ে গেল। মনে হলো মারা গেছে। খারাপ লাগল খুব। মারার ইচ্ছে ছিল না। লাঠিটা ছুড়েছিলাম তাড়ানোর জন্য। সামনে গিয়ে লাঠিটা দিয়ে খোঁচা দিয়ে দেখলাম। কোনো নড়াচড়া নেই। বাদুড়টা সত্যই মারা পড়েছে।
আমি ছাড়া আর কেউ নেই, তাও আমি আশপাশে জঙ্গলের দিকে তাকালাম। কেউ দেখেছে কিনা বোঝার চেষ্টা করলাম। মৃত বাদুড়টাকে নিয়ে কি করব চিন্তা করছি। ভেবে মনে হলো দ্রুত এটাকে মাটি চাপা দেওয়া দরকার। বাদুড়টাকে একটা ব্যাগে ভরে হিঁচড়ে একটু দূরে জঙ্গলের মধ্যে নিয়ে গেলাম। বড় একটা গাছের নিচে মাটি চাপা দেব ঠিক করলাম। অনেক পুরু হয়ে বরফ জমে আছে সেখানে। হাত দিয়ে বরফ সরিয়ে, মাটি খুঁড়ে ছোট একটা গর্ত করে বাদুড়টাকে মাটি চাপা দিলাম। ফিরে এসে কিছুতে আর মন বসল না। মনটা খচ খচ করতে লাগল। রাতে ঘুমেও কি সব এলোমেলো স্বপ্ন-টপ্ন দেখলাম।
রাতে ভালো ঘুম হয়নি সে জন্যেই কিনা, পরের সারাটা দিন ঘুম ঘুম একটা ভাব রইল। রাতে খাওয়া দাওয়া সেরে একটু আগে আগে শুয়ে পড়ব ভাবছি, এমন সময় দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। খুব অবাক হলাম, কারণ এখানে এসে সন্ধ্যার পর কখনো কোনো মানুষজন দেখিনি। কে এল! আরেকটা ব্যাপারেও অবাক হলাম। আমি থাকি কাঠের দোতলায়। কেউ উঠে আসতে থাকলে, সাধারণত মড় মড় একটা শব্দ পাওয়া যায়। কিন্তু তেমন কোনো শব্দ পেলাম না, অথচ দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ।
দরজা খুলে দেখি দীর্ঘদেহী মধ্যবয়স্ক এক লোক দাঁড়িয়ে আছে। লোকটির মুখে কাঁচাপাকা দাঁড়ি। মুখে কেমন যেন এক ধরনের গাম্ভীর্য, আবার সাথে কৌতূহলী এক ভাব। গায়ে গির্জার যাজকদের মতো পোশাক।
লোকটাকে ভদ্রতা করে ঘরে এনে বসালাম। লোকটি বলল, সে নাকি কাছের একটা গির্জার যাজক। রাতে এমনি মনের খেয়ালে হাঁটতে বেরিয়েছেন। জঙ্গলের মধ্যে আমার দোতলা বাড়ি, আর তাতে বাতি জ্বলছে দেখতে পেয়ে কথা বলতে এসেছেন।
মনে মনে ভাবলাম, উনি তো দেখি অতি ভদ্র লোক। রাত-বিরেতে মানুষদের খোঁজ খবর নিয়ে বেড়ান। আর রাতের বেলা এই প্রচণ্ড শীতে, তুষারপাতের মধ্যে ঘুরতেই বের হন কেন ঠিক বুঝলাম না। আমি কৌতূহল সামলে বললাম, ‘আমি এখানেই থাকি। জঙ্গলের মাপ জোখের কাজ করি।’
লোকটি বলল, ‘আচ্ছা, আচ্ছা। খুব ভালো।’ এই বলে আমার ঘরের আশপাশে তাকাতে থাকল। দেখে মনে হচ্ছিল, উনি যেন কিছু একটা খুঁজছেন।
লোকটি তাকাতে তাকাতে বলল, ‘আপনার এখানে অনেক বাদুড়ের উপদ্রব। না?’
আমি বললাম, ‘হ্যাঁ। মাঝে মাঝে হয়। আপনি জানলেন কীভাবে?’
লোকটি হেসে বলল, ‘আমি তো এখানেই থাকি। আপনার মতোই, এই জঙ্গলেই।’
অবাক হয়ে বললাম, ‘তাই নাকি?’
‘হুম। আমাদের গির্জাটা আপনার এখান থেকে দুই মাইল উত্তরে। আমি সেখানেই থাকি। সারা দিন গির্জার ভেতরে থাকি। সন্ধ্যার ঠিক পরপরেই জঙ্গলে আশপাশে ঘুরতে বের হই।’
এমন পরিবেশে রাতে ঘুরতে বের হওয়া যেন খুবই স্বাভাবিক, মুখে এমন একটা ভাব নিয়ে বললাম, ‘ও আচ্ছা।’
লোকটি হটাত করে উঠে পড়ল, বলল, ‘যাই আজকে। আপনাকে অনেক বিরক্ত করলাম। আবার দেখা হবে।’
এই বলে লোকটি হন হন করে দরজা দিয়ে বের হয়ে গেলেন। অদ্ভুত ব্যাপার, লোকটি নামার সময়েও তেমন কোনো শব্দ হলো না। আমি আর সে ব্যাপারে মাথা না ঘামিয়ে, বাতি নিভিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।
পরদিন বিকেলে আগে আগে কাজ শেষ হয়ে গিয়েছিল। ভাবলাম, আশপাশে একটু ঘুরে-টুরে আসি। গতকাল রাতের লোকটার কথা ভেবে আমি উত্তর দিকে হাঁটা শুরু করলাম। লোকটি বলেছিল উত্তরদিকে দুই মাইলের মতো গেলেই তাদের গির্জা। লোকটি যেভাবে বলেছিল ‘আমাদের গির্জা’, আমি ভেবেছিলাম কোনো জাঁকজমকপূর্ণ গির্জা হবে হয়তো। কিন্তু কথা মতো গিয়ে দেখি বেশ জরাজীর্ণ ভেঙে পড়া একটা কাঠের স্তূপের মতো কিছু একটা। ভেঙে পড়া কাঠগুলো কয়লার মতো কালো। এক সময় যে এটা একটা গির্জা ছিল, সামনে বড় একটা ক্রুশ না থাকলে বুঝতেই পারতাম না। গির্জার পেছনে একটু জায়গা কবর খানার মতো। মরচে পড়া ছোট একটা গেট দিয়ে সেখানে ঢুকতে হয়। তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। শীতের কনকনে হাওয়া শো শো করে বয়ে যাচ্ছে। সে বাতাসে মরচে ধরা লোহার গেটটা ক্যাচ ক্যাচ শব্দে নড়াচড়া করছে। চারদিক ধূসর ও কুয়াশাচ্ছন্ন। রাত হয়ে আসছে। কোনো লোকজন নেই বলে, চলে আসার জন্য যেই ঘুরেছি, অমনি দেখলাম, রাতের সেই লোকটা গির্জার পাশের একটা রাস্তা দিয়ে হেঁটে আসছে।
আমাকে দেখে চিনতে পারল। হাত নেড়ে বলল, ‘চলে যাচ্ছেন নাকি?’
আমি বললাম, ‘হ্যাঁ।’
লোকটি বলল, ‘চলেন আমাদের কবরখানাটা আপনাকে দেখাই।’ আমি মনে মনে ভাবলাম, কবরখানা দেখার কী আছে।
তারপরেও লোকটির সাথে হেঁটে হেঁটে কবরখানার সামনে চলে এলাম। লোকটি হাত তুলে দেখিয়ে বলল, ‘এই যে কবরগুলো দেখছেন, এগুলো কাদের জানেন?’
আমি চুপ করে আছি দেখে বলল, ‘এগুলো সব বাদুড়দের কবর।’
আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘বাদুড়দের কবর? মানুষদের নয়?’
লোকটি বলল, ‘হ্যাঁ। বাদুড়দের কবর। মৃত্যুর পরে মানুষদের যেমন আমরা কবর দেই, তেমনি বাদুড়দেরও দিতে হয়। ওরা তো মানুষদের মতোই অনেকটা।’ ভাবলাম লোকটির মাথা খারাপ। বাদুড় মানুষের মতো হবে কেন!
লোকটি যেন আমার মনের কথা ধরতে পারল, বলল, ‘বাদুড়ের কঙ্কাল দেখেছেন কখনো?’
বললাম, ‘না।’
‘কঙ্কাল দেখলে বুঝতেন। মানুষের সাথে বাদুড়দের কঙ্কালের অনেক মিল। মানুষদের হাতে-পায়ে যেমন পাঁচটি আঙুলের হাড়, বাদুড়দেরও তাই। মানুষের বাচ্চা যেমন মায়ের বুকের দুধ খেয়ে বড় হয়, তেমনি বাদুড়ের বেলাতেও তাই। আর সবচেয়ে বড় কথা’—এই বলে লোকটি একটু সময় নিয়ে মুখে একটু রহস্যময় হাসি ফুটিয়ে বলল, ‘মানুষ মরে গিয়ে অনেক সময় যে ভ্যামপায়ার হয়, সে ভ্যামপায়ারদের সাথে বাদুড়দের একটা সম্পর্ক আছে, সে কথাতো ছোট ছোট বাচ্চারাও স্কুলে যাওয়ার আগে থেকেই জানে।’
আমি লোকটিকে বললাম, ‘ভ্যামপায়ার কাল্পনিক ব্যাপার। বাস্তবে তার অস্তিত্ব নেই।’
লোকটি বলল, ‘কীভাবে বুঝলেন বাস্তবে নেই।’
আমি চুপ করে আছি দেখে বললেন, ‘আছে আছে। আপনারা জানেন না। এই রকম জঙ্গলের মধ্যে পুরোনো গির্জা আর কবরখানাতে অনেক ভ্যামপায়ার দেখা যায়।’
আমি আর কথা বাড়ালাম না। ভয়ও হচ্ছিল। শহুরে পরিবেশে ঝলমলে আলোতে বন্ধু বান্ধবদের আড্ডায় ভৌতিক ব্যাপারগুলো যত সহজে উড়িয়ে দেওয়া যায়, এই রকম জনহীন কুয়াশা ঘেরা জীর্ণ কবরখানার পরিবেশে তেমনটি আসলে পারা যায় না। রহস্যময় এক আবহ মনকে ছেয়ে ফেলে। মানুষের যুক্তিবাদী মনও তখন নড়বড়ে হয়ে ওঠে।
লোকটি আগের কথায় ফিরে গেল। বলল, ‘যা বলছিলাম। বাদুড় মারা গেলেও তাকে কফিনে ভরে কবর দিতে হয়। তাকে মাটি চাপা দেওয়া ঠিক নয়।’ এই বলে লোকটি আমার দিকে আড়চোখে চাইল।
আমি অপ্রস্তুত হলাম। মনে হলো, আমার হাতে যে একটা বাদুড় মারা পড়েছে, আর আমি যে তাকে মাটি চাপা দিয়েছি, লোকটি সে কথা জানে।
আমি লোকটিকে এড়াবার চেষ্টা করতে লাগলাম। বললাম, ‘আমি যাই আজকে। পরে আবার দেখা হবে।’ এই বলে তাড়াতাড়ি হাঁটা দিলাম। একটু দূরে গিয়ে পেছনে তাকালাম, অদ্ভুত ব্যাপার, লোকটিকে দেখতে পেলাম না। হটাত করেই যেন উধাও হয়ে গেল। ভাবলাম, সে গির্জায় হয়তো ঢুকে পড়েছে। তবে ঠিক সেই সময় কবরখানার সামনে একটা একটা লম্বা লোহার খুঁটিতে বড় একটা বাদুড়কে ঝুলে থাকতে দেখলাম। আগে ওটাকে দেখিনি। হতভম্ব হয়ে সে রাতে বাড়ি ফিরলাম।
এর পরের কয়েক দিন কোনো ঝামেলা ছাড়াই কাটল। এর মধ্যে একদিন হেলম্যান ফোন করলেন। কাজ-কর্ম কেমন চলছে আর কোনো সমস্যা হচ্ছে কিনা জানতে চাইলেন। আমি কথা বলতে বলতে এক সময় বাদুড় প্রসঙ্গটা তুললাম। ওনার গলার স্বর শুনে মনে হলো, ব্যাপারটা সম্পর্কে উনি জানেন। আমি বললাম, ‘ব্যাপারটা একটু খুলে বলবেন।’ উনি বললেন, ‘এগুলো আসলে লোকাল কল্পকাহিনী। ওতে কান দিয়ো না।’ আমিও নাছোড়বান্দা। বললাম, ‘ঠিক আছ কান দেব না। কিন্তু কাহিনিটা কি?’
পরে হেলম্যান বললেন, ‘ওখানকার এক পুরোনো গির্জায় অনেক দিন আগে এক যাজক ছিলেন। কি সব ব্ল্যাক ম্যাজিক নাকি করতেন। ওনার ব্ল্যাক ম্যাজিকের প্রধান বাহক ছিল বাদুড়। গির্জার ভেতরে অনেক বাদুড় পুষতেন, তাদের নিয়ে অনেক মন্ত্র তন্ত্রের সাধনা করতেন। বাদুড়দের নিজের পরিবারের লোকজনের মতো ভাবতেন। ওরা মারা গেলে মানুষদের মতো কফিনে ভরে কবর দিতেন। সে যাজক ব্ল্যাক ম্যাজিক দিয়ে মানুষের আত্মাকে বাদুড়দের মধ্যে প্রবাহিত করে অনেক ভুতুড়ে কাজ কর্ম করতেন। একদিন গ্রামবাসী এসব জানতে পেরে, সে যাজকে আর তার বাদুড়দের গির্জার ভেতর আঁটকে আগুন লাগিয়ে দেয়। গির্জার ভেতরেই সবাই আগুনে পুড়ে মারা যায়। আমি অবশ্য এসব কখনোই বিশ্বাস করিনি। এগুলো লোকাল ফোকলোর টাইপ কাহিনি। এসব কাহিনি বলতে ও শুনতে মানুষ খুব মজা পায়। যুগ যুগ ধরে তাই এসব কাহিনি মানুষদের মুখে মুখে চলে আসছে। আশা করি তুমি এসবে কান দেবে না।’
আমি অবশ্য আর কিছু বললাম না। প্রসঙ্গ পাল্টে অন্য বিষয়ে কথা বলে ফোন রেখে দিলাম। ব্যাপারটা আমার মনে ঘুরপাক খেতে লাগল। তবে আসল সমস্যা টের পেলাম পরদিন থেকেই।
পরের দুই দিন কাটল চরম আতঙ্কের মধ্যে। সন্ধ্যার পর পরই দেখি বাড়ির সামনের বড় বড় গাছগুলোতে অনেক বাদুড় আমার ঘরের দিকে মুখ করে উল্টো হয়ে ঝুলে থাকে। প্রথম দিন দেখলাম প্রায় পনেরো কি বিশটার মতো বাদুড় এ রকমভাবে ঝুলে আছে। সে রাতে ছিল হালকা জোছনা। চাঁদের আলোতে গাছগুলোর ওপরে জমে থাকা বরফ ঝলমল করছিল, আর সাথে ঝলমল করছিল সেই সব বাদুড়দের লাল লাল চোখগুলো। তারা যেন এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে আমার গতিবিধি লক্ষ্য করছে। কিছু চায় আমার কাছ থেকে। দ্বিতীয় দিন বাদুড়দের সংখ্যা আরও বেশি। অনেক বাদুড় সেদিন আমার দোতলার বারান্দার খুঁটিতেও ঝুলে থাকল। কয়েকটা বাদুড় দেয়ালে তাদের শরীর ঘষতে থাকল। আতঙ্কে আর বিরক্তিতে আমার সাহস হটাত অনেক বেড়ে গেল। আমি বুঝলাম ওরা আসলে কি চায়।
আমি তখনই সে শীতের মধ্যেই নিচে নেমে গেলাম। বাদুড়টাকে যেখানে মাটি চাপা দিয়েছিলাম, চাঁদের আলোয় সেখানে গিয়ে মাটি খুঁড়ে ওটাকে বের করলাম। অবাক হলাম বাদুড়টা তেমন পচেনি। তেমন দুর্গন্ধও পেলাম না। বাদুড়টাকে বের করে ছোট একটা কাঠের বাক্সে ভরলাম। তার পর হাঁটা দিলাম উত্তর দিকে সে গির্জার দিকে।
গির্জার চারপাশে সুনসান নীরবতা। মাঝে মাঝে কেবল কন কনে বাতাসের শো শো শব্দ। আমার সাহস তখন তুঙ্গে। আমি গির্জার পেছনে লোহার গেটটা খুলে কবর খানায় ঢুকলাম। সামনে ডানদিকে একটু খালি জায়গা পেয়ে গর্ত খুঁড়ে বাদুড়সহ সে বাক্সটাকে পুতে দিলাম। তবে এবার আমি প্রচণ্ড ভয় পেলাম। মনে হলো, কে বা কারা যেন অদৃশ্য দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আকাশে তখন অর্ধেক চাঁদ। মাঝে মাঝে তার মুখ মেঘের মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছে। বাড়ির দিকে দ্রুত হাঁটতে হাঁটতে পিছু ফিরে সে চাঁদের দিকে তাকালাম। দেখলাম, এক পাল বাদুড় স্থির ডানা মেলে যেন চরম প্রশান্তিতে তার পাশ দিয়ে উড়ে গেল।
তার পরের কাহিনি সংক্ষিপ্ত। সে থেকে আর তেমন বাদুড় দেখিনি। তাদের উপদ্রবও আর হয় না। শীতের রাতে ফায়ার প্লেসের পাশে বসে বই পড়তে পড়তে কোনো কোনো দিন কখন যে ঘুমিয়ে পড়ি, টেরও পাই না। আমার চারপাশের জঙ্গলে তখন ধীরে ধীরে গভীর রাত নামে, তুষার ঝড়ে বনের পথে পুরু বরফ জমতে থাকে। কখনো কখনো সন্ধ্যার পর, দুই একটা বাদুড় সেই উত্তর দিক থেকে উড়ে আসে। বাড়ির পাশের বড় গাছে উল্টো হয়ে কিছুক্ষণ ঝুলে থেকে আবার সে উত্তর দিকেই উড়ে যায়। তবে তারা কোথায় যায় আমি বইয়ের পাতাতে চোখ রেখেই তা বুঝতে পারি। (ফিলাডেলফিয়া থেকে)