বর্ষ বিদায় ও নববর্ষের ভাবনা
চিন্তাবিদরা বলে থাকেন, সময়ের বিভাজন মূলত একটি কল্পিত ধারণা মাত্র। টাইম ইজ অ্যান ইলিউশন। কেননা অনন্ত, অনাদি, অদৃশ্য মহাকাল হলো এমন একটি পূর্ণতা, যার বিভাজন ঘটানো কখনোই সম্ভব নয়। গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিসের আমল থেকেই বলা হচ্ছে, আমরা কেবল বর্তমানেই বেঁচে থাকি। উই লিভ ইন প্রেজেন্ট। অতীত অথবা ভবিষ্যৎ, নদীগর্ভের অজস্র ঊর্মিমালার মতো মহাকালেই চিরবিলীন। তাদের অস্তিত্ব প্রতীয়মাণ হয় শুধু আমাদের বর্তমান জীবনের ভাবনায়। সময় নিয়ে বিস্তর চিন্তাচেতনা হাজার হাজার বছর আগে দার্শনিকেরা এভাবেই করেছিলেন। বর্তমানেও বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ শেষে কসমোলজিস্ট আর পদার্থবিদদের কাছে ‘সময়’ একটি কল্পিত ধারণাই। সে ধারণা মূলত বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহের মাঝখানে একটি কল্পিত যতিচ্ছেদ। তাঁদের কাছে বিশ্বসৃষ্টির বয়স এবং সময়ের বিবর্তনে ইউনিভার্সের অবস্থান কখন কী অবস্থায় ছিল, সেই বিশ্লেষণেই ‘সময়’ একটি আকর্ষণীয় উপাদান। বিগ ব্যাং থিওরির পদার্থবিদেরা মহাকালের বিভাজনে বিশ্বাসী হয়েছেন বিশ্বের ক্রমবিকাশ এবং তার পরিণতি জানার গাণিতিক প্রয়োজনে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, শুধু বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের গাণিতিক যৌক্তিকতায় কিংবা দার্শনিক ভাবনার জটিলতম জিজ্ঞাসায় মানুষের মনের সব রকম মননশীলতা পরিণতি পায় না। মানুষের জীবনভাবনা জুড়ে রয়েছে আবেগ আর হৃদয় গভীরতার প্রশ্ন। সেই ভাবনা থেকেই অখণ্ড, অনাদি, বিরতিহীন মহাকালকে মানুষ আপন প্রয়োজনে জীবন সীমানার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পরিধির মধ্যে নতুনরূপে সৃষ্টি করে নিয়েছে। বর্ষ বিদায় এবং নতুন বছরের ভাবনা সেই প্রয়োজন থেকেই জন্ম নিয়েছে হাজার হাজার বছর আগে।
প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই বর্ষ বিদায় এবং নতুন বছরকে স্বাগত জানানো মানুষের আবেগ ও হৃদয়বোধেরই একটি অন্তর্নিহিত প্রতিফলন। ইতিহাস সচেতন পাঠকমাত্রের জানা, প্রাচীন রোমের পৌরাণিক দেবতা জেনাসের নামানুসারে নতুন বছরের প্রথম মাস জানুয়ারির নামকরণ। দেবতা জেনাসের দুটি মুখ। একটি সূর্য অপরটি চন্দ্র। সূর্য উত্তাপ বিকিরণ করে জীবন সঞ্চালন ঘটায়। চন্দ্র তার মধুর আলোয় জীবনের পরিপুষ্টি আনে। আবার জেনাসের একটি মুখ ভবিষ্যতের প্রতীক, অন্যটি অতীতের। তিনি পার্থিব মানুষের জীবনদ্বারের প্রহরী। তাই দৃষ্টি প্রসারিত করে আছেন আমাদের অতীত থেকে অনাগত ভবিষ্যতের দিকে। অতীত থেকে অনাগতের যাত্রাপথে যে চলমান প্রবাহমানতা, জেনাস তার নিয়ামক এবং নিয়ন্ত্রক। তিনি স্বস্তি, শান্তি আর কল্যাণের দেবতা। প্রাচীন রোমানরা এঁকে ভক্তিভরে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করতেন বিভিন্ন বিবাহ অনুষ্ঠানে। ব্যবসা–বাণিজ্য শুরুর আগে ও পরে। শিশু জন্মের মুহূর্তে। কৃষিকাজ শুরুর আরম্ভে কিংবা শস্য সংগ্রহ শেষে সামাজিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। বহু প্রাচীনকালেই জীবন সম্বন্ধে মননশীল মানুষের মনে সুকুমার ভাবনার যে জাগরণ ভালোবাসা ও আবেগের সংমিশ্রণে ঘটেছিল, মানুষ তাকে বর্ষ বিদায়ের বেদনাময় অনুষ্ঠানে যেমন রূপায়িত করতে চেয়েছে, তেমনি জীবনের শুভ কামনায় জগতের অনিবার্য নিয়মে নতুনকেও অভিনন্দিত করতে সে ভোলেনি।
ইতিহাসবিদেরা জানিয়েছেন, চার হাজার বছর আগে প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার বেবিলিয়নরা ‘আকিতু’ নামে নববর্ষ অনুষ্ঠান পালন করে সুখী, শান্তিপূর্ণ, শুভময় ভবিষ্যতের জন্য প্রার্থনা জানাতেন দেবতার দুয়ারে। ইউফ্রেটাস নদীর দুই পারাপারের অধিবাসীরা তখন নতুন বছরের সূচনা করতেন ২১ মার্চ। বিশ্বের সব দেশেই গ্রেগরিয়ান ক্যাল্লোর অনুসরণ করে এখনো পর্যন্ত ৩১ ডিসেম্বর বর্ষ বিদায় কিংবা ১ জানুয়ারি নতুন বছর উদযাপনের রেওয়াজ নেই। কিন্তু বর্ষ বিদায় এবং শুভ নববর্ষকে অভিনন্দিত করে অনুষ্ঠান পালনের রীতি জগতের বেশির ভাগ দেশেই প্রতিপালিত হয়ে থাকে বেদনা এবং আনন্দের পরিপূরক হয়ে। কারণ মরণশীল মানুষের সীমাবদ্ধ জীবন পরিক্রমায় এবং সভ্যতার অগ্রগতিতে প্রাচীনতম যুগ থেকেই সময় চেতনা এক বিরাট ফ্যাক্টর। জীবনের চাঞ্চল্যকে ঘিরে যত কিছু ঘটনাপ্রবাহ ঘটে গিয়েছে মানব সভ্যতায়, সেই ঘটনাকে অনাদি সময় প্রবাহের খণ্ড খণ্ড পরিমাপের মধ্যে বিভাজ্য করে সচেতন অনুভূতিশীল মানুষ স্মরণ করতে চেয়েছে, ব্যথায় দুঃখে ও প্রেমে আনন্দে। সভ্যতার ঊষাকালেই তাই রচিত হয়েছিল সময় নির্ণয়ের ক্যাল্লোর।
পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীনতম ক্যাল্লোরের নাম এই যুগের প্রত্নতাত্ত্বিকেরা রেখেছেন, ‘অ্যাডাম’স ক্যাল্লোর’। অ্যাডাম’স ক্যাল্লোর প্রস্তর যুগে তৈরি, প্রস্তরনির্মিত সুমেরিয়ান সভ্যতার নির্দশন। প্রাপ্ত হয়েছে আফ্রিকা মহাদেশে, জোহানেসবার্গের মাটি খুঁড়ে। বয়স এক লাঁখ বছরের অধিক। এরপর সময়ের বিশুদ্ধ বিভাজন নির্ণয় করতে তৈরি করা হয়েছে অজস্র সময় পঞ্জিকা। অসীম মহাকালের কালপ্রবাহে তাদের অনেকেই গেছে ধ্বংস হয়ে। কেউবা সময়ের সাক্ষ্য দিতেই যেন সহস্র বছর পেরিয়ে জীর্ণ অবস্থায় পৌঁছেছে প্রত্নতত্ত্ববিদদের হাতে। প্রাচীনকালের নিদর্শন হিসেবে মায়া ক্যাল্লোর, জুলিয়ান ক্যাল্লোর, গ্রেগরিয়ান ক্যাল্লোর আজও উল্লেখযোগ্য। আধুনিক যুগে বিশ্বের অধিকাংশ দেশই অফিশিয়ালি গ্রেগরিয়ান ক্যাল্লোরের অনুসারী। এই মতে আর মাত্র কদিন পরে ২০১৪ সাল বিদায় নেবে পৃথিবী থেকে। শূন্যস্থান পূর্ণ করবে নবাগত নববর্ষ—২০১৫।
নতুনের আগমনে পুরাতনের বিদায়পর্ব জগতের এক স্বাভাবিক শাশ্বত নিয়ম। কিন্তু মানব হৃদয়েরও শাশ্বত নিয়ম বিচ্ছেদ বেদনায় ব্যথিত হয়ে ওঠা। বর্ষ বিদায় কিংবা নববর্ষের ধারণা তাত্ত্বিক দিক থেকে তাই কল্পিত হলেও মানুষের আবেগের জায়গাগুলোতে সে আলোড়ন তুলবেই বছরের শেষ দিনটিতে এসে। কেননা বিগত ৩৬৫ দিন ধরে চলমান কালপ্রবাহের একটি সুনির্দিষ্ট সময়সীমা ২০১৪ সালের অস্তিত্ব নিয়ে বহুদিন বন্দী হয়ে স্থায়ী হয়েছিল আমাদের চেতনায়। অন্তরের অন্তস্থলে সর্বদাই আসীন ছিল সে, যাকে ঘিরে জগতের নিত্য জীবনের প্রাত্যহিক ঘটনা বিভিন্ন স্মৃতিতে বিজড়িত হয়ে আছে, যে বিদায়ী বছর আমাদের অন্তরে গভীর, জটিল এবং ওতপ্রোত অবস্থায় জড়িয়েছিল ৩৬৫ দিন ধরে, বহু মানুষের সংবেদনশীল চেতনায় তার চলে যাওয়ার ব্যথাদগ্ধ মুহূর্তগুলো বেদনার প্রপাত ফেলবেই নিবিড়তর অনুভবে।
যে অনুভূতির প্রয়োজনে মননশীল মানুষ সৃষ্টির ঊষালগ্ন থেকে বারবার ডানা মেলেছে নিত্য নতুন অভিযাত্রার পথে। যুগে যুগে রচনা করেছে অজস্র কবিতা, গান আর বিদগ্ধ প্রার্থনা। সৃষ্টি হয়েছে উৎকৃষ্ট শিল্পের চরমতম নিদর্শন। কবির ভাষায়, ২০১৪ সালকে বিদায় জানাতে গিয়ে সেই অনুভবের ভাষাতেই তাই বলতে হয়, হায়! যে সময় যায়, ফিরাইব তায় কেমনে! যে চিরতরে বিদায়ী হয় তাকে ফিরিয়ে আনার পথ খোলা নেই। কিন্তু নতুনকে আহ্বান জানিয়ে সেই শূন্যস্থান পূর্ণ করা চলে। পুরাতনকে বিদায় জানিয়ে নতুনকে আহ্বান জানাতে বোধোময় মানুষ তাই ভোলেনি। সেই বোধ থেকেই সুস্বাগতম জানাই ২০১৫ সালকে! বিশ্ববাসীর জীবনধারা তোমার পুণ্য আগমনে শুচি হোক! স্নিগ্ধ হোক ধরণীতল! শুভ হোক আমাদের নিরন্তর জীবন ভাবনা!
দীপিকা ঘোষ
যুক্তরাষ্ট্র