বাংলাপ্রেমী ইয়োশকা

ইয়োশকা
ইয়োশকা

আমার বাসা থেকে আমাদের পাড়ার (সাবার্ব) পাঠাগার বা লাইব্রেরি খুব কাছেই। উন্নত দেশগুলোর একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য আমার খুব ভালো লাগে। প্রায় সব লোকালয় একই রকম। প্রায় সব পাড়াতেই (অন্তত আমার দেখা দেশগুলোর বড় শহরে) একটি পাঠাগার, ঔষধালয় বা কেমিস্ট শপ, ডাকঘর ও নিত্যপ্রয়োজন মেটাবে এমন কিছু দোকানপাট থাকবেই। এগুলো নিয়েই সাবার্ব স্বয়ংসম্পূর্ণ।
আমাদের পাড়াটা বেশি বড় নয় আবার পুরানোও নয়। এর পাঠাগার নতুন ও ঝকঝকে। পত্রপত্রিকা, ম্যাগাজিন, বই তো পাওয়া যায়ই, আরও রয়েছে ক্লাসিক মুভির বেশ ভালো সংগ্রহ। এ ছাড়া নানা ভাষার ম্যাগাজিনও আছে। গ্রিক, ইতালিয়ান, ক্যাণ্টোনিজ ভাষায় অনেক কিছু পাওয়া যায়। এই পাঠাগারে বাংলা ভাষার কোনো বই আমার চোখে পড়েনি।
একদিন দেখি বিখ্যাত পরিচালক আকিরা কুরোসাওয়ার বেশকিছু মুভির ডিভিডি ডিসপ্লে শেলফে। তার আগের সপ্তাহে টিভিতে একটি পুরোনো ক্লাসিক সিনেমার ওপর আলোচনা শুনেছিলাম। এই সিনেমার কথা আমার সহপাঠী আইনজীবী তৌফিক ভাইও (তাঁর প্রকৃত নাম হাসান তাওফিক চৌধুরী। তিনি সাবেক সেনাপ্রধান ও বাংলাদেশের সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের (২০০৬) উপদেষ্টা হাসান মশহুদ চৌধূরীর ছোট ভাই) নিউইয়র্ক থেকে টেলিফোনে একবার বলেছিলেন। সিনেমাটা জাপানি। কুরোসাওয়ার দুটো ডিভিডি নিয়ে ডেস্কে বসা মেয়েটির কাছে গেলাম। চেহারা দেখেই মনে হলো একে জিজ্ঞেস করা যায়।
মেয়েটিকে বললাম, ‘টোকিও স্টোরি সিনেমাটা কি আছে তোমাদের কাছে?’
কুরোসাওয়া হাতে আর জানতে চাইছি আরেক জাপানি সিনেমার খবর! মেয়েটির মুখ নম্র হাসিতে উজ্জ্বল হলো। পরিচালক ওজো ( Yasujiro Ozu) ১৯৫৩ সালে টোকিও স্টোরি সিনেমা তৈরি করেন। যার বিষয়বস্তু এমন যে এখনো এটি ক্লাসিক সিনেমা হিসেবে আলোচিত হয়। মেয়েটি মহা উৎসাহে ওজোর দুটি সিনেমাও আমাকে খুঁজে এনে দিল। তারপর সে আমাকে হঠাৎই প্রশ্ন করল, ‘বাই এনি চান্স তুমি কি বেঙ্গলের...।’
‘হ্যাঁ, আমি বাঙালি।’
মেয়েটি কুরোসাওয়ার সেভেন সামুরাই হাতে নিয়ে বলল, ‘এর সঙ্গে বেঙ্গলি রে-র খুব বন্ধুত্ব ছিল।’
‘হ্যাঁ, আমি জানি। তবে সত্যজিৎ রায়ের কোনো মুভি তো তোমাদের এখানে দেখছি না।’
‘ইয়েস উই হ্যাভ।’ বলেই মেয়েটি একছুটে গিয়ে পথের পাঁচালির ডিভিডি নিয়ে আসল। আমি অবাক। আনন্দও হলো ভীষণ। পথের পাঁচালি আমি অনেক দিন ধরে খুঁজছিলাম, কিন্তু কোথাও ভালো প্রিণ্ট পাইনি। সবচেয়ে ভালো যা, তা হলো লাইব্রেরির সংগ্রহে যে মুভিগুলো থাকে সেগুলোর প্রিণ্ট খুব ভালো হয়।
‘রে-র পাতের পানচালি আমার যেকোনো সময় বসে দেখতে ভালো লাগে। কুরোসাওয়া বলেছেন, পৃথিবীতে বাস করে সত্যজিৎ রায়ের ছবি না দেখা চন্দ্র–সূর্য না দেখার শামিল,’ মেয়েটি বলল।
হ্যাঁ, আর কুরোসাওয়া সম্পর্কে চলচ্চিত্রবোদ্ধারা বলেন, কেউ যদি একটা এশিয়ার সিনেমাও দেখে তার ‘সেভেন সামুরাই’ দেখা উচিত।
‘আমি জাপানি।’
‘বাহ, খুব ভালো লাগছে তোমার সঙ্গে পরিচয় হয়ে।’
ইয়োশকা আমাদের পাড়ার পাঠাগারের একজন কর্মী। ওর বুকে নেমকার্ডে যদিও ইংরেজিতে লেখা রয়েছে Yasuka, তবে দেখলাম সবাই ওকে ডাকছে ইয়োশকা বলে।
ওর সিনেমা সম্পর্কে তথ্যভান্ডার খুব ঋদ্ধ। ওর সাহায্যে অসাধারণ সব সিনেমা দেখার সুযোগ হলো আমার। ইতালিতে বসবাসকারী ইরানিয়ান চলচ্চিত্র পরিচালক আব্বাস কিয়োরস্তামীর (উচ্চপ্রশংসিত টেস্ট অব চেরির নির্মাতা) ‘সার্টিফাইড কপি’ দেখে স্তব্ধ হয়ে একা একা বসে ভাবতে হবে।
টোকিও স্টোরি অনিন্দ্য সুন্দর একটি সিনেমা, যার আবেদন সর্বজনীন ও চিরায়ত। ছবিতে বিবৃত বাস্তবতা মানুষকে ব্যথিত করে। ব্যস্ত আধুনিক শহর টোকিওর জীবন। অল্পদিনের জন্য দূর থেকে বেড়াতে আসা মা-বাবাকে আন্তরিক আতিথ্যে গ্রহণ করার সময় হয় না সন্তানদের। ব্যতিক্রম শুধু ওই দম্পতির যুদ্ধে নিহত পুত্রের বিধবা বউটি।
ইয়োশকার মতো স্নিগ্ধ রুচি, উদার চোখে অন্যের ভালো গুণ পর্যবেক্ষণ করার মতো মন খুব কম মানুষের আছে। সবচেয়ে বড় কথা, ও নিজের কাজকে খুব ভালোবাসে। মানুষ যখন ভালো লাগা নিয়ে কাজ করে, তখন তাতে আলাদা এক মাধুর্য যোগ হয়।
আমাদের পাড়ার পাঠাগারে ইয়োশকা আছে বলেই ওর আন্তরিক প্রচেষ্টা ও উদ্যোগের কারণে জানলাম মেলবোর্ন শহরের কোন পাঠাগার ও গ্রন্থাগারে বাংলা বই আছে। আর কোন পাঠাগারে সত্যজিৎ রায়ের সমস্ত মুভির সংগ্রহ রয়েছে।
অনেক বই, সিনেমা অন্য পাঠাগার থেকেও ইয়োশকা আনিয়ে দিয়েছে। ও সত্যজিতের সিনেমা, পাবলো নেরুদার কবিতা পছন্দ করে। সত্যজিৎ রায়, আকিরা কুরোসাওয়া ও পাবলো নেরুদার মতো মানুষেরাই দেশ-জাতি ও রাষ্ট্রের সীমানা ছাড়িয়ে বহু বহু দূরে ছড়িয়ে পড়েছেন। তাই মেলবোর্নের ছোট্ট এক পাড়ার পাঠাগারের জাপানি কর্মী বাংলাভাষী একজনকে উৎসাহ নিয়ে তাদের কথা বলে নিজেও তাদের গল্প শুনি সমান আগ্রহ নিয়ে। চমৎকার সব মানুষের জন্যই আশ্চর্য ঐশ্বর্যময় এই সব ব্যক্তিত্ব তাঁদের সৃজনশীলতার সাঁঝি নিয়ে অপেক্ষায়।
আমাদের মতো সীমিত সম্পদের দেশেও সুপরিকল্পনা থাকলে ছোটখাটো পাড়াভিত্তিক পাঠাগার অবশ্যই গড়া যেত। সেখানে বাচ্চাদের জন্য এখানকার পাঠাগারের ‘স্টোরি টাইমের’ মতো ‘এসো বস গল্প শোন’ কর্মসূচি কি চালু করা যেত না? বাংলাদেশে অবশ্য সর্বজন শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ তাঁর বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের মাধ্যমে ঢাকা শহরের (আমার দেখা অনুযায়ী) অনেক স্কুলে ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরিতে বই পাঠিয়ে বাচ্চাদের বই পড়ার মতো আনন্দময় কাজে উৎসাহিত করে আলোকিত হতে উদ্দীপ্ত করছেন। এই উদ্যোগ আরও ছড়িয়ে দেওয়া প্রয়োজন।
দিলরুবা শাহানা
মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া