বন্ধুত্ব আগলে রাখো

দীর্ঘ ৩৬ বছর পর ফরিদা, রুমা, স্নিগ্ধা ও লিপি এই চার বন্ধুর দেখা। সে এক আবেগঘন দৃশ্য।

বন্ধুত্ব কী—এই প্রশ্নের জবাবে কেউ বলেছিল, ‘বন্ধুত্ব আমার কাছে অক্সিজেনের মতো। যাকে বিশ্বাস করে নিজের একান্ত সব কথা বলা যায়, বুকের ভেতরে চেপে থাকা দীর্ঘশ্বাস, দম বন্ধ হয়ে আসা হাঁসফাঁস থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। কিন্তু একবারও মনের কোণে সংশয় দেখা দেয় না, কথাগুলো সে অন্য কাউকে বলে দিতে পারে।’ আরেকজন বলল, যে আমার বিপদে এগিয়ে আসে নিঃস্বার্থভাবে, সে-ই বন্ধু। বন্ধুত্বে অভিমান কিংবা বৈরিতা থাকবেই। আরেকজন ভাষ্য, ‘মনের সঙ্গে মনের মিল হলেই বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। আমার অনেক মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্বের প্রয়োজন নেই। একজন আস্থা ও নির্ভরতার প্রাণের বন্ধু হলেই সারা দিনের কর্মক্লান্ত শরীরে শক্তি পাই। সুসময় কিংবা দুঃসময়ে প্রাণের বন্ধু পাশে থাকলে রক্তচাপ স্বাভাবিক থাকে।’

এবার প্রশ্ন হচ্ছে, সেই প্রাণের বন্ধুর দেখা কি আমরা আদৌ এক জীবনে পাই? দীর্ঘদিন পর পর যখন দেশে যাই, মনের টানে ছুটে যাই স্কুল-কলেজ জীবনের সহপাঠীদের বাসায়। মনে হয়, তাঁরাই সত্যিকারের বন্ধু। কেননা শৈশব-কৈশোরের দুরন্তপনা, সরলতা আর উচ্ছলতার সঙ্গে জড়িয়ে আছে তাঁরা। ছোটবেলার এই সব বন্ধুরা কখনো, কোনো অবস্থাতেই ছেড়ে যাবে না। আবার দীর্ঘ প্রবাস জীবনে যারা সহকর্মী ছিলেন, বিপদে আপদে তাঁদের সহযোগিতা, সহমর্মিতায় আবেগাপ্লুত হয়ে মনে হয়েছে তাঁরাই প্রকৃত বন্ধু। সন্তানদের সঙ্গে গল্পচ্ছলে প্রায়ই বলি, আমি মা পরিচয়ের চেয়ে বন্ধু হয়ে উঠতে বেশি ভালোবাসি। তাঁরাও একবাক্যে মেনে নিয়ে বলে ওঠে, আমরা তোমার বন্ধু তো! কিন্তু সত্যি বলতে কী, সন্তানেরা তাদের সুখ-দুঃখ, ভালোমন্দ সব অনুভূতি মায়ের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিতে চায় না। কোথায় যেন একটা সূক্ষ্ম দূরত্ব থেকেই যায়।

মার সঙ্গে আমারও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। কিন্তু বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আর বন্ধুত্ব, দুটো একেবারেই ভিন্ন বিষয়। এই বিদেশ বিভুঁইয়ে এসে উপলব্ধি করি, মায়ের সঙ্গে সেই অর্থে বন্ধুত্ব ছিল না। থাকলে স্বজন, পরিজনহীন এই বিদেশ বিভুঁইয়ের কঠিন সংগ্রামী জীবন মায়ের কাছে গোপন করতাম না। মা কষ্ট পাবেন, এমন আশঙ্কায় অশ্রুজল আর দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে মাকে ভালো থাকার মিথ্যা গল্প শোনাতাম না। তাহলে কার সঙ্গে খোলা বইয়ের মতো হরহর করে বলে যাওয়া যায় সব সুখের কথা? কার কাছে বলা যায় জীবনের চরমতম দুঃখদিনের কথা? হাউমাউ করে কেঁদে বুক ভাসানো যায়?

জীবনের এ বেলায় এসে উপলব্ধি করি, সে আমার বোন। একই মায়ের জঠরে বেড়ে ওঠা বোন। আমাদের খুনসুটি জন্ম জন্মান্তরের। বিয়ে, সংসার, ব্যস্ততা আমাদের বন্ধুত্বে দেয়াল হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। বিচ্ছেদ তৈরি করতে পারেনি এতটুকুও। রাতের পর রাত নির্ঘুম থেকে আমরা কথা বলেছি আটলান্টিক মহাসাগরের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে। আমাদের দিনরাতের বিশাল পার্থক্য ছিল, সাংসারিক ব্যস্ততা ছিল। তবুও নিশ্চিন্ত মনে প্রাণখুলে আনন্দ ভাগাভাগি করেছি। অশ্রুজলে দুঃখের কথা বলে নির্ভার হয়েছি। একের বিপদে অন্যে নিঃস্বার্থভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছি। বছরের পর বছর অপেক্ষায় থেকেছি আবার সেই ছোটবেলার মতো একসঙ্গে সময় কাটানোর। অতঃপর দীর্ঘ প্রায় দুই যুগের অপেক্ষার পাহাড় ডিঙিয়ে আমরা এই নিউইয়র্ক নগরে আবার একত্রিত হয়েছি। আমার মনে হয়েছে, ‘আমি পাইলাম, আমি ইহাকে পাইলাম। আমি আমার প্রাণের বন্ধুকে ফিরিয়া পাইলাম’। এই দীর্ঘ প্রতীক্ষিত মিলনে আমাদের দুঃখ-সুখের গল্পগুলো প্রাণ ফিরে পেয়েছে।

আসলে প্রতিটি সম্পর্কের মাঝেই বন্ধুত্ব বিষয়টা বড় বেশি প্রয়োজন। সম্পর্কগুলো যত্নে আগলে রাখতে হয়। পরিচর্যা করতে হয়। উইলিয়াম শেক্‌সপিয়ার বলেছেন, কাউকে সারা জীবন কাছে পেতে চাইলে প্রেম দিয়ে নয়, বন্ধুত্ব দিয়ে আগলে রাখতে হয়। কারণ প্রেম একদিন হারিয়ে যায়, কিন্তু বন্ধুত্ব কখনো হারায় না।