বাঙালির বোধোদয় হবে কবে?
সম্প্রতি বাংলাদেশে দুজন বিদেশি নাগরিক হত্যার ঘটনায় স্তম্ভিত হয়েছি। বিশেষ করে জাপানি নাগরিক হত্যার ঘটনায় জাপানিরা বিস্মিত ও হতাশ। বাংলাদেশে বসবাসরত অনেক জাপানি ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছেন। বিভিন্ন পেশার জাপানি বন্ধুরা ফোন করে একই কথা বললেন যে, বাংলাদেশের সঙ্গে জাপানের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বহু প্রাচীন। এই দেশে একজন সাধারণ জাপানি নাগরিক খুন হবেন তা তারা কল্পনাও করতে পারেননি। কল্পনা করিনি আমি নিজেও। আমার জাপানি স্ত্রীও! তাই ধাক্কাটা সামলাতে পারছি না।
দুদিন ধরে ভাবছিলাম, একটা রাষ্ট্রের প্রশাসনযন্ত্র কতখানি নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে গেলে পরে বিদেশিরা পর্যন্ত অবাধে খুন হতে পারে তা আর ব্যাখ্যার সুযোগ নেই। একেবারেই নগ্ন হয়ে গেলাম আমরা অন্ততপক্ষে জাপানের কাছে। জাপান নামক এই দেশটি বাঙালিকে বিগত শত বছর ধরে কী সম্মানই না প্রদর্শন করে আসছে। তার বিনিময়মূল্য দেওয়া হলো সে দেশের একজন নিরপরাধ নাগরিককে গুলি করে হত্যার মধ্য দিয়ে দিনদুপুরে প্রকাশ্যে। এ যে কত বড় দুঃসহ ঘটনা বাংলাদেশের রাষ্ট্র বিধাতারা বুঝতে সক্ষম হলে তাৎক্ষণিকভাবে বেফাঁস ‘ছেলেমানুষি’ মন্তব্য করতে পারতেন না। মানসিকভাবে তারা যে কী পরিমাণ অসুস্থ ভেবে লজ্জিত হওয়া ছাড়া উপায় দেখছি না।
স্বাধীনতার পর থেকেই জাপান সরকার কতভাবেই না যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটাকে ওপরের দিকে টেনে তোলার জন্য অর্থ দিয়ে, প্রযুক্তি দিয়ে, কারিগর পাঠিয়ে, প্রকল্প স্থাপনের মধ্য দিয়ে চেষ্টা করে আসছে—এমনটি নজিরবিহীন। যে পরিমাণ সাহায্য জাপান বাংলাদেশকে দিয়েছে সেটা ভারত পেলে বহু আগেই উঠে দাঁড়িয়ে যেত! কিন্তু বাংলাদেশ পারেনি। বিতর্কিত একটি নির্বাচন সত্ত্বেও জাপান সরকার প্রধানমন্ত্রীকে জাপানে আমন্ত্রণ জানিয়ে সম্মান তো দিয়েছেই, বাংলাদেশের উন্নয়নকে আরেকবার গতি দেবার জন্য বিপুল অঙ্কের আর্থিক সাহায্য-সহযোগিতা ঘোষণা করেছে। এই টাকা সরকারের টাকা নয়, জনগণ ও প্রতিষ্ঠান কর্তৃক প্রদত্ত মূল্যবান করের টাকা। এটা ভুলে গেলে চলবে না।
উল্লেখ করতে হয় যে, কয়েক বছর আগে আরেকটি কেলেঙ্কারির জন্য জাপানে আমরা প্রবাসীরা নিদারুণ লজ্জায় অবনত হয়েছিলাম! অবশ্যই তাতে করে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে ব্যাপকভাবেই। বাংলাদেশের সিলেটে ‘বাংলাদেশ-জাপান সাংস্কৃতিক কেন্দ্র’ নামে একটি মৈত্রী প্রতিষ্ঠান স্থাপনের প্রকল্প দিয়েছিলেন দারাদ আহমেদ নামে এক প্রবাসী বাংলাদেশিকে জাপান শীর্ষ রবীন্দ্রগবেষক অধ্যাপক কাজুও আজুমা। যিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর দোভাষী ও ঘনিষ্ঠ বন্ধু। শুধু তাই নয়, বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানারও আমৃত্যু শুভাকাঙ্ক্ষী ছিলেন। ওই প্রকল্পের সাড়ে ছয় কোটি টাকা আত্মসাৎ করে পালিয়েছে দারাদ। যার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার আজ পর্যন্ত হয়নি। এমনকি অধ্যাপক আজুমার সহধর্মিণী মাদাম কেইকো আজুমা প্রধানমন্ত্রীকে বাংলা ভাষায় চিঠি লেখার পরও কোনো সমাধান তিনি পাননি। চিঠির কোনো সৌজন্যমূলক উত্তরও তিনি পাননি বলে জানান। যার জন্য তিনি এই ৭৯ বছর বয়সেও প্রতীক্ষা করছেন। উল্লেখ্য যে, এই বিপুল পরিমাণ টাকা প্রয়াত অধ্যাপক কাজুও আজুমার নিজের নয়। বিভিন্ন বাংলাদেশপ্রেমী ধনী জাপানি, সাধারণ নাগরিক, বৌদ্ধমন্দির ও ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান থেকে চাঁদা হিসেবে সংগ্রহ করেছিলেন। এই অপ্রত্যাশিত ঘটনার পর অসুস্থ শয্যাশায়ী কাজুও আজুমা বাকরহিত হয়ে পড়েছিলেন। সেই অবস্থায় অব্যক্ত বেদনায় মুহ্যমান ছিলেন মৃত্যু পর্যন্ত। ২০১১ সালের ২৮ জুলাই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
উল্লেখ্য যে, ২০০৭ সালে কলকাতার সল্টলেকে প্রতিষ্ঠিত ভারত-জাপান সংস্কৃতি: রবীন্দ্র-ওকাকুরা ভবনের সঙ্গে একই সময়ে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানটিরও উদ্বোধন করার কথা ছিল তার। কিন্তু তা হয়নি। যে সকল জাপানি নাগরিক চাঁদা দিয়েছিলেন তাদের কাছে এই আজুমা দম্পতি কী পরিমাণ ছোট হয়েছেন তা ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়! কোনো জবাবদিহি করতে পারেননি অধ্যাপক আজুমা ও তার স্ত্রীও। জবাবদিহিতা জাপানিসমাজে দৈনন্দিন জীবনজীবিকার প্রধান শর্ত—যার জন্য তীব্র দহনে দগ্ধ হয়েছেন বাংলা ভাষা ও রবীন্দ্রঅন্তপ্রাণ তথা বাংলাদেশপ্রেমী এই কিংবদন্তিতুল্য জাপানি এই দম্পতি। কী লজ্জার কথা!
বিদেশি পুরস্কার ও পদকের জন্য বাংলাদেশের নেতারাসহ বুদ্ধিজীবীরা মুখিয়ে থাকেন অথচ বিদেশিদের অবদানের মূল্যায়নস্বরূপ রাষ্ট্রীয় সম্মান জানাতে আইনের দরকার হয়ে পড়ে। ২০১০ সালে অধ্যাপক আজুমা যখন প্রচণ্ড অসুস্থ, হাসপাতালে মৃত্যুশয্যাশায়ী, এমন সময় জাপান সফরে এসেছিলেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান। তিনি অধ্যাপক আজুমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চাইলেন, কিন্তু চিকিৎসকের নিষেধের কারণে সাক্ষাৎ করা সম্ভব হয়নি। মহাপরিচালককে আমি একদিন সারা দিন টোকিও শহরের দু-তিনটি বিশেষ স্থানে নিয়ে যাই যেগুলো বিখ্যাত বাঙালির স্মৃতিবিজড়িত। সন্ধ্যাবেলা হোটেলে ফিরে তাকে একটি অনুরোধ করি যে, অধ্যাপক আজুমা তার অবদানের জন্য ভারতে বিভিন্ন সময়ে সম্মানিত হয়েছেন, পুরস্কার, পদক অর্জন করেছেন যেমন, বিশ্বভারতীর দেশিকোত্তম, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের রবীন্দ্র পুরস্কার উল্লেখযোগ্য। জাপানের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পদক পেয়েছেন। বাংলাদেশই তাকে যথার্থ সম্মান প্রদান করেনি। বাংলা একাডেমি তাকে কী সম্মানিত করতে পারে না? তাকে একটি রাষ্ট্রীয় সম্মান প্রদান করুন তা না হলে বাংলাদেশ ‘অকৃতজ্ঞ’ বলে বিবেচিত হবে দুই দেশের শতবর্ষ প্রাচীন সাংস্কৃতিক বিনিময় সম্পর্কের ইতিহাসে। আমি প্রচুর ছবি ও দলিলপত্র তার হাতে হস্তান্তর করি অধ্যাপক আজুমার জীবন ও কর্মকাণ্ড বিষয়ে।
তিনি বললেন, দেশে ফিরেই তিনি একটা উদ্যোগ নেবেন। তিনি উদ্যোগ নিয়েছিলেন এবং ২০১০ সাল শেষ হয় হয় সময়ে বাংলা একাডেমির রিসার্চ ফেলো নাকি লাইফ লং ফেলো ওই জাতীয় কী একটা সম্মান প্রদানের ব্যবস্থা করলেন।
আমি ফোনে বললাম, বাংলা একাডেমি পুরস্কার দিলে অসুবিধে কোথায়? বিশেষ একটি পুরস্কারও তো দেওয়া যেতে পারে।
তিনি বললেন, বিদেশিদের পুরস্কার প্রদানের আইন বাংলা একাডেমির নেই। আমরা ফেলোশিপ দিয়েছি এটা কম সম্মান নয়।
ঠিক আছে আমি মেনে নিলাম।
তিনি বললেন, ফেলোশিপের সদনপত্র কীভাবে পাঠাব? জাপানি দূতাবাসে জমা দিলে হবে?
আমি বললাম, হবে। কর্তৃপক্ষ মাদাম কেইকো আজুমাকে পাঠাবেন যদি আপনারা দূতাবাসকে অনুরোধ করেন।
তখন আমার মনে একটা সন্দেহ হয়েছিল সনদপত্রটি ঠিকমতো দূতাবাসে জমা দেওয়া হবে কি না!
বলা নিষ্প্রয়োজন কেইকো মাদাম আজ পর্যন্ত বাংলা একাডেমির সেই সম্মানজনক ফেলোশিপের সনদপত্র বা ওই জাতীয় কিছুই পাননি, জানেনও না! কাকে কী বলব ভেবে নিজেই নিজের কাছে বিব্রত হলাম।
বললে আরও বলতে হয়, ২০১০ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বিপুল দলবল নিয়ে জাপান সফর করেছিলেন। অনেক জাপানি তার সাক্ষাৎ লাভ করে ধন্য হয়েছেন। কিন্তু আজুমা দম্পতি জানেন না তাদের বন্ধু বঙ্গবন্ধুর কন্যা জাপান সফর করছেন। শত ব্যস্ততার মধ্যেও শেখ হাসিনা অধ্যাপক আজুমার খোঁজখবর নিতে পারতেন। জাপানে বসবাসরত আওয়ামীপন্থীরাও একবার তাকে স্মরণ করিয়ে দেয়নি অধ্যাপক আজুমা হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন। শেখ হাসিনা কিংবদন্তিতুল্য অধ্যাপক কাজুও আজুমার নাম জানেন না তাতো নয়!
অথচ, ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ঢাকায় গ্রেনেড হামলায় আক্রান্ত তৎকালীন বিরোধী দলের নেত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের বিদেশি শুভাকাঙ্ক্ষীদের উদ্দেশে এই ঘটনার সমস্ত বিবরণ জানিয়ে তাদের সহযোগিতা আহ্বান করেছিলেন চিঠির মাধ্যমে। সেই চিঠির একটি কপি আমি অনেক কষ্ট করে অসুস্থ অধ্যাপক আজুমার হাতে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করি। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার সেই চিঠি পড়ে কী রকম বিচলিত ও ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন সেটা আমি ও আমার সঙ্গী বঙ্গবন্ধু পরিষদ জাপান শাখার সাধারণ সম্পাদক শেখ এমদাদ হোসেইন স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেছি। তৎক্ষণাৎ তিনি কাঁপা কাঁপা হাতে ইংরেজিতে লিখিত চিঠিটির জাপানি অনুবাদ করতে বসে পড়েন স্ত্রীকে নিয়ে। সেই অনূদিত চিঠি নিয়ে গিয়ে শেখ এমদাদ বিতরণ করেছিল বিশিষ্ট জাপানি ব্যক্তিদের কাছে। শুধু তাই নয়, এই চিঠিকে কেন্দ্র করে একটি বড় প্রতিবেদনও তিনি প্রকাশের ব্যবস্থা করেন বহুলপ্রচারিত বৌদ্ধ ফেডারেশনের পত্রিকা চুউগাই নিপ্পোতে। প্রতিবেদনের সঙ্গে প্রকাশিত শেখ হাসিনার ছবি আমিই দিয়েছিলাম।
সরকার স্বাধীনতা পদক দিয়েছে বহু বিদেশিকে। জানি না সেখানে অধ্যাপক কাজুও আজুমা, সাংবাদিক তানাকা তোশিহিসা, তিব্বতে জন্ম বিশিষ্ট জাপানি গবেষক ও রাজনীতিবিদ অধ্যাপক ড. পেমা গিয়ালপো প্রমুখের নাম তালিকাবদ্ধ আছে কি না। মুক্তিযুদ্ধে তাঁদের অবদান অবিস্মরণীয়।
১৯৭২ সাল থেকে বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও নিরক্ষরতা দূরীকরণে শাপলা নীড় নামে একটি বড় জাপানি সংস্থা কাজ করে আসছে। রেখেছে উল্লেখযোগ্য অবদান। দুই দেশের সাংস্কৃতিক বিনিময়েও এই সংস্থার পরিচালক ফুকুজাওয়া ইকুফুমির অবদান অসাসান্য। জাপানে পুরস্কৃতও হয়েছে সংস্থাটি। অথচ বাংলাদেশ সরকার এই সংস্থাটিকে রাষ্ট্রীয় সম্মান প্রদান করতেই পারে। কিন্তু এই বিষয়ে নীরব সরকার।
সরকার বলে কথা নয়, আজকে মন থেকে কয়েকটি কথাই শুধু উচ্চারিত হচ্ছে। এই সব ঘটনায় বাঙালির বোধোদয় হবে কবে? আর কত বছর গত হলে পরে!
হায় জাপান ও তার নাগরিকবৃন্দ কার জন্য এত করছে! যথেষ্ট হয়নি কী? এবার জাপানের চশমা পাল্টানোর সময় এসে পড়েছে। বাংলাদেশকে যে চশমা দিয়ে জাপান দেখে এসেছে সেই চশমার কাচ অনেক পুরোনো ও ঘোলাটে হয়ে গেছে বদলানো দরকার।
(জাপান প্রবাসী লেখক ও গবেষক)