এখানে শীত মৌসুমে গাছের পাতা ঝরে যায়। পাতা হারানোর বেদনা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে গাছগুলো। আবহাওয়া পরিবর্তন হয় ধীরে ধীরে, যেন সাপের মতো খোলস বদল হয়। শুরু হয় তুষারপাতের মৌসুম। নভেম্বর থেকে শুরু করে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত থেমে থেমে চলতে থাকে তুষারপাত। প্রতিদিন তুষারপাত হয় না, তবে দু-একদিন পর পর পড়ে। যখন স্নো পড়ে দেখতে সুন্দর লাগে, থামার পরে দেখতে আরও সুন্দর লাগে। মনে হয় যেন কাশবন। অন্যভাবে বললে মনে হয়, যেন বকেরা সাদা পালক ফেলে গেছে সারা শহরে। তুষারের সাদা চাদরে ঢেকে যায় পুরো শহর। ধবধবে সাদা, স্নিগ্ধ—এ এক অপরূপ সাজ। তুষারপাত হতে থাকে, এক ঝাঁক বকের মতো নাম ঠিকানাহীন, উদ্দেশ্যহীন উড়তে থাকে।
প্রথম ২০০০ সালে যখন আমেরিকা আসি, তখন ছিল জুনে প্রথম সপ্তাহ। গ্রীষ্মের সময়, বেশ গরম ছিল। ভেবেছিলাম আবহাওয়া বোধহয় এমনই। কিন্তু নভেম্বর আসার পর টের পেলাম, আবহাওয়া তার ঠিক উল্টো স্রোতে প্রবাহিত হতে লাগল। একদিন ঘুম থেকে উঠে দেখি বাসার চারপাশ তুষারে ঢেকে আছে। অবাক হয়ে তাকিয়েছিলাম। কী অপরূপ! অন্যরকম এক সৌন্দর্য। সাদা স্নিগ্ধ কাশফুলের বাগানের মতো। স্নো পড়া শেষ। সূর্যের কিরণ হালকাভাবে তুষারের ওপর ছড়িয়ে দিল তার দ্যুতি। কী এক মোহমায়ায় আচ্ছন্ন হয়ে গেলাম! দেখছিলাম আর কফি পান করছিলাম। হলিউড সিনেমায় তুষারপাত দেখেছিলাম, কিন্তু বাস্তবে এর চেয়ে সুন্দর। কফি শেষ করে বেরিয়ে পড়লাম। নিজেকে কিছুতেই আটকে রাখতে পারছিলাম না।
আমার স্বামী বললেন, ভালোভাবে কোট, গ্লাভস, বুট পরে নাও। না হয় ঠান্ডা লেগে যাবে। কোট, বুট পরলাম ঠিকই, কিন্তু হাতের গ্লাভস পরলাম না। মনে হলে গ্লাভস পরলে তো তুষার আর বরফ ছুঁয়ে দেখতে পারব না।
বেরিয়ে দেখি, ছোট ছোট বাচ্চারা তাদের স্নো বাকেট নিয়ে বের হয়েছে, কেউ স্নোম্যান বানাচ্ছে। অন্যরকম এক দৃশ্য। ছোট–বড় সবাই আনন্দ করছে। এ আনন্দ অন্যরকম। কেউ ছবি তুলছে। কেউ বাচ্চাদের সঙ্গে তাল মেলাচ্ছে। আমি বরফের বুকে লিখে দিই প্রিয়জনের নাম, সে নাম আস্তে আস্তে মিশে যায় তুষারের সঙ্গে।
তুষারে জমা বরফ হাতে তুলে নিলাম, দেখি তুলার মতো নরম। মুঠোবন্দী করলাম, এদের বন্দী করা যায় না, এরা স্বাধীনচেতা। জাদুর মতো হারিয়ে গেল। প্রচণ্ড ঠান্ডা বরফ, তবু ধরতে ভালো লাগছিল।
গাছের দিকে তাকিয়ে দেখি, গাছেরাও তুষারকে আলিঙ্গন করে নেয়। তুষারের ভারে নুয়ে পড়ে মগডাল পাতারাও ঝুলে থাকে দোলনার মতো। মাইলের পর মাইল রাস্তার দুপাশের গাছগুলোকে মনে হয় কাশফুলের বাগান। এত ধবধবে সাদার বুকে কোন কালিমা নাই। কী স্নিগ্ধতা, কী মায়াময়!
সবুজ ঘাসগুলো মিশে গেছে তুষারের সঙ্গে, যেন ঘাসেরা এর পরম আত্মীয়। আমিও শিশুদের সঙ্গে যোগ দিলাম। আমেরিকান সব শিশু। ওরা আমাকে পেয়ে আরও আনন্দ পেল। কিছু সময় তাদের সঙ্গে থেকে বাসায় ফিরলাম। কিন্তু ততক্ষণে হাঁচি দিতে শুরু করেছি। এই আবহাওয়ার আমি অভ্যস্ত না বলেই হয়তো এমন হয়েছিল।
আমেরিকায় তুষারপাত নতুন কিছু নয়, শীতে এই রকম তুষারপাত হয়। এখন আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি এ রকম পরিবেশের সঙ্গে। গত সপ্তাহেও তুষারপাত হয়েছিল। এখন এই শহরটাকে কাশফুলের শহর মনে হচ্ছে। বাচ্চারা স্নো বল খেলে, লাফ দেয়, মজা করে—এ এক অন্যরকম দৃশ্য।
সমস্যা হয় যখন বরফ গলতে থাকে, রাস্তাঘাট একেবারে পিচ্ছিল হয়ে যায়। তখন দুর্ঘটনার সম্ভাবনা থাকে ৯৫ ভাগ। তাই তুষারপাতের সময় কমিউনিটির লোকজন রাস্তায় লবণ ছিটিয়ে দেয়, না হয় পরিষ্কার করার কাজে নেমে যায় যাতে দুর্ঘটনা না ঘটে। আর যাদের নিজেদের বাড়ি তাদের দায়িত্ব বাড়ির চৌহদ্দিতে যতটুকু তুষার পড়ে, তা পরিষ্কার করা। তাই অনেকে তুষারপাত বন্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পরিষ্কার করে, না হয় জমে শক্ত হয়ে আঠারো মতো হয়ে যায়, তবে অনেক বেশি হলে কমিউনিটির লোক এসে হেল্প করে।
যে পরিমাণ তুষারপাত হয়েছিল, এখনো আছে। এই বরফ গলতে আরও একদিন লাগবে।
এখন বাইরে উজ্জ্বল রোদের ঝলকানি। অফিস আছে। ভাবছি যাব না, শিশুদের সঙ্গে বাইরে স্নো বল খেলব। এই বরফের মধ্য দিয়েও স্কুল, অফিসে যাচ্ছে সবাই। যাদের গাড়ি আছে, তাদের খুব অসুবিধা হয় না। কিন্তু যারা বাসে, সাবওয়েতে যায় তাদের প্রচুর কষ্ট। একটু ভালো থাকার জন্য মানুষ যে কী পরিমাণ কষ্ট করে, তাকিয়ে দেখি আর ভাবি, এত কষ্টের পরও কী তারা ভালো থাকে? কিন্তু অবাক ব্যাপার হচ্ছে, অনেকে কষ্ট করে বরফ পরিষ্কার করে। তারপরও যেন ক্লান্তি নেই। বেশি তুষারপাত হলে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে স্কুল–কলেজ বন্ধ করে দেয়। এতে বাচ্চারা খুশি। কারণ বরফ নিয়ে খলতে পারবে। স্কুলে যেতে হবে না, তারা আনন্দ করে হইচই করে।
এখন প্রায় ঠান্ডা কমে আসছে, আস্তে আস্তে তুষারপাতও কমে যাবে। পাতা ঝরা দাঁড়িয়ে থাকা গাছগুলোতে সবুজ পাতা আসবে, সেটা আবার অন্যরকম সৌন্দর্য। এখানে আবহাওয়া সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা কঠিন। আবহাওয়া এই ভালো তো এই খারাপ। আর গরম হলে প্রচণ্ড গরম, ঠান্ডা হলে একেবারে বরফ মানে তুষার পড়তে থাকে। তবে সিস্টেম ভালো হওয়ার কারণে মানুষের স্বস্তি। যত ঠান্ডা হোক বাইরে, বাসার ভেতরে হিটার থাকে যার কারণে প্রচণ্ড ঠান্ডা হলেও অসুবিধা হয় না। জীবনযাত্রা থেমে নেই। সুন্দরভাবেই আমেরিকানরা চালিয়ে যাচ্ছে। স্কুল, কলেজ, অফিস সবকিছুই চলছে নিয়ম মতো। আসলে এখানে নিয়মের বাইরে যাওয়ার মতো কোন অনিয়ম নাই।
দেশের কাশফুলও অনেক সুন্দর। কাশফুল তার সৌন্দর্য জানান দিয়ে বলে, আমাকে আলিঙ্গন করো, উপভোগ করো। মানুষ প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে যায়। আসলে প্রকৃতি সব সময় সুন্দর। তবে দেশ ভেদে আলাদা এই যা! এখানে কাশফুলের বাগান না থাকলেও তুষারপাত–বরফ আছে। এর সৌন্দর্য অন্যরকম। এই সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতি তার রূপ বদলায়। প্রকৃতির এই অপরূপ সাজ উপেক্ষা করে সে সাধ্য কারও নেই।