
আমার ছোটবেলা কেটেছে সিলেটের একটি নিভৃত পল্লিতে। আর বড়বেলা কেটেছে ইংল্যান্ডের আরও একটি নিভৃত পল্লিতে। পল্লি অঞ্চলের সঙ্গে আছে আমার আত্মার নিবিড় আত্মীয়তা। ছোটবেলার স্মৃতি আহ্লাদ, আনন্দের ও মধুর এবং কখনো কখনো কষ্টের। তার চেয়েও উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো ছোটবেলার স্মৃতি অবিস্মরণীয় বিভিন্ন কারণে, তা স্মৃতিতে আজও অম্লান।
সন্ধ্যায় সারা গ্রামজুড়ে নামত অন্ধকার। কোনো ইলেকট্রিসিটি ছিল না আমাদের পল্লি অঞ্চলে। বস্তুত আমরা এই জিনিসের (ইলেকট্রিসিটি) স্বপ্নও দেখতাম না। মাসের ১৫ রাত আমাদের নির্ভর করতে হতো জ্যোৎস্নার আলোর ওপর। নির্জন গ্রামে অন্ধকারাচ্ছন্ন রাতেরবেলায় ব্যাটারি-লাইট ছিল অবলম্বন। তাও অনেকেরই ছিল সামর্থ্যের বাইরে। বলা যায় হ্যারিকেনের অনুজ্জ্বল আলো ছিল রাতে চলার সঙ্গী।
রাতে একা চলতে যখন পার্শ্ববর্তী লতাগুল্মের জঙ্গল থেকে সরসর শব্দ ভেসে আসত গা শিউরে উঠত। একটি হিমেল হাওয়া যেন বয়ে যেত গ্রীবা বয়ে মেরুদণ্ড হয়ে সমস্ত শরীরে। ভয়ে শরীরের রক্ত যেন জমাট বাঁধবে বাঁধবে, তখন একঝাঁক জোনাকি মিটিমিটি সোনালি বাতি জ্বালিয়ে যখন পাশ দিয়ে উড়ে যেত মনে হতো রাস্তায় আমি একা নই। বলা বাহুল্য আমার ছেলেবেলায় জিন-ভূত ছাড়া আমরা মানুষরূপী হায়েনাদের ভয় করতাম না। কারণ তখন খুব কম ঘটনা ছিল যেখানে মানুষ হায়েনা রূপে আবির্ভূত হতো।
আষাঢ়ে মাঠঘাট বন্যার পানিতে যখন থই থই করত তখন রাতে নৌকায় বসে দূর থেকে গ্রামটিকে মনে হতো যেন আকস্মিক ঝড়ের পরে দাঁড়িয়ে আছে শান্ত হয়ে। স্তব্ধ বাকরুদ্ধ। বর্ষায় পানি আর পানি গ্রামের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে আরও মনোমুগ্ধকর করে তুলত। ছোট গ্রামটিকে মনে হতো যেন পানির ওপরে দাঁড়িয়ে থাকা সদ্য ভেসে ওঠা ছোট্ট একটি দ্বীপ। আষাঢ়ে বন্যার সঙ্গে ছিল গ্রামবাসীর মিত্রতা। প্রতি বৎসরই ছিল বন্যার সঙ্গে বসবাস।

বন্যার সঙ্গে কীভাবে বসবাস করতে হয় তা ছোটবেলা থেকেই প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। হাইস্কুল ছিল আমার গ্রাম থেকে তিন মাইল দূরে। যোগাযোগের কোনো রাস্তা ছিল না। আহ! কী বলব, লুঙ্গি পরে হাঁটু কিংবা কোমর পর্যন্ত পানি ভেঙে তিন মাইল হেঁটে যখন স্কুলের কাছে পৌঁছতাম তখন পা থেকে কাদা ধুয়ে মুছে লুঙ্গি খুলে ট্রাউজার পরে স্কুলে ঢুকতাম। স্কুল শেষে আবার লুঙ্গি পরে বাড়ি ফিরতাম হেঁটে হেঁটে বন্যার পানি ভেঙে। কখনো হাঁটু পানি আবার কখনো কোমর পর্যন্ত পানি। খুব কম সময়ই নৌকায় করে স্কুলে যেতে পারতাম। নৌকায় ভ্রমণ নিয়ে রচনা লিখতে হতো প্রায় প্রতিটি পরীক্ষায়।
প্রাইমারি স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে হাইস্কুলে যখন পা রাখি তখন শিক্ষক বন্যার চিত্র আঁকতে বলতেন। আজও স্মৃতিতে অম্লান, একবার একটি চিত্র এঁকে শিক্ষকসহ সমস্ত ক্লাসকে অবাক করে দিয়েছিলাম। একটি সংবাদের পরিপ্রেক্ষিতে একটি চিত্র এঁকেছিলাম। মাচাং বেঁধে মানুষ নিজের ঘরে বসবাস করছে। নিচে পানি। ঘরের মেঝেতে কোমর পর্যন্ত পানি। রাতের অন্ধকারে মানুষ ও সাপ একসঙ্গে বসবাস করছে। চিত্রটি আমার কল্পনা ও বাস্তব ঘটনার ওপর ভিত্তি করে। আমার শিশুমনে দাগ কেটেছিল একটি সংবাদ। মা শিশুকে সঙ্গে করে ঘুমিয়ে ছিলেন মাচাঙের ওপর। শিশুটি পড়ে গিয়েছিল রাতের অন্ধকারে। আমি আজও আমার চোখের সামনে দেখি সেই মাকে। যে মায়ের চিত্র আমি এঁকেছিলাম।
এখন ২০১৭ সালে আমি যখন বাংলাদেশের বন্যার ছবি দেখি ফেসবুক, অনলাইন পত্রিকা ও টিভিতে, আমি হারিয়ে যাই আবার আমার সেই ছোটবেলায়। যখন মায়েরা তাদের শিশুদের হারাতেন রাতের অন্ধকারে। আমার অজান্তে আমার চোখের কোণে একফোঁটা পানি জমাট বেঁধে বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছে হারানো সেই দিনগুলোর কথা। আমি হারিয়ে যাই আমার ছোটবেলার দিনগুলোতে। ওই সংবাদ আমার কানে আজও ভেসে আসে—ছোট শিশুটির মাচাং থেকে পড়ে যাওয়ার দৃশ্য। সেই মায়ের কথা মনে হয় এবং আজও দেখি যে মা বন্যার পানিতে হারিয়ে ছিল তার শিশুসন্তানকে (ছবিতে দেখুন কীভাবে একজন মা তার শিশুসন্তানকে জড়িয়ে হেঁটে যাচ্ছেন। খুঁজছেন একখণ্ড শুকনো মাটি)।
আমি আমাকে হারিয়ে ফেলি। হারিয়ে ফেলি প্রলয়ংকরী বন্যাদুর্গত জনগণের মাঝে। আমি তাদের মাঝে হারিয়ে যাই। আমি মাচাঙে বসে আছি কোনো এক মায়ের সঙ্গে। যিনি তার শিশু সন্তানকে নিয়ে অধীর অপেক্ষায় আছেন, কখন ভয়াল বন্যার পানি অপসারিত হবে। আমার চোখের কোণে একফোঁটা পানি বন্যার পানির সঙ্গে একাকার হয়ে যায়। চোখের পানির ফোঁটা ক্রমাগত ঝরে, কখনো থামবে না আর। আমি উদ্বেল ও বাকরুদ্ধ, আমার হৃদয়ে ক্রমাগত রক্তকরণ। আমি বড়ই অসহায়। আমি নিজেকে হারিয়ে ফেলি যখন দেখি এক মা তাঁর দুধের শিশুকে নিয়ে সাঁতরে সাঁতরে এগোচ্ছেন একমুঠো শুকনো ভূমির সন্ধানে। যেখানে তিনি দাঁড়াবেন তার সন্তানটাকে নিয়ে একদণ্ড। ক্ষণিকের নিশ্বাস নিতে।

মানুষ কত অসহায়! বন্যা এক ভয়ংকর শব্দের নির্মম উচ্চারণ। ভালো নেই আমরা মানুষ নামক অসহায় জাতি। অসহায় সর্বদায় প্রকৃতির অসীম শক্তির কাছে। এখনো দেখি আমি মাচাঙে একসঙ্গে মানুষ আর সাপ অপেক্ষার প্রহর গোনে, কেউ কারও শত্রু নয় আজ। আজ চারদিকে নদী চারদিকে সাগর। হ্রদ, নদী, বিল-ঝিল, হাওর কোনো পার্থক্য নেই। যেদিকে চাই সেদিকে পানি। পানি থই থই করে কিন্তু কোথায় পাই এক গ্লাস পানি, তৃষ্ণায় যেন অন্তর ফেটে যায়। পানীয় জলের এতই অভাব, এক গ্লাস পানির অপেক্ষায় হাজার হাজার মানুষ আজ।
এখানে ইংল্যান্ডে ‘ইভিনিং স্ট্যান্ডার্ড’ একটি জনপ্রিয় দৈনিক পত্রিকা। পাঠকপ্রিয় পত্রিকা। বাংলাদেশের ‘প্রথম আলোর মতো। এই পত্রিকা যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে আসে। তারা তাদের পাঠকদের কাছ থেকে সাহায্য সংগ্রহ করে দুর্যোগ পীড়িত মানুষদের প্রদান করে। আমরা যারা পাঠক তাদের সংঘবদ্ধ হয়ে সাহায্য করার সুযোগ নেই। আমি প্রথম আলো কর্তৃপক্ষকে উদাত্ত আহ্বান জানাব তাড়াতাড়ি বন্যা দুর্গতদের জন্য অ্যাকাউন্ট খুলে পাঠকদের কাছে সাহায্যের আহ্বান জানাতে। শুধু সংবাদ প্রচার করে দায়িত্ব এড়ানো যাবে না এই মহাদুর্যোগে। আমি উদাত্ত আহ্বান জানাই সমাজের সর্বস্তরের জনগণের কাছে। দয়া করে একটি বস্তু যা কিনা নিশ্চিতভাবে দরকারি নয় (যেমন দুধ, রুটি অথবা ফলমূল), তা না কিনে সেই অর্থ বন্যা দুর্গতদের দান করুন। আপনার অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো হোক অথবা মন্দ, আপনি সাহায্যে এগিয়ে আসতে পারেন যেমন পারেন একজন বিত্তবান ব্যক্তি। মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে এই দুর্যোগে প্রতিবেশীদের সাহায্যের সামর্থ্য দান করুন। আমিন। (চলবে)
লেখক: ব্যারিস্টার। ইংল্যান্ডে আইন পেশায় কর্মরত। ফেসবুক: <শহীদ শতাব্দী>
ধারাবাহিক এই রচনার আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন: