বাংলাদেশ ও আমেরিকায় কেমন সতর্কতা চাই

ডা. মাসুদ বক্স ও ড. হোসেন উদ্দিন শেখর।
ডা. মাসুদ বক্স ও ড. হোসেন উদ্দিন শেখর।

নতুন করোনাভাইরাস এক বিশ্বব্যাপী সংকটের নাম। আমরা যারা আমেরিকায় থাকি এমন সংকটে তাদের দুটি দেশ নিয়ে ভাবতে হয়—বাংলাদেশ ও আমেরিকা। আমি সে কারণেই দু দেশের দু বিশেষজ্ঞের সঙ্গে বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করে, করণীয় সম্পর্কে জানার চেষ্টা করেছি। তাঁদের সঙ্গে আলোচনায় চেষ্টা করেছি পুরো পরিস্থিতি সম্পর্কে জানার। একই সঙ্গে দুটি দেশেই সামনের দিনগুলোয় কী হতে পারে, সে বিষয়েও তাঁদের কাছ থেকে জানার চেষ্টা করেছি।
এ দুই বিশেষজ্ঞের একজন ভার্জিনিয়ার শ্যানানডোয়া মেমোরিয়াল হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক ডা. মাসুদ বক্স। তিনি দীর্ঘ দিন ধরে আমেরিকার বিভিন্ন হাসপাতালে জরুরি বিভাগে কাজ করে আসছেন। অন্যজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. হোসেন উদ্দিন শেখর। তিনি এই ভাইরাসের সংক্রমণ ও ব্যাধির কার্যকারণ বিষয়ে একজন বিশেষজ্ঞ। দুজনের কেউ কাউকে চেনেন না। একই প্রশ্ন আলাদাভাবে দুজনকেই করা হয়েছে। দুজনের উত্তর পাশাপাশি রাখলে অদ্ভুত মিল দেখা যাবে। অথচ পৃথিবীর দুই প্রান্তের দুটি দেশ। একটি প্রাচ্যের উন্নয়নশীল দেশ, অন্যটি পাশ্চাত্যের শীর্ষ উন্নত দেশ। সম্পূর্ণ ভিন্ন দুই প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে করোনা পরিস্থিতিকে দেখা ও এর করণীয় নিয়ে চিন্তা করা দুই গবেষকের দেওয়া বক্তব্য অনেকটাই কাছাকাছি। একটি বৈশ্বিক সংকট কীভাবে মানুষকে কাছাকাছি আনছে তা এর মধ্য দিয়েই স্পষ্ট হয়। করোনাভাইরাস কীভাবে তাদের সমস্যা ও সামধানগুলোকে এক সমান্তরালে এনেছে, তা দেখে আশ্চর্য হতে হয় বৈকি। তাঁদের উত্তরের মধ্যে জানার অনেক কিছু রয়েছে, শিক্ষণীয় অনেক কিছু রয়েছে। তাঁদের উত্তরগুলো খুবই বাস্তবসম্মত, দীর্ঘদিনের চর্চা ও দীর্ঘদিনের অধ্যয়নের ফসল বলেই মনে হয়েছে। শুধু সাম্প্রতিক সংবাদ দেখে বা সাম্প্রতিক আর্টিকেল পড়ে শেখা নয়। আশা করি পাঠকেরা সামান্য হলেও উপকৃত হবেন।
প্রশ্ন: কোভিড -১৯–এর জন্যে আপনার এলাকা যে লকডাউনে আছে, সেটা কতদিন থাকতে পারে, বা থাকা উচিত বলে আপনি মনে করছেন?
ডা. মাসুদ বক্স (আমেরিকা): আমাদের নর্দার্ন ভার্জিনিয়া, যার সঙ্গে আমাদের ওয়াশিংটন ডিসি ও মেরিল্যান্ডের অংশবিশেষ যুক্ত, সেখানে লকডাউন জুনের ১০ তারিখ পর্যন্ত ঘোষণা করা হয়েছে। এই ঘোষণা অবশ্য বেশ কয়েক সপ্তাহ আগে এসেছে। আমাদের এখানে যখন রোগটা পিকে (peak) উঠবেবে (অর্থাৎ সংক্ৰমণ শীর্ষ বিন্দুতে পৌঁছাবে), তখন আমরা জানতে পারব লকডাউন কবে তুলে নেওয়া যায়। আর পিক বোঝা যাবে নতুন রোগী আসা যখন কমতে থাকবে, তখন।
এখানে যখন লডাউন দেওয়া হয়, তখন প্রোজেকশন ছিল যে, মে মাসের মাঝামাঝি অথবা মে মাসের শেষে পিক হবে। খুব সম্ভবত আমরা এখনই (এপ্রিলের ২০) রোগ সংক্রমণের পিকে এসে গিয়েছি। আমার মনে হয় মে মাসের মাঝামাঝিতে আমরা শুধু কার্ভটা ফ্ল্যাট নয় (যখন আর বাড়বে না) বরং নিচের দিকে নামাতে পারব। তখন লকডাউন তুলে নেওয়া সম্ভব।
ড. হোসেন উদ্দিন শেখর (বাংলাদেশ): কোভিড -১৯–এর জন্যে সারা বাংলাদেশে লকডাউনের একটাই তারিখ, সেটা হলো এপ্রিলের ২৫ তারিখ। আরও বেশি দিন থাকা উচিত বলে আমি মনে করি। আরও ন্যূন্যতম তিন সপ্তাহ, আমার মতে মে মাসের ১৫ তারিখ পর্যন্ত লক ডাউন থাকা উচিত। যেহেতু বাংলাদেশে টেস্ট অপ্রতুল, কাজেই আমরা প্রকৃত সংখ্যা কত, সে বিষয়ে ধারণা পাচ্ছি না। আমার ধারণা এই রোগের পিকটা শুরু হবে দু–এক দিনের মধ্যেই এবং সেটা শেষ হবে মে মাসের মাঝামাঝি।
প্রশ্ন: কোভিড- ১৯ কি ল্যাবরেটরিতে বানানো?
ডা. মাসুদ বক্স (আমেরিকা): যেটা জানা গেছে যে, এক প্রজাতির বাদুড় থেকে এটা এসেছে, এবং উহানের যে সি–ফুড মার্কেট বা ওয়েট মার্কেট, সেখান থেকেই এসেছে এটা। করোনাভাইরাস যে বাদুড়ের মধ্যে আছে, সেটা অনেকদিন আগেই প্রমাণিত। কিন্তু কোভিড-১৯ ভাইরাস যে বাদুড় থেকেই সরাসরি এসেছে, সেটা এক কথায় প্রমাণ করা যাবে না। যতদূর মনে হয় সেটাই হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা তাই মনে করছেন।
ড. হোসেন উদ্দিন শেখর (বাংলাদেশ): এ নিয়ে মতভেদ রয়েছে। একটা হাইপোথিসিস বলছে চীনের ল্যাবরেটরিতে বানানো হয়েছে। নিশ্চিত করে বলা কঠিন। এই ভাইরাসটি একটু ভিন্ন রকমের। দুটি প্রাণী থেকে এসেছে, ৯৬% জিনোমিক সিকুয়েন্স মিল আছে ব্যাট ভাইরাসের সঙ্গে, আর ৪% মিল আছে আমরা যাকে বলি বনরুই, অথবা সাপের শরীরে থাকা ভাইরাসের সঙ্গে। ল্যাবরেটরির সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
প্রশ্ন: এর ভ্যাকসিন কবে আসতে পারে?
ডা. মাসুদ বক্স (আমেরিকা): ভ্যাকসিনের কাজ চলছে। কিন্তু খুব দ্রুতও যদি হয়, তাহলেও আমরা এখনো প্রায় আঠারো মাস দূরে আছি।
ড. হোসেন উদ্দিন শেখর (বাংলাদেশ): এই সম্পর্কেও সুনির্দিষ্টভাবে বলা যায় না। ভ্যাকসিন বা ওষুধ একটি সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। প্রথমে বিভিন্ন প্রাণীর ওপর প্রয়োগ করা হয় (laboratory animal), পরে ফেজ ওয়ান, টু, থ্রি ও ফোর—এমন চার পর্যায়ে হিউম্যান ট্রায়ালে যায়। সবগুলো ধাপ সফলভাবে পার হলেই তা বাজারে আসে।
প্রশ্ন: ওষুধ কবে আসতে পারে?
ডা. মাসুদ বক্স (আমেরিকা): নতুন ওষুধ কবে আসবে বলা মুশকিল। কিন্তু ইতিমধ্যেই যে ওষুধ বাজারে আছে, আমি কিন্তু হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইনের কথা বলছি না, অন্য দুটি অ্যান্টিভাইরাল খুব সম্ভাবনাময় মনে হচ্ছে। রেমডিসিভির (Remdesivir), যা ইবোলা ও হার্পসের চিকিৎসায় কাজে দিয়েছে, সেটার ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল এখন কিছু হাসপাতালে চলছে। অন্য একটি অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ, যা এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ইনফ্লুয়েঞ্জার চিকিৎসায় ব্যবহার হয়, ফেভিপিভির (Favipivir) এখন আমেরিকাতেও কোভিড -১৯–এর ওষুধ হিসেবে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে রয়েছে। হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন ও এজিথ্রোমাইসিন এক পরীক্ষায় গুরুতর অসুস্থ রোগীর ক্ষেত্রে কাজ করেছে বলে পাওয়া গেছে। আরেক পরীক্ষায় এর ফলাফল অনিশ্চিৎ (inconclusive) থেকে গেছে। আশা করা যায়, এক বছরের মধ্যে কোভিড-১৯ এর বেশ কিছু ভালো ওষুধ আমরা পেয়ে যাব।
ভ্যাকসিন আসার আগে ওষুধ চলে এলে লাভ হচ্ছে তখন আর রোগটি রোগীর শরীরে গুরুতর আকার ধারণের সুযোগ পাবে না। রোগের মেয়াদ কমে আসবে, হাসপাতালে মানুষ কম যাবে, আইসিইউ কম ব্যবহার হবে, ভ্যান্টিলেটর কম লাগবে, সর্বোপরি মৃত্যুর হার কমে যাবে।
ড. হোসেন উদ্দিন শেখর (বাংলাদেশ): জাপানের এভিগান নামে একটি ওষুধ ফেজ থ্রিতে আছে। সেটার সম্ভবনা আছে। (এই ওষুধটিই ফেভিপিভির, যার কথা আগের বিশেষজ্ঞও উল্লেখ করেছেন।)
এটি বাংলাদেশে বিকন ফার্মাসিউটিক্যালস জাপানের সহযোগিতায় তৈরি করছে বলে জেনেছি। এটি সীমিত আকারে কিছু হাসপাতালে দেওয়া হবে বলেও জেনেছি। দু–এক মাসের মধ্যেই এটি চলে আসতে পারে। তবে এটা যে অব্যার্থ ওষুধ হবে, তা বলা যাবে না। কারণ, এখনো ট্রায়াল শেষ হয়নি। আর ভ্যাকসিনের ব্যাপারে যদি নূন্যতম ধরি, তাহলে আগামী (২০২১) জুনের আগে আশা করা যায় না। তবে ওষুধ কিছুটা হলেও এই ব্যাধি নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করবে।
প্রশ্ন: এটা কত দূর যাবে বলে মনে হচ্ছে?
ডা. মাসুদ বক্স (আমেরিকা): এটা তো আসলে একটা ভবিষদ্বাণী। বিশেষজ্ঞদের হয়তো অনেক কিছু অনুমান করেই বলতে হয়। যেমন ২০০২ সালে আমাদের এখানে যে সার্স (SARS ) হলো, সেটা প্রথম বছর খুব গুরুতর হলো। তার পরের বছর তেমন কিছুই হলো না, কমে গেল। তার মানে এই না যে নভেল করোনাভাইরাস সেই একইভাবে আচরণ করবে। বলা খুবই মুশকিল।
ড. হোসেন উদ্দিন শেখর (বাংলাদেশ): এই কোভিড- ১৯ কে পৃথিবী থেকে সম্পূর্ণ নির্মূল করা যাবে কিনা, সেটা ভ্যাকসিন না পাওয়া পর্যন্ত বলা যাবে না। যত দিন পর্যন্ত ভ্যাকসিন না পাচ্ছি, তত দিন এটা থাকবে। ওষুধ দিয়ে এটাকে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে, নির্মূল করা যাবে না।
প্রশ্ন: হাসপাতালে কি দেখেছেন? কারা কোভিড - ১৯ –এ বেশি অসুস্থ হচ্ছেন ?
ডা. মাসুদ বক্স (আমেরিকা): আমি যে কমিউনিটির হাসপাতালে কাজ করি, আমার আশপাশের যে হাসপাতালগুলো আছে, তারপর আমাদের যে রেফারাল সেন্টার থেকে যা জানছি, যারা গুরতর লক্ষণ নিয়ে হাসপাতালে আসছে, আমরা শুধু তাঁদেরই টেস্ট করছি, চিকিৎসা দিচ্ছি। অন্যদের আছে কিনা, যেহেতু টেস্ট করা সম্ভব হচ্ছে না, কাজেই জানায় যাচ্ছে না। যারা হাসপাতালে আসছেন, তাঁদের সিংহভাগ বয়সে পঞ্চাশোর্ধ। দেখে মনে হচ্ছে, অনিয়ন্ত্রিত হাইপারটেনশন, ডায়াবেটিস, ক্রনিক লাং ডিজিজ যেমন সিওপিডি অথবা অ্যাজমার মতো রোগগুলো থাকলে রোগীর কমপ্লিকেশন্স বেশি হচ্ছে।
অন্যদিকে ডাক্তারদের, স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদেরও পর্যাপ্ত এন -৯৫ মাস্ক নেই। আমরা একই মাস্ক ডিজিনফেক্ট করে অনেক দিন পরছি। ছিঁড়ে গিয়ে ব্যবহারের অযোগ্য হলেই ফেলে দিচ্ছি। অনেক হাসপাতালে তো এন -৯৫ মাস্কই নেই। তারপর স্বাস্থ্যসেবায় যারা আছেন, তাঁরা কিন্তু রোগীর কাছাকাছি আসায় সাধারণ মানুষের থেকে আক্রান্ত হচ্ছেন বেশি।
ড. হোসেন উদ্দিন শেখর (বাংলাদেশ): হাসপাতালে বিভিন্ন বয়সের রোগীরা আসছেন। বাংলাদেশে দেখা যাচ্ছে ৪০–এর নিচের বয়সী রোগীরাই বেশি আসছেন। এর একটা কারণ হতে পারে, তারা লকডাউনে ঘরে থাকতে চায় না, বের হয়। কাজেই তারাই আক্রান্ত হয় বেশি। এখানে হাসপাতালে যেহেতু পিপিই, এন– ৯৫ মাস্ক অপ্রতুল, ডাক্তাররাই যেহেতু ফ্রন্ট লাইন ডিফেন্ডার, ইতিমধ্যেই ১০০ জন ডাক্তার কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়েছেন।
প্রশ্ন: টেস্ট করা কতটা জরুরি? আপনার এলাকায় টেস্টের সুবিধা কতটুকু?
ডা. মাসুদ বক্স (আমেরিকা): আগের চেয়ে টেস্টের পরিমাণ অনেক বেড়েছে, তবুও যথেষ্ট নয়। টেস্ট করার দুটো কারণ— একটা হচ্ছে ডায়াগোনস্টিক, রোগীকে টেস্ট করে জানব কোভিড -১৯ পজিটিভ কি না। আরেকটা হচ্ছে, অনেক বেশি মানুষকে টেস্ট করে দেখব, কমিউনিটিতে কীভাবে, কোন এজ গ্রুপে , কোন এলাকায় বেশি ছড়াচ্ছে। সেই তথ্য থেকে আমরা প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতে পারি, যেন এটা না ছড়ায়। সেখান থেকে জানা যাবে যে, কখন সামাজিক দূরত্বটা ধীরে ধীরে তুলে নেওয়ার সময় হবে। আমাদের তো অর্থনৈতিক কার্য্ক্রম এক সময় না একসময় খুলে দিতে হবে। সেটা করতে গেলে আমাদের জানতে হবে, রোগটা কমিউনিটির মধ্যে কমল, না এখনো বাড়ছে। সে জন্যে অনেক টেস্ট করার দরকার হবে। সেটা করার পর্যায়ে আমরা এখনো যেতে পারিনি। আমাদের এলাকায় সেই ব্যবস্থা নেই, এমনকি পুরো আমেরিকাতেও নেই।
ড. হোসেন উদ্দিন শেখর (বাংলাদেশ): টেস্ট করা অত্যন্ত জরুরি। যাদের রোগের লক্ষণ আছে, বিশেষত তাদের। টেস্ট খুব অপ্রতুল। ঢাকায় যদিও কিছু জায়গায় আছে, প্রত্যন্ত এলাকায় নেই বললেই চলে।
রিয়েলটাইম রিভার্স ট্রান্সক্রিপশন–পলিমারেজ চেইন রিয়েকশনের (আরটিপিসিআর) মাধ্যমে সরকারিভাবে টেস্ট করা হয়। যন্ত্রটি বেশ ব্যয়বহুল, ২৮–৩০ লাখ টাকা একটা যন্ত্রের দাম। সেট–আপসহ পঞ্চাশ লাখ টাকা লাগে। এই যন্ত্র সেভাবে আমাদের হাসপাতালগুলোতে নেই। আর এটা যদি সরবরাহও করা হয়, এর জন্য যে স্কিলড টেকনোলজিস্ট দরকার, তাও আমাদের নেই। কাজেই আরটিপিসিআরের মাধ্যমে টেস্ট আমাদের দেশে অপ্রতুল। তবে ক্যালিফোর্নিয়া, মালদ্বীপ, ভারতে যে কিট ব্যবহার করা হয়েছে, তার অনুমতির জন্য চেষ্টা করা হচ্ছে। এই কিটের একটা বড় সমস্যা হলো যে, রোগী যদি আক্রান্ত হয় , তবে পঞ্চম দিনের আগে এই কিট দিয়ে শনাক্ত করা যাবে না। অথচ রোগী কিন্তু প্রথম দিন থেকেই রোগ ছড়াচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অনুমতি না দেওয়ার এটা হয়তো প্রধান কারণ। অন্যদিকে আরটিপিসিআর টেস্ট প্রথম দিনেই রোগীকে শনাক্ত করা যাবে।
কিট-এ ব্লাডের মাধ্যমে টেস্ট করা হয়, আরটিপিসিআর ন্যাজাল সোয়াব দিয়ে করা হয়। একটা অ্যান্টিবডি থেকে, আরেকটাতে আরএনএ দিয়ে পরীক্ষা হয়। আরটিপিসিআরের জন্যে দক্ষ ট্যাকনোলজিস্ট দরকার। কারণ, অনেক ভেতর থেকে ভাইরাসটি সোয়াব দিয়ে আনতে হয়, সেটাতে ভুল হলে রেজাল্ট নেগেটিভ আসবে। এ ছাড়া, এর জন্য বিশেষ নিরাপদ ল্যাবরেটরি দরকার, যার বায়ো-সেফটি- লেভেল-২ (BSL -2) হতে হবে। কিট দিয়ে টেস্ট করা হলে অবশ্য এসব লাগছে না।
প্রশ্ন: আপনার এলাকার এই বাংলাদেশিদের জন্যে কোভিড - ১৯ সম্পর্কে কোনো পরামর্শ?
ডা. মাসুদ বক্স (আমেরিকা): বাংলাদেশিদের জন্যে প্রথম পরামর্শ আতঙ্কিত হবেন না। যদিও এটা গুরুতর অসুখ, কিন্তু শতকরা ৮০ ভাগ মানুষের জন্য এই রোগটা গুরুতর হয়ে দেখা দেবে না। কাজেই এটা নিয়ে আতঙ্কিত হবেন না।
যদি কারও টেস্টে রোগটি ধরা পড়ে , তবে ডাক্তাররা যেভাবে পরামর্শ দিচ্ছেন, যেমন আপনি সেলফ আইসোলেশনে যাবেন, সেগুলো অবশ্যই মানতে হবে। কারণ, এটা খুবই সংক্রামক একটি রোগ। যাদের পক্ষে সম্ভব, একটি আলাদা ঘরে, সম্পূর্ণভাবে আলাদা থাকতে হবে। না হলে পরিবারের সদস্যদের হবে। আরেকটা উপদেশ হলো, খুব প্রয়োজন না হলে বাইরে যাবেন না। গেলে মাস্ক পরে যাবেন। মাস্ক পরা মানে শুধ নিজেকে রক্ষা করা নয়, অন্যকেও, সমাজকেও রক্ষা করা। আমার হয়ে থাকলে যেন আমি এটা না ছড়াই। সবাই এই কথা মেনে চললে কিন্তু কেউ আর রোগটি ছড়াবে না। কাজেই অসুখটা কমে আসবে। বিধিসম্মতভাবে হাত ধোয়া এবং মুখে হাত না দেওয়া, এসব বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে।
আমরা এখন অনেকেই অনলাইনে বাজার করছি। বাজারটা ডেলিভারিম্যান দিয়ে যাওয়ার পর আমাদের সেটা ভেতরে আনার সময় সতর্ক থাকতে হবে। একেবারে যেসব কিছু ঘষেঘষে স্যানিটাইজ করা তো আর সম্ভব না। অন্তত যে ব্যাগে বা প্যাকেটে বাজার এসেছে, সেগুলো খুলে দ্রুত ফেলে দিতে হবে। তারপর আবার ২০ সেকেন্ড সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলতে হবেন। অর্থাৎ অনলাইন ডেলিভারি মানেই করোনামুক্ত নয়।
বাজারে যেসব মাস্ক পাওয়া যায়, সেসব পরলেই অনেকটা কাজে দেবে। একটা হাঁচি/কাশি দিলে মাস্ক আটকাচ্ছে। তবে এন–৯৫ বা সার্জিক্যাল গ্রেড মাস্ক সাধারণ মানুষের সংগ্রহ করা উচিত না। কারণ স্বাস্থ্যসেবায় যারা নিয়োজিত, তাদের রোগীর অনেক কাছে আসতে হয়। হার্টবিট চেক করতেও রোগীর নিঃশ্বাস ডাক্তার/নার্সের মুখে এসে লাগতে পারে। তাই তাঁদের সেই মাস্কগুলো অনেক বেশি প্রয়োজন। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কথা। আপনি মাস্ক পরা মানেই এই রোগ আপনাকে ধরবে না, তা কিন্তু নয়। আপনাকে সামাজিক দূরত্ব, হাত ধোয়া, সব মেনে চলতে হবে। শুধু মাস্ক আপনাকে সম্পূর্ণ নিরাপত্তা দিচ্ছে না।
ড. হোসেন উদ্দিন শেখর (বাংলাদেশ): যেহেতু কোনো ভ্যাকসিন বা ওষুধ নাই, তাই ‘প্রিভেনশন ইজ বেটার দ্যান কিউর’। বাংলাদেশের মতো জায়গায়, লকডাউন/কোয়ারেন্টিনে থাকা, হেলথ হাইজিনের নির্দেশাবলি মেনে চলা জরুরি। যেমন ২০ সেকেন্ড সাবান দিয়ে হাত ধোয়া, অথবা হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করা, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা। এগুলোর মাধ্যমে বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ জায়গায় কোভিড-১৯ অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
প্রশ্ন: দেশের মানুষের দীর্ঘমেয়াদে কী বিষয়ে চিন্তা করা উচিত, বা সতর্ক থাকা উচিত?
ডা. মাসুদ বক্স (আমেরিকা): বর্তমান পরিস্থিতির প্রেক্ষপটে বুঝতে হবে যে, এই ধরনের বৈশ্বিক মহামারি প্রতি শতাব্দীতেই আসবে। গত শতাব্দীতে বড় প্যান্ডেমিক এসেছিল ১৯১৮ সালে। এটাকেও আমরা দু–তিন বছররের মধ্যে পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে যাব। কিন্তু মনে রাখতে হবে প্যান্ডেমিক যখন আসে, ভয়ংকর রূপ নিয়েই আসে। আমাদের এ বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে। এটা তো ব্যাধি নিয়ে হলো, কিন্তু অন্য ধরনের মহা-বিপদও আসতে পারে, যেমন নিউক্লিয়ার ওয়ার। যেটাই আসুক, আতঙ্কিত হওয়া যাবে না। আর যারা সেই বিপদটাকে ম্যানেজ করছেন, তাঁদের আদেশ উপদেশ শোনা এবং পালন করার মতো একটা পজিটিভ মনোভঙ্গি সবার তৈরি করা উচিত। যতই বিপদ আসুক, আমাদের মানসিক প্রস্তুতি থাকতে হবে, যেভাবেই হোক আমরা তার মোকাবেলা করব।
ড. হোসেন উদ্দিন শেখর (বাংলাদেশ): যারা কোভিড–১৯ আক্রান্ত হবেন এবং এ থেকে বেঁচে যাবেন, তাঁদের মধ্যে অ্যান্টিবডি গ্রো করবে। এই মানুষগুলো অন্যদের সাহায্য করতে পারেন, যেমন উন্নত বিশ্বে হচ্ছে, যাকে বলে প্লাজমা থেরাপি। আবার তাঁদের ইমিউনিটি নিয়ে গবেষণা করে আমরা নতুন কিছু জানতেও পারি। তাদের জীবনযাত্রা, খাদ্যাভ্যাস—এগুলো নিয়ে নতুন গবেষণার দ্বার উন্মুক্ত হবে। আর ব্যক্তিগতভাবে আমরা এই মহামারি থেকে শিখব, কেন এটা এভাবে ছড়াল, আমাদের হেলথ হাইজিন, আমাদের অভ্যাস। এগুলো নিয়ে পরেও অনেক সতর্ক থাকতে হবে, যেন এমনভাবে আরেকটি মহামারি না ছড়ায়।