বাংলাদেশের আগ্রহ যে কারণে

ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে বড়দিনের উৎসব। উৎসব উপলক্ষে সাজ সাজ রব পড়ে যাওয়ার সময় হয়েছে। কোথাও কোথাও উৎসবের প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে। উৎসব হবে নিউইয়র্ক, পেনসিলভানিয়া, মিশিগান, টরন্টো, প্যারিস, রোম, বন, লন্ডন উৎসব নিয়ে ব্যস্ত আছেন টঙ্গী, বোর্ডবাজার, গাজীপুর, সাভার, নারায়ণগঞ্জ, পতেঙ্গা, কুমিরার তৈরি পোশাক শ্রমিকেরা। মহামারির শুরুর দিকে পোশাকের বৈশ্বিক ব্র্যান্ডগুলো বাংলাদেশে ৩০০ কোটি ডলারের বেশি মূল্যমানের পোশাকের ক্রয়াদেশ স্থগিত কিংবা বাতিল করে দিয়েছিল, যা ৪০ লাখ শ্রমিক ও হাজার হাজার কারখানাকে অনিশ্চয়তার মুখে ফেলে দেয়।

গ্রীষ্মের শুরুতেই ঝকঝকে রৌদ্রোজ্জ্বল দিন দেখে ‘করোনাবন্দী’ ইউরোপ–মার্কিনরা বাড়ি থেকে যখন বাইরে বেরিয়ে এল, ‘গ্রীষ্ম উৎসব’ শুরু হয়ে গেল এসব মহাদেশে। গ্রীষ্ম উৎসব কিংবা গ্রীষ্মের ছোটাছুটি মানেই অর্থনীতির চাকা সচল হওয়া আর এই চাকা যখন ঘুরতে থাকে, তখন সাতটি মহাদেশে চাকা ঘোরার শব্দ পাওয়া যায়। বাংলাদেশ থেকে সে আওয়াজ একটু বেশি করেই শোনা যায়। মার্চ থেকে মে মাস পর্যন্ত আমাদের তৈরি পোশাক শিল্প যে বিপন্ন সময় কাটিয়েছে, গ্রীষ্মের উজ্জ্বল রোদের ঝলক সেই বিষণ্নতাকে কাটাতে বেশি সময় নেয়নি। পোশাক শিল্পের নেতারা তাই বাংলাদেশের অর্থনীতির আকাশেও আলোর রেখা দেখতে পান।

আত্মবিশ্বাস নিয়ে তাঁরা ঘোষণা করেন, ‘এই মুহূর্তে আমরা বলতে পারি, তৈরি পোশাক শিল্প মার্চ-মে সময়ের খারাপ সময় কাটিয়ে আবার প্রবৃদ্ধির ধারায় ফিরে আসতে সক্ষম হয়েছে। পশ্চিমা দেশগুলোর অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে আমরা ক্রেতাদের সফলভাবে আলোচনার টেবিলে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছি। এ কারণেই বাতিল হওয়া ৩১৮ কোটি ডলারের ক্রয়াদেশের ৮০ থেকে ৯০ শতাংশই ফিরে পাওয়া গেছে।’ এই যে ক্রেতারা আলোচনার টেবিলে ফিরে এল, এর সঙ্গে প্রাণ ফিরে পেল বাংলাদেশের অর্থনীতিও।

সাত সমুদ্র, তেরো নদীর পারের উৎসব, যেখানে যেতে এক সময় জাহাজ ছাড়া আর কোন বিকল্প ছিল না। সেই উৎসব অসম্পূর্ণ থেকে যাবে, যদি বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাকের জাহাজ নোঙর না ফেলে ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্রের বন্দরে। শুধু কি পোশাক? পোশাক ছাড়াও বাংলাদেশ থেকে পাটজাত ওয়ালমার্ট, পাটের জুতা, ডাইনিং কাভার, বড়দিন উপলক্ষে ঘর ও অফিস সাজানোর অসংখ্য পণ্য না হলে উৎসবের অপূর্ণতা তো থেকেই যায়। পাটপণ্যের কাঁচামাল হলো প্রকৃতি থেকে প্রাপ্ত উপাদান; সারা পৃথিবীতে যখন সবুজ অর্থনীতিকে জাগিয়ে তোলার স্লোগান, আমাদের পাটপণ্য সেই আন্দোলনকে গতিশীল করতে সহায়তা করছে। এ ছাড়া অর্থনীতির পালে হাওয়া লাগাচ্ছে দ্রুত আমাদের ঐতিহ্যবাহী, সম্ভাবনাময় এই রপ্তানি খাত।

এই যে এক দেশ আর এক দেশকে উৎসবের ও স্বাভাবিক জীবনের পূর্ণতা প্রাপ্তিতে সহায়তা করে, এ কারণেই পৃথিবীটা প্রকৃত অর্থে একটি ভূগ্রামে রূপান্তরিত হয়ে পড়েছে। প্রযুক্তির জাদুকরী উন্নয়ন, শিল্প উন্নয়ন, পণ্য ও সেবা খাতে সহযোগিতা, পৃথিবীর দেশগুলোকে এত কাছাকাছি নিয়ে এসেছে যে, একটি গ্রামের অধিবাসীরা যেমন এককালে পারস্পরিক সহযোগিতা নিয়ে বেঁচে থাকত, পৃথিবীর দেশগুলোকেও এখন একইভাবে পারস্পরিক সহযোগিতা নিয়ে বেঁচে থাকতে হয়। কোন দেশ, অন্য আর একটি দেশকে এখন খুব সহজে এড়িয়ে চলতে পারে না। এ কারণেই আগামী ৩ নভেম্বর মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রতি পৃথিবীর অনেক দেশের মতো বাংলাদেশের মানুষেরও আছে বিপুল আগ্রহ ও সতর্ক দৃষ্টি। এই বিশ্বপরিবার বা ভূগ্রামের অধিবাসী হিসেবে নানা স্বার্থের কারণে আমাদের দৃষ্টিও প্রসারিত করে রাখতে হয় মার্কিন নির্বাচনের দিকে।

মার্কিন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আমার ধারণা, অনেক ভালো ভালো কাজ হচ্ছে, অনেক মানবিক ও গণতান্ত্রিক প্রতিশ্রুতি দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু দূর দেশ থেকে আমরা শুধু নেতিবাচক সংবাদই ক্রমাগত পেয়ে যাচ্ছি। এটা সংবাদমাধ্যমের অর্ধেক গ্লাস পানির খালি অংশের প্রতি অধিক দৃষ্টি নিক্ষেপের কারণে ঘটছে কিনা, বুঝতে পারছি না। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যখন বলেন, নির্বাচনের ফল দেখেই বলতে পারবেন যে, ক্ষমতা ছাড়বেন কি না। মার্কিন মানুষের মতো বাংলাদেশের জনগণও নড়েচড়ে ওঠেন। যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র চর্চার বয়স, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি শ্রদ্ধার কারণে দেশটির রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রতি এক ধরনের শ্রদ্ধা মিশ্রিত সমীহ আছে বাংলাদেশের মানুষের। এই শ্রদ্ধার ভীত একটু নড়বড়ে হয়ে যায়, ২৯ সেপ্টেম্বর প্রথম প্রেসিডেনশিয়াল বিতর্কে দুজন প্রার্থীর পরস্পরকে বিদ্রূপ ও ব্যক্তিগত আক্রমণ করা দেখে। হিংসাত্মক বিতর্ক ও আক্রমণাত্মক মনোভঙ্গির কারণে শেষ পর্যন্ত নব্বই মিনিটের বিতর্কে প্রার্থীরা নিজেদের পরিকল্পিত কর্মসূচি ও করণীয়গুলো ব্যাখ্যা করতে ব্যর্থ হন। বাংলাদেশের মানুষ বড়মাপের কোন গুণগত পার্থক্য খুঁজে পায় না, বিতর্কে প্রার্থীদের আচরণ ও আলোচনার ধরন প্রত্যক্ষ করে। তবে ২২ অক্টোবর বিতর্ক ছিল অনেক সংযমী। শেষ বিতর্কে ট্রাম্প ও বাইডেন যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর ব্যক্তিত্বের কিছুটা আভা দেখাতে সক্ষম হন ভোটারদের।

যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনকে ঘিরে আমাদের এত আগ্রহ কেন? আগ্রহের অনেক যুক্তিসংগত কারণ রয়েছে। করোনাকালে যেখানে বিশ্বের অধিকাংশ দেশের প্রবৃদ্ধি ক্রমাগতভাবে নিচে নেমে যাচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশ তার প্রবৃদ্ধির গতি ধরে রেখেছে। এ খবর সম্প্রতি এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল ও ওয়াশিংটন পোস্টের মতো সংবাদপত্র তাদের প্রতিবেদন ও মতামতের মাধ্যমে সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরেছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি মহামারি কাটিয়ে বাংলাদেশকে ঘুরে দাঁড়ানোর সুস্পষ্ট ইঙ্গিত দিচ্ছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে আশা দেখাচ্ছে মূল রপ্তানি পণ্য পোশাক খাত ও প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স। পোশাক রপ্তানি থেকে বাংলাদেশ বছরে প্রায় ৩ হাজার ৫০০ কোটি ডলার আয় করে। আর এই পোশাকের বেশির ভাগই যায় যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে।

শুধু কি পোশাক? আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ, যে রিজার্ভ করোনাকালেও ফুলে ফেঁপে উঠেছে, তার একটা বড় অঙ্ক আসছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। বাংলাদেশের অর্থনীতি এই মুহূর্তে যে দুটি খাত থেকে শক্তি সঞ্চয় করছে, সে দুটি খাতের সংকোচন ও প্রসারণের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের রসায়নের সংকোচন ও প্রসারণ ওতপ্রোতভাবে যুক্ত হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া এই মুহূর্তে প্রায় ছয়, সাত লাখ বাংলাদেশি যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে অভিবাসী হিসেবে বসবাস করছেন, তাঁরা যাতে নাগরিক হিসেবে সমঅধিকার ভোগ করতে পারেন, তাঁদের চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্র যাতে প্রসারিত হয়, তাদের বসবাস যেন নিরাপদ হয়, এটিও পরবর্তী প্রেসিডেন্টের নীতি ও মনোভাবের ওপর নির্ভর করছে। অভিবাসী, অভিবাসন আইন, বাণিজ্য, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ও করোনাত্তোর পৃথিবীতে চীনকে কেন্দ্র করে বিশ্ব রাজনীতিতে সম্পর্কের যে মেরুকরণ ঘটতে যাচ্ছে, সে মেরুকরণ বাংলাদেশের সুবিধাজনক অবস্থানের জন্যও আমাদের চোখ রাখতে হয় নভেম্বরের নির্বাচনের দিকে।

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশের নদী ও সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকায় ভূমির প্রকৃতি পরিবর্তন, নদীভাঙন এ সময় বিষয়ের ওপর ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের অস্তিত্ব নির্ভর করছে। আমরা চাই, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জলবায়ুকে একটি বড় ইস্যু হিসেবে গুরুত্ব দিয়ে প্রয়োজনীয় অভিযোজন প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশকে যেন সহায়তা দেন। করোনার ভ্যাকসিন যেন বাংলাদেশের কাছে সহজলভ্য হয়, এ ব্যাপারে একজন উদার ও গণতান্ত্রিক প্রেসিডেন্ট হিসেবে আমরা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টকে বাংলাদেশের সঙ্গে দেখতে চাই।

যুক্তরাষ্ট্রের সমাজে বর্ণবাদের উত্থানও আমাদের আসন্ন নির্বাচনের প্রতি মনোযোগী করে তুলেছে। বর্ণবাদ এত গভীরভাবে প্রোথিত হয়েছে যে, উদারনৈতিক দল ডেমোক্রেটিক দলের নেতা জো বাইডেনকেও মানুষ তাদের নেতা হিসেবে ভাবতে পারছেন না। এই যে মানুষ উদার, গণতান্ত্রিক, বর্ণবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী নেতা হিসেবে কাউকে তেমন গ্রহণযোগ্য হিসেবে বিবেচনা করছে না, তা শুধু মার্কিনদের জন্য অশনিসংকেত নয়, এটি সারা বিশ্বের মানুষের জন্যও সতর্ক সংকেতের মতো। এ সময় মানুষ প্রত্যাশা করে, মার্টিন লুথার কিং কিংবা আব্রাহাম লিংকনের মতো উদারনৈতিক, প্রকৃত গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের পূজারি কোন নেতার।

তারপরও বাস্তবতা হলো, যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে মুখোমুখি রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জো বাইডেন। আমরা আমাদের স্বার্থ ও বিশ্ব রাজনীতির স্বার্থে চাই ‘মন্দের ভালো’ প্রার্থী যাতে নির্বাচিত হন। যিনি এখন মেঠো বক্তৃতায় অনেক অসংলগ্ন কথা হয়তো বলছেন, কিন্তু নির্বাচিত হওয়ার পর চরম দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেবেন। উদার গণতন্ত্রের অনুসারী, মানবাধিকার রক্ষাকারী, অভিবাসীদের প্রতি মানবিক ও গণতান্ত্রিক আচরণের পক্ষপাতি—এমন একজন মার্কিন প্রেসিডেন্ট যিনি বাংলাদেশকে সম্মান করবেন এবং বিশ্ব রাজনীতিকে উদার ও প্রগতিশীলতার দিকে নিয়ে যাবেন। বাংলাদেশের মতো উদীয়মান অর্থনীতিকে এগিয়ে নেওয়ার মানসিকতাসম্পন্ন মার্কিন প্রেসিডেন্টই বাংলাদেশের প্রকৃত বন্ধুরূপে দেখা দিতে পারেন। কারণ, করোনাত্তোর মেরুকরণের সময় বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান, বিশ্বরাজনীতির মাঠে বাংলাদেশকে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্টেকহোল্ডারে পরিণত করতে পারে। আমরা চাই, কল্যাণমুখী রাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধু হবে সমমর্যাদার আরেকটি কল্যাণমুখী রাষ্ট্র বাংলাদেশ।