বাংলাদেশে শিক্ষার অবক্ষয়
আমি তখন সবে হাইস্কুলে যেতে শুরু করেছি। ভেতরে এক অন্যরকম অনুভূতি। বেশ বড় বড় ভাব। আবার বড় ভাইদের এসএসসি পরীক্ষার কথা শুনে বুকের মধ্যে ধুঁক ধুঁক করে। তখন প্রাথমিকে বোর্ড পরীক্ষা ছিল না। তাই বোর্ড পরীক্ষা কী জিনিস জানা নেই। তবে সেটা যে ভীষণ কঠিন কিছু তা আঁচ করতে পারতাম এসএসসি পরীক্ষা দেখে। এসএসসি পরীক্ষার সময় পরীক্ষার্থীর সঙ্গে এক-দুজন যেতেন সহযোগী হিসেবে। শুনতাম দিনে দুটি পরীক্ষা হয়। পরীক্ষার মাঝের সময়ে পরীক্ষার্থীকে খাবার ও পানিসহ নকল সরবরাহের দায়িত্ব ওই সহযোগীদের। খাবার ও পানি সরবরাহ বুঝলেও নকল কী জিনিস বুঝতে সময় লেগেছে আরও কয়েক বছর।
একবার এসএসসি পরীক্ষার সময় আমাদের এলাকার পরীক্ষাকেন্দ্রের কাছে পুলিশের গুলিতে মারা যান পাশের গ্রামের এক বড় ভাই। তিনি পরীক্ষার্থী ছিলেন না। প্রথমে শোনা গিয়েছিল তিনি নকল সরবরাহ করতে গিয়ে গুলি খেয়েছেন। পরে জানা গেল তিনি পরীক্ষাকেন্দ্র থেকে দূরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। পুলিশ নকল সরবরাহকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে গুলি ছোড়ে। সেই গুলিতে নিহত হন মেধাবী সেই বড় ভাই। এলাকায় শোকের ছায়া নামে। ট্রাক ভর্তি পুলিশ এসে তার লাশ দাফন করে যায়।
পরবর্তীতে পরীক্ষা পদ্ধতি বদলাতে শুরু করে এবং পরীক্ষায় ডিজিটাল ব্যবস্থার সন্নিবেশ হয়। এক দিনে আর দুটো পরীক্ষাও হয় না। তাই পরীক্ষার্থীর সঙ্গে সহযোগীরও দরকার পড়ে না। এ ছাড়া এসএসসি পরীক্ষার আগে যুক্ত হয়েছে আরও দুটি বোর্ড পরীক্ষা। পঞ্চম শ্রেণিতে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী ও অষ্টম শ্রেণিতে জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা। কোমলমতি ছেলেমেয়েদের এসএসসি পরীক্ষার আগেই আরও দুটি পরীক্ষা দিয়ে তাদের সাহসী করার প্রচেষ্টা।
এটা হয়তো ভালোর জন্যই করা হয়েছিল। কিন্তু কথায় আছে ভালো সময় খুব দ্রুত শেষ হয়। আমাদের এই পরীক্ষা ব্যবস্থার সুদিনও তাড়াতাড়ি শেষ হলো। পরীক্ষার্থীদের এখন আর সাজেশন দেখে উত্তর নকল করে অনেক কষ্টে লুকিয়ে পরীক্ষার হলে গিয়ে কমন না পড়ায় পস্তাতে হয় না। পরীক্ষার আগেই প্রশ্ন পেয়ে উত্তর রেডি করে তারপর পরীক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা তারা পেয়েছে। আহ কী সুন্দর ব্যবস্থা। অবশ্য এই ব্যবস্থা সবার জন্য নয়। যাদের টাকা আছে, যোগাযোগ আছে এবং নৈতিকতার বালাই নেই শুধু তাদের সন্তানই এই সুবিধা ভোগ করতে পারে। এরা পরীক্ষায় এই পদ্ধতি অবলম্বন করে হয়তো জিপিএ ৫ পায়, আবার সেই পদ্ধতি অবলম্বন করে নামি কোনো বিশ্ববিদ্যালয় বা মেডিকেলে ভর্তি হয়। দিন শেষে মোটা অঙ্কের তোফা দিয়ে বা মামার জোরে চাকরি নামক সোনার হরিণ শিকার করতেও তাদের সমস্যা হয় না।
বলা হয়ে থাকে কোনো জাতিকে ধ্বংস করতে হলে তার শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস করলেই বাকি সব এমনিতেই ধ্বংস হয়ে যায়। এরপর সেই জাতিকে ধ্বংস করার জন্য কোনো আণবিক বোমার দরকার হয় না। পরীক্ষা শুরু হলে পত্রিকার পাতা আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যে খবর বের হয় তা থেকেই অনুমান করা সম্ভব আমরা ধ্বংসের কত কাছে দাঁড়িয়ে আছি। কিছু অসৎ মানুষ আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে আজ ধ্বংসের কিনারে দাঁড় করিয়েছে। আমরা সমস্যা স্বীকার না করে সমস্যা মোকাবিলা করিনি বলে সমস্যা বাড়ছে। যথেষ্ট দেরি হলেও সময় শেষ হয়ে যায়নি। জাতিকে রক্ষা করতে হলে এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে, আর একটি নকলও নয়, পরীক্ষা হবে সম্পূর্ণ নকল মুক্ত।
মুরাদুল ইসলাম: সান পাবলো সিটি, ফিলিপাইন।