বাংলাদেশকে করোনা টিকা দেওয়া নিয়ে সিডনিতে উদ্যোগ
অস্ট্রেলিয়ার উদ্বৃত্ত অ্যাস্ট্রাজেনেকার করোনার টিকা বাংলাদেশ যেন পেতে পারে, এ নিয়ে সিডনিতে শুরু হয়েছে প্রবাসী বাংলাদেশিদের বহু পাল্টাপাল্টি উদ্যোগ। এই উদ্যোগের শুরু অনেক আগ থেকে। তবে এখন বহু আয়োজনের কারণে কিছুটা ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী বাংলাদশিসহ অনেকের মনে।
বাংলাদেশকে টিকা প্রদানের বিষয়ে গত এপ্রিল মাস থেকে কাজ করছে বাংলাদেশ হাইকমিশন। এ ছাড়া দেশটির বিভিন্ন রাজ্যের প্রবাসী বাংলাদেশি চিকিৎসকদের সংগঠনসহ বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে টেলিফোন, চিঠি, ই-বার্তা, ই-পিটিশন, অনলাইনে সভা, আলোচনা, মন্ত্রীর সঙ্গে একান্ত বৈঠক ও সামজিক যোগাযোগমাধ্যমে উদ্বেগ প্রকাশ করে যাচ্ছেন নিয়মিত।
তবে সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী বাংলাদেশি চিকিৎসক আয়াজ চৌধুরীর অস্ট্রেলিয়ার সংসদে ‘বাংলাদেশে অ্যাস্ট্রাজেনেকার উদ্বৃত্ত ভ্যাকসিন দেওয়ার জন্য মানবিক আবেদন’–এর ই-পিটিশন আলোচনায় আসে। এই ই-পিটিশনে ১০ হাজার স্বাক্ষর গ্রহণের উদ্দেশ্যে কাজ করছেন তিনি। ইতিমধ্যে আজ পর্যন্ত ৪ হাজার ৮৭০টি স্বাক্ষর দিয়েছেন অস্ট্রেলিয়ায় বসবাসরত বাংলাদেশিরা। অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক কিংবা স্থায়ী বাসিন্দা এমন যেকোনো ব্যক্তিই সরকারি ওয়েবসাইটের মাধ্যেম এই ই-পিটিশন চালু করতে পারেন। বর্তমানে এমন ৫৭টি ই-পিটিশন চালু রয়েছে। স্বাক্ষরগ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে দুই হাজারের বেশি ই-পিটিশনে। যথেষ্ট স্বাক্ষর জমা পড়লে আবেদনটি অস্ট্রেলিয়ার সংসদে আলোচনা হতে পারে এবং বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হলে পরবর্তী পদক্ষেপও নিতে পারে দেশটির সরকার।
এদিকে সিডনির বাংলা সংবাদপত্র মুক্তমঞ্চ অনলাইনে ‘কোভিডে আক্রান্ত বাংলাদেশ ও আমাদের করণীয়’ শীর্ষক এক বৈঠকের আয়োজন করে ২৪ জুলাই। বৈঠকে অস্ট্রেলিয়াসহ বাংলাদেশের নানা সংগঠনের প্রতিনিধি ও বিশেষজ্ঞরা মতবিনিময় করেন। আলোচনায় সবাই বাংলাদেশকে যেকোনো উপায়ে করোনার এই দুঃসময়ে সহায়তা করার পক্ষে অবস্থান নেন। বৈঠকে অন্যান্যের পাশাপাশি বাংলাদেশের করোনাভাইরাস জাতীয় পরামর্শক কমিটির সদস্য ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা চিকিৎসা পরিষদের (স্বাচিপ) সভাপতি এম ইকবাল আর্সলান অংশ নেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশ সরকার বিদেশি উপহারের জন্য বসে নেই। বাংলাদেশ পৃথিবীর প্রায় সব কটি টিকা প্রস্তুতকারক দেশের সঙ্গে কথা বলেছে এবং কিনছে। টিকা দেওয়ার কার্যক্রম শুরু করার প্রথম কয়েকটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ একটি। এই টিকা কার্যক্রম এখনো সারা দেশব্যাপী চলমান। দেশের ১৭ কোটি লোকজনের জন্য টিকা সরবরাহ নিশ্চিত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী এবং প্রতি সপ্তাহে টিকা আসছে বিভিন্ন দেশ থেকে। অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসীদের কাছে বিশেষ অনুরোধ ক্রেডিট বায়িংয়ের লড়াই বাদ দিয়ে অস্ট্রেলিয়ার অ্যাস্ট্রাজেনেকা টিকা উপহার হলে ভালো, তার চেয়ে বাংলাদেশের কাছে যেন বিক্রি করে—এ ব্যাপারে আপনারা উদ্যোগ নিন। কারণ. অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা বাংলাদেশের আবহাওয়া ও টিকা সংরক্ষণের তাপমাত্রার ক্ষেত্রে সহজ।
অন্যদিকে, অস্ট্রেলিয়ার নাগরিকদের মধ্যে অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা গ্রহণ নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। সরকারি তথ্য মতে, গতকাল পর্যন্ত দেশটির টিকা দেওয়া হয়েছে ১ কোটি ১৪ লাখ ডোজ। তবে সম্পূর্ণ টিকা গ্রহণ করেছেন সাড়ে ৩৪ লাখ বাসিন্দা যা দেশটির বাসিন্দাদের মাত্র ১৩ দশমিক ৬ শতাংশ। এদিকে অস্ট্রেলিয়ায় মজুত বিপুল পরিমাণ অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা দেশটি তার পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে বিতরণ করছে।
ইতিমধ্যে তিন লাখ টিকা বিতরণ করেছে অস্ট্রেলিয়া। শিগগিরিই ইন্দোনেশিয়াসহ বেশ কয়েকটি রাষ্ট্রে প্রায় দুই কোটি টিকা বিতরণের ঘোষণা দিয়েছে অস্ট্রেলিয়া। আর এ নিয়েই অস্ট্রেলিয়া সরকারের কাছে বাংলাদেশকেও টিকা প্রদানের মানবিক আবেদনসহ বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন দেশটির প্রবাসী বাংলাদেশিরা।
অস্ট্রেলিয়া বাংলাদেশকে টিকা দিতে পারে, তবে না দেওয়ার সম্ভাবনাই বেশি—এমন মতের দোলাচল রয়েছে প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে। কারণ হিসেবে অনেকেই বলছেন, অস্ট্রেলিয়ার এখন পর্যন্ত যে মনোভাব, তাতে দেশটির প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোকেই টিকা অনুদান করবে। এর মধ্যে দেশটির প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে পাঠানো এক চিঠির উত্তরে বলা হয়েছে, বাংলাদেশকে কোভিড-১৯ সহায়তা হিসেবে ইতিমধ্যে ৫০ লাখ অস্ট্রেলীয় ডলার প্রদান করা হয়েছে। পরবর্তী সময়ে কোনো সহযোগিতা কোয়াড জোটের নেতৃত্বে দেওয়া হবে বলেও জানানো হয়েছে। তবে গতকাল অস্ট্রেলিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেরিস পেইন বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য কিছু টিকা অনুদান হিসেবে দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন বলে সিডনির স্থানীয় কিছু নিউজ পোর্টালে খবর বেরিয়েছে।
তারপরও বিষয়টি নিয়ে ধোঁয়াশা এবং পাল্টা মন্তব্য রয়েছে। পিটিশন কিংবা যোগাযোগমাধ্যমে অস্ট্রেলিয়া সরকারের মনোভাব পরিবর্তন হতে পারে—এর পক্ষে ও বিপক্ষে মত রয়েছে বিভিন্ন জনের। তবে বেশির ভাগই সাধুবাদ জানাচ্ছেন পিটিশন এবং অন্যান্য মাধ্যমে টিকা পাওয়ার চেষ্টাটিকে। তাঁরা বলছেন, যদি সুফল পাওয়া যায়, তবে সেটি বাংলাদেশের জন্য লাভজনক হবে। পাশাপাশি এমন মন্তব্যও রয়েছে যে মানবিক আবেদন করে টিকা নেওয়ার মতো অবস্থানে এখন আর নেই বাংলাদেশ।
নিজেদের টিকা ক্রয়ের মতো স্বয়ংসম্পূর্ণতা খুব ভালো মতোই রয়েছে বাংলাদেশের।
এ ছাড়া একটি বিশ্বস্ত কূটনৈতিক সূত্র নিশ্চিত করেছে, ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলগত জোট বা কোয়াডের কারণে চীন এবং অস্ট্রেলিয়ার বৈরী সম্পর্কের এ সময়ে অস্ট্রেলিয়া থেকে টিকা নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের কোনো উৎসাহ নেই।
এ বিষয়ে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে অবস্থিত রয়্যাল মেলবোর্ন ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (আরএমআইটি) বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শামস রহমান বলেন, এ মুহূর্তে বাংলাদেশ হাইকমিশনকে সমন্বয়ক হিসেবে ধরে সবাইকে একত্র হয়ে বাংলাদেশের জন্য কাজ করা উচিত। অস্ট্রেলিয়ার অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা বাংলাদেশের জন্য ভালো। সুতরাং এই টিকা নেওয়ার ব্যাপারে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আরও জোরদার কাজ করতে পারে।
বাংলাদেশকে টিকা প্রদানের বিষয়ে গত এপ্রিল মাস থেকে কাজ করছে বাংলাদেশ হাইকমিশন। অন্যান্য কূটনৈতিক বিষয়ের পাশাপাশি টিকা প্রদানের বিষয়েও নানান বৈঠকে অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে আলোচনা চলছে বলে জানান অস্ট্রেলিয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার মোহাম্মদ সুফিউর রহমান। এই প্রতিবেদককে তিনি জানান, ‘দুই দেশের মধ্যে যে সম্পর্ক রয়েছে, এতে আমরা যেমন টিকা পাওয়ার আশা করতে পারি। তেমনি অস্ট্রেলিয়া তার প্রতিবেশী দেশগুলোকেই আগে টিকা দেবে, এটাও স্বাভাবিক। আর অস্ট্রেলিয়া সেটাই করছে। পাশাপাশি অস্ট্রেলিয়া বিভিন্ন দ্বীপ রাষ্ট্রগুলোকেও আগে টিকা দেবে বলে ধারণা রয়েছে। তবে বাংলাদেশের হাইকমিশনের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হচ্ছে। এমনকি গত ৩১ মে দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী টেলিফোনে আলোচনা করেছেন এবং টিকার বিষয়েও কথা হয়েছে। তবে অস্ট্রেলিয়ার মনোভাব পরিবর্তনে প্রবাসী বাংলাদশিরা ভূমিকা রাখতে পারেন। এতে এবার কিছু না হলেও পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ অগ্রাধিকারে থাকবে।’